নিজস্ব প্রতিনিধি, পিরোজপুর : এহ্সান গ্রুপ নামে একটি সমবায় সমিতি অস্বাভাবিক মুনাফার লোভ দেখিয়ে পিরোজপুরে ১০ হাজার বেশি মানুষের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা আমানত সংগ্রহ করে পালিয়েছে। আর প্রতিদিন আমানতকারীরা তাদের নিজেদের টাকা ফেরত পাবার জন্য তথাকথিত এহসান গ্রুপের অফিস ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ভিড় জমাচ্ছে।
জালিয়াতি চক্রের মূলহোতা ও এহসান গ্রুপের কর্ণধার মুফতি রাগীব আহসান এহ্সান পালিয়ে থাকার কারণে বিনিয়োগকৃত অর্থ হারানোর শঙ্কায় আছেন আমানতকারীরা। আর যারা প্রতিষ্ঠানটিতে এখনও রয়েছেন তাদের টালবাহানা দেখে গ্রহকরা ছুটছে প্রশাসনের দ্বারে দ্বারে।
ভুক্তভোগীরা জানান, পিরোজপুর জেলা শহর ও সন্নিহিত কয়েকটি জেলার মধ্যবিত্ত ও নিম্নআয়ের মানুষের কাছ থেকে ৭-৮ বছর ধরে প্রায় কোটি কোটি টাকা আমানত সংগ্রহ করে। ব্যাংকের মতোই ফিক্সড ডিপোজিট এবং ডিপিএস পদ্ধতিতে মানুষকে বড়ো অঙ্কের মুনাফার লোভ দিয়ে টাকা রাখতে উৎসাহ দেয়।
লোকজনও লোভের বলি হয়ে সেই ফাঁদে পা দেয়। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য প্রতি ১ লাখ টাকা বিনিয়োগে মাসিক ২ হাজার টাকা মুনাফার প্রলোভন দেয়। যা দেশের সরকারি বেসরকারি কোনও ব্যাংক কিংবা আর্থিক প্রতিষ্ঠান দিতে পারে না।
২০১০ সাল থেকে পিরোজপুর জেলা সদরের খলিশাখালী এলাকার আব্দুর রব খানের বড় ছেলে মুফতি রাগীব আহসান এহ্সান রিয়েল এস্টেট নামীয় একটি এমএলএম কোম্পানি শুরু করে যা সমবায় সমিতির মাধ্যমে নিবন্ধন করা হয়েছিল। যা পরবর্তীতে এহ্সান গ্রুপ পিরোজপুর বাংলাদেশ নামে পরিচিতি পায়। এর অধীনে রাগীব গড়ে তোলে ১৭টি প্রতিষ্ঠান।
ইসলামী শরীয়াহ মোতাবেক প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে বিভিন্নভাবে শুরু করে টাকা সংগ্রহ। এ প্রতারনা চক্রের মূল হোতা রাগীব এর আগে একটি এমএলএম কোম্পানিতে চাকরি করতেন। তাছাড়া একটি মসজিদে নামমাত্র বেতনে ইমামতি করা রাগীব ইসলাম ধর্মের ভুল অপব্যাখ্যার মাধ্যমে এ অঞ্চলের সরল-সহজ ধর্মপ্রাণ মানুষদের তার এই ভুইফোঁড় কোম্পানিতে বিনিয়োগ করতে উদ্বুদ্ধ করতেন, আয়োজন করতেন ওয়াজ মাফিল ও বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানের।
পিরোজপুর শহরের শেরে বাংলা পাবলিক লাইব্রেরী মার্কেটের শপিং কমপ্লেক্সের প্রধান অফিস ও বাইপাস সড়কে শাখা অফিস বসিয়ে এ ব্যবসা চালানো হচ্ছে। এহ্সান গ্রুপের সঞ্চয় ও ঋণদান, ক্যাডেট একাডেমি, কোটি কোটি টাকার রিয়েল এস্টেট ব্যবসা, গার্মেন্টস ও প্রসাধনী ব্যবসা, স্যানিটারী ও হার্ডওয়ার ব্যবসা, মহিলা মাদ্রাসা, ইসলামি রিসার্স সেন্টার ইত্যাদি নামে ১৭টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যার ৮টি এই আমানতের টাকায় পরিচালিত হয়। তবে অভিযোগ উঠেছে, এগুলোর অধিকাংশই কাগজে-কলমে।
শুরুর পর কয়েক বছর ঠিকমত গ্রাহকদের সাথে লেনদেন স্বাভাবিক রাখলেও, প্রায় ২ বছর ধরে গ্রাহকদের টাকা পরিশোধে টালবাহনা শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। পাশাপাশি তাদের অফিসের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। আত্মগোপনে চলে যায় রাগীবসহ প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা। আর গ্রাহকরা ঘুরতে থাকেন তাদের দ্বারে দ্বারে।
পিরোজপুর শহরের মাছিমপুর এলাকার বাসিন্দা মো. রফিকুল আলম জানান, দেড় বছর আগে মাসে ২ হাজার টাকা মুনাফা দেওয়ার শর্তে ৩ লাখ টাকা এ আমানত রাখেন। এখন সে আমানতের অর্থ ফেরত দিচ্ছে না এহসান গ্রুপ।
কৃষ্ণনগর এলাকার বাসিন্দা রহুল আমীন জানান, ৫ মাস ধরে কোনও মুনাফা দেওয়া হচ্ছে না। শহরের সিও অফিস এলাকার বাসিন্দা মনসুর আলী শেখ ও তার বোন রওশন আরা বেগম ২০ লাখ টাকা আমানত রেখেছেন। বতর্মানে তাদেরও কোনও মুনাফা দেওয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন তারা। এ ব্যাপারে জানতে চেয়ে প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার মুফতি রাগীব আহ্সানের সাথে একটি মাধ্যমে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, মিডিয়াতে এনিয়ে কোনও কথা বলবেন না তিনি ।
তবে ঐ প্রতিষ্ঠানের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মচারী জানান, একটি চেক ডিজ-অনারের মামলায় ঢাকায় তার কয়েক দিন হাজতবাসের কথা মিডিয়া ও ফেসবুকে ভাইরাল হয়। যার ফলে সমিতির সদস্যরা আমানত হারানোর আশঙ্কায় গ্রুপের শাখা অফিসে ভিড় করছেন। তবে তাদের আতঙ্কিত হবার কিছু নেই। অচিরেই এগুলো চালু হবে। আমানত ফেরত দেওয়া শুরু হয়েছে।
পিরোজপুর উপজেলা সমবায় অফিসার মো. মজিবুল জানান, গ্রাহকদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহে অনিয়ম ধরা পড়েছে, আমরা এনিয়ে কাজ করছি। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে, আশা করছি খুব শীঘ্রই এর সমাধান পাওয়া যাবে ।
পিরোজপুরের জেলা প্রশাসক আবু আলী মো. সাজ্জাদ হোসেন জানান, প্রতিষ্ঠানটির অনিয়ম নিয়ে আমাদের কাছে অভিযোগ আসার পরে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেটকে প্রধান করে একটা কমিটি করা হয়েছে। সে কমিটিতে পিরোজপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি ও উপজেলা সমবায় অফিসার সদস্য আছেন। আমনতকারীরা যেন তাদের প্রাপ্ত অর্থ ফেরত পান সেই লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি । আর এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে সাধারণ জনগণ যেন আর্থিক লেনদেন না করেন সেজন্য আহবান জানাচ্ছি।
সান নিউজ/কুমার শুভ রায়/এসএ