ইভা ও তার দুই ভাই
অপরাধ

সুজন হত্যার ৯ বছর পর রহস্য উদঘাটন

নিজস্ব প্রতিবেদক:

রাজধানীর সবুজবাগে সুজন হত্যার প্রায় ৯ বছর পর প্রকৃত রহস্য উদঘাটন করেছে পিবিআই ঢাকা মেট্রো (উত্তর)। এই হত্যার ঘটনার সঙ্গে জড়িত একজনকে গ্রেফতারের পর পিবিআই জানতে পারে, সুজনকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে তার লাশ খালে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

মঙ্গলবার (১১ আগস্ট) পিবিআই ঢাকা মেট্রো (উত্তর) ইউনিট ইনচার্জ (ভারপ্রাপ্ত) অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ওসমান গণি গণমাধ্যমকে এ তথ্য নিশ্চিত করেন।

তিনি বলেন, ‘২০১১ সালের ১৪ মার্চ খুন হন ঠিকাদার আব্দুল মান্নানের ছেলে সুজন (২৬)। ১৮ মার্চ দুপুরে সবুজবাগের দক্ষিণ রাজারবাগ (বাগপাড়া) শেষ মাথায় খাল থেকে তার লাশ উদ্ধার হয়। সুজনের অর্ধগলিত লাশ তার পরিবার শনাক্ত করে। নিহত সুজনের বাবা আব্দুল মান্নান সবুজবাগ থানায় এ ঘটনায় একটি হত্যা মামলা করেন। মামলাটি সবুজবাগ থানা ও ডিএমপির ডিবি সাত বছর তদন্তের পর আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে। তবে ডিবির অভিযোগপত্রের বিরুদ্ধে নারাজি দেন সুজনের বাবা। এরপর মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পায় পিবিআই।’

তদন্ত করতে গিয়ে পিবিআই জানতে পারে, ২০০৮ সালের দিকে সুজনের সঙ্গে একই এলাকার ইভা নামে এক তরুণীর বিয়ে হয়েছিল। তবে এক বছর পরই ২০০৯ সালে সুজনকে তালাক দেন ইভা। তালাক দিলেও সুজন তার সাবেক স্ত্রী ইভার বাড়ির আশপাশে যাওয়া-আসা করতো। সুজন ওই এলাকায় যাতায়াত করায় ক্ষিপ্ত হয় ইভার ভাই আরিফ, তার বন্ধু ফাইজুল ও ইভা। সুজনকে ওই এলাকায় যাওয়ার কারণে কয়েকবার মারধরও করেন তারা। তারপরও সুজন ওই এলাকায় যেতেন। ইভার সঙ্গে তার ভাইয়ের বন্ধু ফাইজুলের প্রেমের সম্পর্ক থাকায় ফাইজুলও চাইতেন না সুজন ওই এলাকায় যাক। এ কারণে সুজনকে হত্যা করা হতে পারে বলে তার বাবার সন্দেহ ছিল শুরু থেকেই। এজাহারেও তিনি এ বিষয়টি উল্লেখ করেছিলেন।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ সুজন হত্যার অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করলেও মামলার আসামি আসমা আক্তার ইভা, আরিফুল হক ওরফে আরিফ ও রানা ওরফে বাবু গ্রেফতার না হওয়ায় এবং তাদের পূর্ণাঙ্গ নাম ও ঠিকানা না পাওয়ায় তাদের অভিযোগপত্র থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এতে নাখোশ হয়ে অভিযোগপত্রের বিষয়ে না-রাজির আবেদন করেন সুজনের বাবা মামলার বাদী আব্দুল মান্নান।

আদালত পিবিআইকে মামলাটি তদন্তের নির্দেশ দেন। পিবিআই, ঢাকা মেট্রোর (উত্তর) এস আই মো. ফরিদ উদ্দিন মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করেন। পিবিআই’র গোয়েন্দা তথ্য ও আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জড়িত আসামিদের অবস্থান নিশ্চিত হয়। সুজনের হত্যাকাণ্ডে জড়িত অন্যতম আসামি মো. ফজলু ওরফে কুটি (৪২)-কে গত ১০ আগস্ট রাতে রাজধানীর মুগদার জান্নাতবাগ এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়।

এর আগে পিবিআই এই হত্যার সঙ্গে জড়িত আসামি আসমা আক্তার ইভা, মো. আরিফুল হক ওরফে আরিফ ও রানা ওরফে বাবুকে গ্রেফতার করে। তাদের মধ্যে আসামি মো. আরিফুল হক ওরফে আরিফ হত্যার ঘটনায় নিজের জড়িত থাকাসহ তার সহযোগী অন্য আসামিদের নাম উল্লেখ করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করে।

যেভাবে হত্যা করা হয় সুজনকে

গ্রেফতারকৃত আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে পিবিআই জানতে পারে, ২০০৮ সালে ভিকটিম সুজনের সঙ্গে ইভার বিয়ে হয় এবং ২০০৯ সালে ইভা সুজনকে ডিভোর্স দেন। কিন্তু ইভাকে খুবই ভালোবাসতেন সুজন। তালাক দেওয়ার পরও সুজন প্রায় সময় ইভাকে দেখার জন্য তাদের এলাকায় যাওয়া-আসা করতেন। এদিকে ইভার সঙ্গে সুজনের বিয়ে হওয়ার আগে থেকেই ফাইজুল নামে স্থানীয় এক তরুণ ইভাকে পছন্দ করতেন। ইভার বড় ভাই আরিফের সঙ্গে ফাইজুল বন্ধুর মতো চলাফেরা করতেন। ফাইজুল বিভিন্ন সময় ইভাদের বাসায় আসা-যাওয়া করতো। এটা নিয়ে ফাইজুল ও ইভার বড় ভাই আরিফের সঙ্গে সুজনের বিভিন্ন সময় তর্কবিতর্ক ও হাতাহাতি হয়। সুজন তখন ইভার ভাই আরিফকে চড়-থাপ্পড় দেন। এর ধারাবাহিকতায় হত্যাকাণ্ডের ৭/৮ দিন আগে সুজনকে মারধর করেন ফাইজুল। ২০১১ সালের ১৩ মার্চ সন্ধ্যার পর আরিফুল হক ও ফাইজুল তাদের বন্ধু কুটি ও কালা বাবুকে নিয়ে বাসার সামনের মাঠে বসে সুজনকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। এরপর পরিকল্পনা অনুযায়ী, ওই বছরের ১৪ মার্চ সন্ধ্যা সাতটার সময় আরিফ তাদের বাসার পাশের চায়ের দোকান থেকে একটি সাদা পলিথিন ব্যাগ নেন। ফাইজুল ও আরিফ লাঠি নিয়ে খালপাড় বালুর মাঠের দিকে যেতে থাকেন। এরইমধ্যে কুটিও চলে আসেন। তারা তিন জন একসঙ্গে খালপাড় বালুর মাঠে অপেক্ষার কিছুক্ষণের মধ্যেই কালা বাবুও চলে আসেন। রাত আনুমানিক ৮টায় কুটির সঙ্গে যোগাযোগ করে ভিকটিম সুজন খালপাড় বালুর মাঠে আসেন। বিভিন্ন কথাবার্তার একপর্যায়ে ফাইজুল পেছন থেকে সুজনের দুই হাত চেপে ধরেন। আরিফ পকেট থেকে পলিথিন বের করে কুটিকে দেন। কুটি পলিথিনের ব্যাগটি সুজনের মাথার ওপর থেকে গলা পর্যন্ত নামিয়ে পেঁচিয়ে গিট দিয়ে ফেলেন। একই সময়ে আরিফ লাঠি দিয়ে সুজনকে পেটাতে থাকেন। পরে কালা বাবু আরিফের হাত থেকে লাঠি নিয়ে সুজনকে পেটাতে থাকে। এর কিছুক্ষণ পরই সুজন মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। সুজন মারা গেছেন নিশ্চিত হয়ে তারা ধরাধরি করে লাশ পাশের খালে ফেলে দেন। কুটি ও কালা বাবু খালে নেমে সুজনের লাশ পানিতে ভাসিয়ে দেন। পরে তারা সবাই এলাকায় চলে আসেন।

পিবিআই কর্মকর্তা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ওসমান গণি বলেন, ‘সুজনের সাবেক স্ত্রীর ভাই আরিফ এই হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। এই হত্যার সঙ্গে জড়িত পাঁচ জনের মধ্যে চার জনকেই আমরা গ্রেফতার করেছি। একজন পলাতক রয়েছেন। তাকেও গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।’

হত্যার পর লাপাত্তা ইভার পরিবার

সবুজবাগের রাজারবাগ এলাকায় পরিবার নিয়ে থাকতেন মো. ইউনুস আলী। ওই এলাকায় একটি রিকশার গ্যারেজ ছিল তার। ইউনুস আলীর দুই ছেলে ও এক মেয়ে। আরিফ, বাবু ও ইভা। তাদের গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুরের নৈরা এলাকায়। তবে শরীয়তপুরের বাড়িঘর বিক্রি করে অনেক আগেই তারা ঢাকায় চলে আসেন। সুজনকে হত্যার পর পুরো পরিবার লাপাত্তা হয়ে যায়। পুলিশও তাদের খুঁজে পায়নি। স্থায়ী ঠিকানায় গিয়েও তাদের না পেয়ে ডিবি পুলিশ অভিযোগপত্র থেকে তাদের নাম স্থগিত রাখে।

সৌদি আরবে পালিয়ে যায় ইভা

সুজনকে হত্যার পর ইভা পালিয়ে শ্রমিক ভিসায় সৌদি আরবে চলে যান। সেখানে কুমিল্লার লাকসামের এক ছেলের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। পরে তারা বিয়েও করেন। ইভা তার স্বামীর বাড়ি লাকসামে থাকা শুরু করেন। পিবিআই লাকসাম থেকে ইভাকে গ্রেফতার করে। ঘটনার পর তার বাবা পরিবার নিয়ে নারায়ণগঞ্জে বসবাস শুরু করেন। নারায়ণগঞ্জ থেকে মামলার অন্যতম দুই আসামি ইভার ভাই বাবু ও আরিফকে গ্রেফতার করা হয়। এই মামলায় ফাইজুল, আলমগীর ওরফে কালা বাবু ওরফে কিলার বাবু ও কুটিকে গ্রেফতার করেছিল ডিবি। তাদের মধ্যে কুটি ও কালা বাবু জামিন নিয়ে সে সময় পালিয়ে যান। পিবিআই কুটিকে গ্রেফতার করতে পারলেও কালা বাবু এখনও পলাতক। তবে ইভার প্রেমিক ফাইজুল এ মামলায় নিয়মিত হাজিরা দিতেন।

সুজনের বাবার বক্তব্য

নিহত সুজনের বাবা আব্দুল মান্নান বলেন, ‘আমি এজাহারে ইভা, তার ভাই আরিফসহ চার জনের নাম উল্লেখ করেছিলাম। কিন্তু ঠিকানা না পাওয়ার অজুহাত দেখিয়ে অভিযোগপত্র থেকে তাদের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। যাদের নামে মামলা দিয়েছিলাম, ডিবি তাদের অভিযোগপত্র থেকে বাদ দিয়েছে। তারা অভিযোগপত্রে দাবি করেছেন, এদের ঠিকানা পাওয়া যায়নি। তবে পিবিআই তাদের ঠিকানা ঠিকই পেয়েছে।’

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

মফস্বল সাংবাদিক ফোরামের ১১০ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন

মফস্বল ও প্রান্তিক পর্যায়ে কর্মরত সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা, হামলা, হ...

মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনে স্বতন্ত্রসহ চারজনের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ

মুন্সীগঞ্জে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির মনোনীত প্রার্থীসহ চারজন প্রা...

নাসার চাঁদে অভিযানের দায়িত্বে স্পেসএক্স না ব্লু অরিজিন?

পরবর্তী চাঁদ অভিযান কর্মসূচিতে কোন প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করা হবে নাসার নতুন প্রশ...

নোয়াখালীতে বিএনপির কার্যালয়ে আ. লীগের হামলা, আহত ৪

নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়াতে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বিএনপির কার্যাল...

বাজারে কৃত্রিম সার সংকট সৃষ্টির অপরাধে ব্যবসায়ীকে জরিমানা

বাজারে কৃত্রিম সার সংকট সৃষ্টির অপরাধে কুষ্টিয়ার মিরপুরে এক ব্যবসায়ীকে জরিমান...

আলফাডাঙ্গা কলেজে পরীক্ষা চলাকালে অস্ত্র হাতে মহড়া, গ্রেপ্তার যুবক

ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা আদর্শ কলেজে স্নাতক সম্মান (ডিগ্রি) পরীক্ষা চলাকালে দেশীয়...

মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনে স্বতন্ত্রসহ চারজনের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ

মুন্সীগঞ্জে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির মনোনীত প্রার্থীসহ চারজন প্রা...

চাকসুর উদ্যোগে ইসলামী ব্যাংক–চবি’র কর্পোরেট চুক্তি

ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একটি কর্পোরেট...

সাড়ে ৩ ঘণ্টা পর ঝালকাঠিতে সড়ক অবরোধ প্রত্যাহার

ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলার সন্তান সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগঠন ‘ইনকিলাব ম...

বাজারে কৃত্রিম সার সংকট সৃষ্টির অপরাধে ব্যবসায়ীকে জরিমানা

বাজারে কৃত্রিম সার সংকট সৃষ্টির অপরাধে কুষ্টিয়ার মিরপুরে এক ব্যবসায়ীকে জরিমান...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা