পাঠাগার নিয়েই স্বপ্ন ‘জ্ঞানের ফেরিওয়ালা’ সুনীল কুমার গাঙ্গুলীর
সারাদেশ

‘জ্ঞানের ফেরিওয়ালা’ সুনীল কুমার গাঙ্গুলী

বনিক কুমার, গোপালগঞ্জ থেকে :

আর দশটা পাঠাগারের চেয়ে এই পাঠাগারটি একটু ব্যতিক্রম। এখানে কোনো চেয়ার-টেবিল কিংবা পাঠক সমাগমও নেই। সুনীল কুমার গাঙ্গুলী তার বইয়ের তালিকা নিয়ে পাঠকদের দ্বারে দ্বারে ছুটে যান। যে পাঠকের যে বইটি পছন্দ হয়, পরের দিন ওই পাঠকের কাছে বইটি দিয়ে আসেন তিনি। আবার ওই ব্যক্তির পড়া শেষ হলে গিয়ে বইটি নিয়ে আসেন। বিনিময়ে কারো কাছ থেকে কোন টাকা পয়সা নেন না। যদি কেউ খুশি হয়ে পাঁচ-দশ টাকা দেন, তা জমিয়ে পাঠাগারের নতুন বই কেনেন।

গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার কুমরিয়া গ্রামের চন্দ্রিকা জ্ঞান পাঠাগার আর এর প্রতিষ্ঠাতা সুনীল কুমার গাঙ্গুলীর কথা এখন সহস্রাধিক নিয়মিত পাঠকসহ এলাকার লোকজনের মুখে মুখেন। ভালোবেসে অবসরপ্রাপ্ত এই প্রাথমিক শিক্ষককে সবাই বলেন, ‘জ্ঞানের ফেরিওয়ালা’।

তবে করোনার কারণে বর্তমানে সুনীল কুমার গাঙ্গুলী পাঠকের হাতে বই পৌছে দিতে না পেরে মন খারাপ করে বাড়িতে সময় কাটাচ্ছেন। মোবাইল ফোনে তিনি বলেন, ‘শিক্ষকতা থেকে অবসরে যাওয়ার পর থেকে মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বই দিয়ে আসছিলাম। তারা বই পড়ে জ্ঞান অর্জন করছেন, এটা ভেবেই আমার আনন্দ। কিন্তু করোনার কারণে ঘরবন্দি হয়ে মন বসছে না। সময় কাটে বই পড়ে আর ঘুমিয়ে, বাইরে না যেতে পেরে মাঝে মধ্যে খারাপ লাগে। মনে হয়, রিকশা নিয়ে পাঠকের কাছে বই পৌছে দেই। কিন্তু পরিবারের কারণে হয়ে উঠছে না। দেশের এই মহামারী শেষ হলেই আবারও পাঠকের দোরগড়ায় ছুটে যাবো। ’

আর্থিক সংকটে বেশিদূর পড়ালেখা করতে পারেননি জ্ঞানের এই ফেরিওয়ালা। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগ দিয়ে সংসারের হাল ধরেন। উপজেলা সদর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটানা ২৫ বছর শিক্ষকতা করে অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রীর মাঝে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিয়েছেন। সত্তরোর্ধ্ব জীবনের প্রায় অর্ধেকটা সময় অন্যের ছেলেমেয়েকে মানুষ করার ব্রত পালন করেছেন। ২০১৪ সালে অবসর নেওয়ার পর নিজ বাড়ির পাশে একক প্রচেষ্টায় পুত্রবধূর নামে গড়ে তোলেন ‘চন্দ্রিকা জ্ঞান পাঠাগার’। নতুন প্রজন্মের মাঝে নিজের অর্জিত ও চর্চিত জ্ঞান ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে ছুটে বেড়াতে শুরু করেন এ গ্রাম থেকে সে গ্রাম। পেনশনের টাকা সংসারে খরচ না করে সেই টাকায় নতুন নতুন বই কিনে তুলে দেন পাঠকদের কাছে।

চন্দ্রিকা জ্ঞান পাঠাগারের বইয়ের সংখ্যা ছয় শতাধিক। এতো সামান্য বইয়ে মন ভরে না সুনীল গাঙ্গুলীর। তার আন্তরিক ইচ্ছা, পাঠাগারটি আরও বই দিয়ে সমৃদ্ধ করবেন। কিন্তু আর্থিক সংকটে সেটি পারছেন না বলে আক্ষেপ জ্ঞানের এই ফেরিওয়ালার। তেমন কোনো আসবাবপত্র না থাকায় অনেক মূল্যবান বই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তারপরও প্রতিদিনই ঝেড়ে মুছে নিজের সন্তানের মতো বইগুলো আগলে রাখেন সুনীল কুমার গাঙ্গুলী।

পাঠাগারটির নাম কেন পুত্রবধূর নামে রাখলেন? জবাবে সুনীল বলেন, ‘সাত বছর আগে আমার একমাত্র ছেলেকে বিয়ে দিয়েছি। ছেলের বউ প্রথম থেকেই আমাকে মায়ের মতো করে সেবা-শুশ্রুষা করেন। আমি তো আর বেশিদিন বাঁচবো না। আমি মারা গেলে আমার নাতি যেন তার মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে পাঠাগারটি আগলে রাখে, সেজন্যই এই নাম দেওয়া।’

কোটালীপাড়ার বীণাপাণি গ্রন্থাগারের প্রতিষ্ঠাতা সাংবাদিক প্রশান্ত অধিকারী বলেন, ‘আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের প্রতিষ্ঠিত বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র গাড়িতে করে পাঠকের কাছে বই পৌঁছে দেয়। আর আমাদের কোটালীপাড়ার ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি হলেন সুনীল কুমার গাঙ্গুলী। প্রত্যন্ত গ্রামে থেকেও হেঁটে হেঁটে পাঠকের কাছে হাসিমুখে বই পৌঁছে দিচ্ছেন সত্তরোর্ধ্ব জ্ঞানের এই ফেরিওয়ালা। করোনার কারণে প্রায় দুই মাস বই পাচ্ছি না। স্যার বৃদ্ধ মানুষ, তাই আমরা তাকে আসতে নিষেধ করেছি।’

চন্দ্রিকা জ্ঞান পাঠাগারের নিয়মিত পাঠক উপজেলার ঘাঘর বাজারের হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক প্রেমরঞ্জন মণ্ডল বলেন, ‘আমি পাঁচ বছর ধরে চন্দ্রিকা জ্ঞান পাঠাগারের নিয়মিত পাঠক। কোটালীপাড়া সদর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূর থেকে এসে সুনীল কুমার গাঙ্গুলী আমাকে বই দিয়ে যান। বই পড়া শেষ হলে আবার নতুন একটি বই দিয়ে পুরোনো বইটি নিয়ে যান। বিনিময়ে তিনি কোনো টাকা-পয়সা নেন না। বর্তমানে তার মতো ব্যক্তি সমাজে বিরল। কিন্তু করোনার কারণে মাস দুয়েক হলো তিনি কম আসছেন। আমরাও আসতে নিষেধ করেছি।’

সুনীল কুমার গাঙ্গুলীর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র ঘাঘরকান্দা গ্রামের রাজীব শেখ বলেন, ‘স্যার আমাদের ক্লাসে পড়ালেখার বাইরেও নৈতিক শিক্ষা দিতেন। একদিন স্কুলে না গেলে পরের দিন বাড়িতে গিয়ে আমাদের খোঁজ খবর নিতেন। বাড়িতে এসে বাবা-মাকে জিজ্ঞেস করতেন, আমি অসুস্থ কি-না। তা না হলে জানতে চাইতেন, আমি স্কুলে গেলাম না কেন? তার মতো শিক্ষক পেয়ে ছাত্র হিসেবে আমি গর্বিত।’

সুনীল কুমার গাঙ্গুলী বলেন, ছাত্রজীবনে আমার বই পড়ার খুব আগ্রহ ছিল। কিন্তু, তখন অর্থকষ্টে বই কিনে পড়তে পারিনি। তখনই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, কখনও যদি সুযোগ আসে, তাহলে পাঠাগার গড়বো। শিক্ষকতা জীবনে সে স্বপ্ন পূরণ করতে পারিনি, অবসরে চেষ্টা করে যাচ্ছি। কিন্তু এখনো পর্যাপ্ত বই সংগ্রহ করতে পারিনি। পাঠাগারে বই ও আর্থিক সহযোগিতা চেয়ে বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে আবেদন করেছি। এখনও কেউ সহযোগিতার হাত বাড়াননি। আমি চাই, এলাকার যারা বিত্তবান আছেন, তারা পাঠাগারটির উন্নয়নে এগিয়ে আসুন। এটি নিয়েই আমার এখন সব স্বপ্ন। মৃত্যুর পরে এই পাঠাগার ও পাঠকের মাঝে বেঁচে থাকতে চাই।’

কোটালীপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘বর্তমান সময়ে সুনীল কুমার গাঙ্গুলীর কার্যক্রম নিঃসন্দেহে প্রশংসার যোগ্য। আমি তার সঙ্গে কথা বলেছি। করোনার কারণে কার্যক্রম স্থগিত রাখতে বলা হয়েছে। ব্যক্তিগত ও সরকারিভাবে চন্দ্রিকা জ্ঞান পাঠাগারে বই সরবরাহ থেকে শুরু করে সব ধরনের সহযোগিতার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কিন্তু করোনার কারণে বিলম্বিত হচ্ছে।’

সান নিউজ/ এআর

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

রাজধানীতে স্বস্তির বৃষ্টি

নিজস্ব প্রতিবেদক: টানা একমাস দাবদ...

মিল্টন সমাদ্দার রিমান্ডে

নিজস্ব প্রতিবেদক: মৃত্যুর জাল সনদ তৈরির অভিযোগে প্রতারণা ও জ...

লিওনার্দো দা ভিঞ্চি’র প্রয়াণ

সান নিউজ ডেস্ক: আজকের ঘটনা কাল অতীত। প্রত্যেকটি অতীত সময়ের স...

আমিরাতে প্রবল বৃষ্টিপাত, সতর্কতা জারি

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: প্রবল বৃষ্টিপা...

ভরিতে ১৮৭৮ টাকা কমলো স্বর্ণের দাম 

নিজস্ব প্রতিবেদক: টানা অষ্টমবারের...

নদীতে গোসলে নেমে প্রাণ হারাল শিশু

জেলা প্রতিনিধি: গাজীপুরে শীতলক্ষ্যা নদীতে গোসলে নেমে মো. ইফা...

বাংলাদেশি জেলেদের ছেড়ে দিল আরাকান আর্মি

জেলা প্রতিনিধি: কক্সবাজার জেলার উ...

যে ৬ অঞ্চলে ঝড় বইতে পারে

নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশের ৬ অঞ্চলের ওপর দিয়ে ৬০ কি.মি বেগে ঝড়ে...

মাদকবিরোধী অভিযানে গ্রেফতার ২৯

নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় মাদকবিরোধী অভিযান...

ইসরায়েলের সঙ্গে বাণিজ্য বন্ধ করলো তুরস্ক

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: তুরস্কের বাণিজ্যমন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গাজা...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা