মো. নাজির হোসেন, মুন্সীগঞ্জ: গত ৭ দিনে বিক্রি করার মতো ১০ টাকার মাছও ধরা পড়েনি বড়শিতে। তবু দিনের পর দিন বড়শি ফেলেই যাচ্ছেন নদীতে। কিন্তু ধরা পড়ে না মাছ।
আরও পড়ুন: রিসোর্টের খাবার খেয়ে অসুস্থ ৩ শতাধিক
মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার রসুলপুর গ্রাম সংলগ্ন ফুলদী নদীতে এমনই মাছের আকাল চলছে। আর এ নদীতে নৌকায় বসবাসরত বেদে সম্প্রদায়ের আয় রোজগার নেই বললেই চলে। ওই নদীতে অন্তত ১৭ টি বেঁদে পরিবার বসবাস করে আসছে। অগত্যা বেদে সম্প্রদায়ের লোকজন ফুলদী ছেড়ে যাচ্ছেন। তাদের গন্তব্য এখন পদ্মা নদী।
বেঁদে মো. শাকিল (৩৫) ফুলদী মাছের অভাবে জীবিকার তাগিদ পদ্মা নদীতে মাছ ধরার প্রস্তুতি নিচ্ছে। যদিও আসছে সময় পদ্মায় ঝড় তুফানের ভয় থাকে। তারপরেও জীবন- জীবিকার তাগিদে বেঁচে থাকার জন্য যেতে হবে তাকে। নিজ জীবনের ঝুঁকি থাকলেও তা তিনি মোটেও পরোয়া করেন না তবে ভয় শুধু চার বছরের মেয়ে সুহানাকে নিয়ে।
স্ত্রী নুরজাহান আর একমাত্র মেয়ে সোহানাকে নিয়ে নৌকায় বসবাস করেন বেঁদে শাকিল। স্বামী-স্ত্রী মিলে বড়শি দিয়ে মাছ ধরে যা আয় হয়। তা দিয়ে চলে তাদের সংসার। সারা বছর যেখানে মাছ বেশি পাওয়া যায় সেখানেই নৌকা নিয়ে ছুটে তারা। মাছ ধরে করেন জীবিকা নির্বাহ।
শাকিলের জন্ম নারায়ণগঞ্জের বন্দরের শীতলক্ষ্যা নদীতে। ছোটবেলা পিতা-মাতার সাথে মাছ ধরে নদীতে নদীতে ঘুরে জীবন কাটে তার। বাবা মারা গেছে ১০ বছর আগে। চার বোনের মধ্যে তিন বোনের বিয়ে হয়েছে। তারা বিভিন্ন স্থানে স্বামীর সাথে মাছ ধরেই জীবিকা নির্বাহ করেন। মায়ের সাথে আছে ছোট বোন। তারা আলাদাভাবে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। তবে মুঠোফোনের কল্যাণে শাকিলদের সাথে নিয়মিত এখন পরিবারের যোগাযোগ রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে। আগে ছোটবেলায় বিচ্ছিন্ন হয়েই জীবন কাটত তাদের।
রসুলপুর গ্রামের নদীতে সরেজমিনে বেশ কিছু বেদে পরিবারকে বসবাস করতে দেখা যায় নৌকার মধ্যে। এদের মধ্যে অনেকেই এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করলেও অনেকে আবার ছুটে আসেন যে মৌসুমে ভালো মাছ পাওয়া যায়। শুধু সেই মৌসুমে বড়শি দিয়ে মাছ ধরার জন্য এখানে। চার মাস আগে ফুলদি নদীতে মাছ ভালো পাওয়ার খবর শুনে নারায়ণগঞ্জের বন্দর হতে ছুটে এসেছিলেন শাকিল এখানে।
আরও পড়ুন: সিলিন্ডার বিস্ফোরণে মা-মেয়ে দগ্ধ
কিন্তু গত ৭ দিন হয় এখানে একেবারেই মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন গহীন পদ্মার শরীয়তপুর জেলার সুরেশ্বর এলাকায় যাওয়ার। পুরনো নৌকার ছই মেরামত কাজে লেগে গেছেন তিনি। আর তাকে এ কাজে সহায়তা করছেন তার চার বছরের একমাত্র মেয়ে সোহানা।
শাকিল বলেন, গত দুই দিনে যাবত বাঁশ দিয়ে নৌকার চাল তৈরি করছেন। বাঁশের উপর বিছাতে হবে ছই (ছাঁদ)। তারপরে নৌকাকে মালামত করতে হবে। অর্থাৎ আলকাতরা দিতে হবে। এ কাজে সময় লেগে যাবে প্রায় সাত দিন। নৌকার ছাওনি ও মালামতে খরচ হবে প্রায় পাঁচ হাজার টাকা।
তারপর পাড়ি দিবেন গজারিয়া ফুলদি নদী হতে স্ত্রী-মেয়েকে নিয়ে পদ্মার ওপারে শরীয়তপুর জেলার সুরেশ্বর এলাকায়। পদ্মা নদীতে যদি স্রোত এবং ঢেউ কম থাকে তাহলে একদিন পার হয়ে যাবেন নদী। আর যদি ঢেউ স্রোত বেশি থাকে তাহলে পার হতে ২-৩ দিন লেগে যাবে তার। এ পার হতে ওপারের পদ্মা পর্যন্ত পৌঁছাতে অনেকগুলো চর পড়ে স্রোত বেশি থাকলে চরের মধ্যেই কোন এক জায়গায় নৌকা থামিয়ে বিশ্রাম নিবেন তিনি। তারপর বাতাসের গতিবেগ যে সময় কম থাকে সেই সময় বুঝে পাড়ি দিবেন বড় পদ্মা নদী।
শাকিল বলেন, জিনিসের দাম দিন দিন বেড়েই চলছে। আর নদীতে মাছ দিন দিন কমছে। তাই আমাদের জীবন অনেক কঠিন হয়ে পরছে। এখন বেঁচে থাকাটা অনেক কষ্ট। তাই আমার একমাত্র মেয়েকে আর এ পেশায় আনতে চাই না । ওকে কোন একটি স্কুলে ভর্তি করে দিব। এখন ওর বয়স চার বছর, পাঁচ বছর হলেই স্কুলে ভর্তি করে দিতে চাই।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে একটি বড় নৌকা বানাতে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা খরচ হয় কিন্তু আমাদের উপার্জন এখন একে বারেই কম।
শাকিলের স্ত্রীর নুরজাহান আক্তার বলেন, স্বামী স্ত্রী মিলে মাছ ধরে যা আয় হয় তা দিয়ে চলে সংসার। আমরা মাছ ধরা ছাড়া অন্য কাজ করি না। অন্য বেঁদেরা সাপ খেলা দেখায় কিন্তু আমরা নিজেরাই সাপ দেখলে ভয় পাই। নৌকাতে বসবাস করি। ছোট মেয়েটাকে নিয়ে খুব ভয়ে থাকতাম কখন পানিতে পড়ে যায়। এখন সুহানা সাঁতার শিখছে তাই ভয়টা এখন একটু কম।
ওই স্থানে বসবাস করা হেনা বেগম (৬০) বলেন, ৫০ বছর ধরে এখানে বসবাস করছি। আগে এখানে ভালো মাছ পাওয়া যেত। কিন্তু নদীর পানি ককে যাওয়াতে, এখানে এখন মাছ নাই। তাই চিন্তা করতেছি বাধ্য হয়ে এখান থেকে চলে যেতে হবে। জায়গাটাই অনেক দিন ধরে থাকি কেমন মায়া জন্মায় গেছে। তারপরেও না খেয়ে তো আর মরতে পারবো না। দেখি যেখানে ভালো মাছ পাওয়া যায় সেখানে চলে যাব।
তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন সময়ে অনেক মানুষই আসেন আমাদের সুখ দুঃখের কথা শুনে ভিডিও করে নিয়ে যান। কিন্তু আমরা কোন সহায়তা পাই না। কত মানুষ আইলো গেল কত কিছু বললাম নিয়ে গেল কিন্তু আমাদের তো কোন উপকারই হইল না।
বেদে বাদল মিয়া (৭০) বলেন, ছোটবেলা হতেই বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে মাছ ধরি। আজ ৬০ বছর হয় মাছ ধরে এই জীবন কাটাইতাছি। আগে খালে বিলে প্রচুর মাছ পাওয়া যাইত। এখন অনেক খাল বিল নদী শুকাইয়া গেছে। মানুষ অনেক খাল বিল ভরাট করে ফেলছে। নদীতে মাছ নেই বললেই চলে। তাই আমাদের খুব কষ্ট করে এ পেশায় টিকে থাকতে হচ্ছে।
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জিয়াউল ইসলাম চৌধুরী বলেন, তারা সমস্যায় আছে। আমাদের সাথে যোগাযোগ না করলে আমরা কিভাবে বুঝব তারা সমস্যায় আছে। তারপরও যখন শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয়, আমি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সবার আগে বেদে দিয়ে থাকি।
সান নিউজ/এনকে