ছবি: সংগৃহীত
মতামত

ধেয়ে আসছে ‘অনলাইন জুয়া’

খন্দকার হাসনাত করিম: মোবাইল ফোন এখন নিঃসন্দেহে একটি অপরিহার্য জীবনসঙ্গী। শুধুই কি ফোনালাপ কিংবা ক্ষুদে বার্তা পাঠানো?

আরও পড়ুন: শিশুদের জন্য প্রয়োজন বাড়তি সতর্কতা

মোবাইল এখন ব্যাংকিং টুলস, বিল পরিশোধ, জমির খাজনা, আয়কর রিটার্ন, ভ্যাট প্রদান থেকে শুরু করে প্রায় সব ধরনের বাহন। শুধু তাই-ই নয়। মোবাইল এখন পরিচিতি কোড।

যে অফিসেই যাবেন, যেখানেই লেনদেন করবেন ওই ১১ সংখ্যার মোবাইল নম্বরটিই আপনার আইডেনটিটি। মোবাইলে পাওয়া যাচ্ছে বিনোদন। তবে এই মোবাইল সহজলভ্য ও নিখরচা বিনোদনের সঙ্গী হয়েছে এমন কিছু ‘কনটেন্ট’ যা তরুণ-কিশোর যুবসমাজকে আদর্শ জীবন থেকে চুম্বকের মতো টেনে ধরছে বিকার-বিকৃতি, পশুত্ব এবং অশ্লীল, নীল, সর্বনাশা পথে।

আরও পড়ুন: একজন প্রবাসীর জীবন

বিকার যখন সহজলভ্য, সুস্থ জীবনাদর্শ তখন পরাজিত হতে বাধ্য। কোনো মতে একটি স্মার্ট ফোন কিনে এমবি ঢুকিয়ে মানুষ সহজ ও নিখরচায় নাগাল পাচ্ছে ‘নীল জগতে’ ঢোকার। এগুলোর সাথেও আমরা কম-বেশি পরিচিত।

তবে সর্বনাশের শেষ পর্বটিও এখন মানুষের আঙুলের নাগালে। সেটি হলো অনলাইন গেমস এবং অনলাইন জুয়া। অনলাইন গেমসের আসক্তি নবীন প্রজন্মকে এমন সব কল্পজগতে নিয়ে যাচ্ছে যেখানে হত্যা এবং রক্তারক্তি ছাড়া আর কিছুই নেই।

আরও পড়ুন: শিক্ষকের কাজ জ্ঞান ছড়ানো, ঘৃণা নয়

অনলাইন গেমস থেকে তরুণ-কিশোরেরা অসহিষ্ণু, কলহপ্রিয়, বিবাদপ্রেমী এবং হত্যার খেলায় আসক্ত হয়ে পড়ছে। বহু কচি প্রাণ ইতোমধ্যে ঝরেও গেছে। নেশাদ্রব্যে ঘায়েল হয় মানুষের স্নায়ু এবং মানস প্রক্রিয়া আর এখন যে হারে অনলাইন জুয়ার মাদকতা শুরু হয়েছে, তাতে বহু পরিবার উচ্ছন্নে যেতে বসেছে।

অনলাইন জুয়ার ফাঁদে পড়ে দিনে দিনে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে বহু মেধাবী ছেলেমেয়ে। ওই জুয়ার ‘স্টেক’ ধরার টাকা জোগাড় করতে গিয়ে কেউ বাবার পকেট কাটছে, কেউ মায়ের গহনা ধরে টান দিচ্ছে; কেউ আবার চুরি-ডাকাতি-ছিনতাইয়ের পথ ধরছে। একটি অপকর্মে উৎসমুখে জড়ো হচ্ছে আরো বহু অনাচার ও অপকর্ম। সত্যিই এক ভয়ঙ্কর নেশা এই অনলাইন জুয়া। এ যে কী ভয়ঙ্কর নেশা, বলে বোঝানো যাবে না।

আরও পড়ুন: বৃক্ষনিধন নয় বৃক্ষরোপণই জরুরি

যে নেশা দেশের তরুণ প্রজন্মের একটি বিপথগামী অংশকে নৈতিক অবক্ষয়ের অতল গহ্বরে নিয়ে যেতে পারে, সেই নেশার দংশন জাত সাপের দংশনের চেয়েও বিষবান কি না তা ভুক্তভোগী সংসারগুলোই ভালো বলতে পারবে। মাদকের চেয়েও ভয়াবহ এই অনলাইন জুয়ার নেশার লাগাম টেনে ধরতে সরকারকেই সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে। এই সর্বনাশা অনলাইন জুয়ার নেশার বিরুদ্ধে বিপন্ন পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে।

যেকোনো মূল্যে যেকোনো উপায়ে তরুণ-কিশোরদের রক্ষা করতে হবে মোবাইল অ্যাপসে সংক্রমিত এসব জুয়ার আগ্রাসন থেকে। ‘ক্যাসিনোর’ জুয়ার ফাঁদের চেয়েও ভয়ঙ্কর এসব অনলাইন ‘ডিজিটাল’ আসর। এসব অনলাইন জুয়ার মধ্যে রয়েছে ‘ওয়ান এক্স বেইট’, ‘বেট উইনার’, ‘চরকার’ মতো আসর। এগুলোর দ্রুত বিস্তার সমাজদেহে ছড়িয়ে পড়ছে ‘ক্যান্সার’-এর চেয়েও দ্রুত প্রসারমান ম্যালিগন্যান্সির মতো। (কিংবা তার চেয়েও দ্রুত সম্প্রসারমান এই ঘাতক ব্যাধি)।

আরও পড়ুন: বিষাক্ত সমাজ এবং আপনি নিজেই দায়ী

বিপথগামী কিশোর-তরুণরা অনলাইন গেমস থেকে ঘটিয়েছে অনলাইন জুয়ার। সর্বনাশা বিষয়টি হলো- এসব জুয়া সমাজে এমনভাবে বিস্তৃতি লাভ করছে যে, মোবাইল ফোনের সিমকার্ডে আগাম বিল (ফ্লেক্সিলোডের) মতো এখন এসব অনলাইন জুয়ার অ্যাপসে টাকা ভরার জন্য শহর থেকে মফস্বলে রীতিমতো ‘এজেন্ট’ নিয়োগ করা হচ্ছে। খেলার প্রতিযোগিতার মতো তরুণ-কিশোররা এসব অনলাইন জুয়ায় ভয়াবহ মাত্রায় জড়িয়ে পড়ছে।

এসব জুয়ায় জেতে খুব নগণ্য সংখ্যকই; হারেই বেশি মানুষ। এসব অনলাইন জুয়া যারা ‘হোস্ট’ করে, ক্যাসিনোর মতো তাদেরও টার্গেট থাকে কিভাবে মানুষের টাকা হাতানো যায়। কদাচিত হয়তো কেউ সামান্য কিছু জেতে, যা এসব কোম্পানির বিনিয়োগের বড়জোর ৫ শতাংশ। বাকি ৯৫ শতাংশ অংশগ্রহণকারী আশায় আশায় বেট ধরে এবং হারতে হারতে সর্বস্বান্ত হয়। জুয়ার যা নিয়ম!

আরও পড়ুন: নারী উদ্যোক্তা : বাজেট কতটা ইতিবাচক?

এই একই কাজ করছে অনলাইন ‘স্ক্যামাররা’। স্ক্যামিং হলো এক ধরনের ডিজিটাল প্রতারণা। এরা বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে আপত্তিকর ও অশ্লীল কনটেন্ট চুরি করে কিংবা কিনে নেয়। এরপর বিদেশীদের ওয়েবসাইটে তাদের পরিচয় গোপন করে প্রবেশ করে এবং যা ইচ্ছা তাই ‘পোস্ট’ করে। এগুলোর সাথে সত্য এবং বাস্তবতার কোনো সম্পর্ক নেই।

তারা ওই সব অপকর্মে জড়িত হওয়ার প্রলোভন দেখায় গ্রাহককে ও প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়ে যারাই এসব অফারে ‘নক’ করে তারাই বন্দী হয়ে পড়ে ‘ডিজিটাল ক্রাইম নেটওয়ার্কে’। গ্রাহকও ডলার বা ইউরো ছাড়তে থাকে। কারণ লোভ তো অসীম ও অনিবারণযোগ্য। এই সুযোগকেই কাজে লাগায় স্ক্যামাররা।

আরও পড়ুন: সংস্কারমুখী বাজেট বাস্তবায়নে প্রয়োজন সুসমন্বয়

যে তরুণরা জুয়ায় হারতে হারতে সর্বস্বান্ত হয়ে গেছে তারা নিজেরাই শুধু ক্ষতি ও দুর্ভোগে পড়ছে না, তাদের পরিবার পরিজনকেও মারাত্মক সঙ্কটে ফেলছে। তারা বন্ধু হারাচ্ছে, লেখাপড়ায় বিচ্যুতি ঘটছে, মেধা যা ছিল জুয়ার প্রতিযোগিতায় ক্ষয়ে গেছে; এলাকায় তাদের মুখ দেখানোরই উপায় নেই। হতাশা থেকেই এদের অনেকে ধরছে মাদকের বিষ। ভাবছে এতে হয়তো দুঃখ ভুলে থাকা যাবে। কচু হচ্ছে।

মাদকের ঘোর কেটে গেলেই দুশ্চিন্তা ও গ্লান্তি এসে ভর করছে তাদের দেহ-মনে। অপমানের আত্মদংশন অত্যন্ত বিষক্রিয়াসম্পন্ন। সরকার বা সমাজ ডিজিটাল জুয়ার ভাণ্ডারীদের কিছুই করতে পারছে না। পারার কথাও নয়। কারণ এসব সাইট বিদেশে বসেই পরিচালিত হয়। স্থানীয় ভেন্ডররা কেবল টাকা গ্রহণ ও এন্ট্রি করার ক্ষমতা রাখে। এই টাকা তারা কোন দেশে কার হিসাবে পাঠাচ্ছে তা তারা নিজেরাও জানে না।

আরও পড়ুন: কৃষকের ভাবনায় জাতীয় বাজেট

সরকার জুয়া আইন-২০২৩ পাস করেছে। এই আইনে অন্যান্য অফলাইন জুয়ার মতো অনলাইন জুয়া বন্ধ করারও সুযোগ রয়েছে। তবে ভাণ্ডারিরা বিদেশে বসে এসব জুয়ার আসর বসায় বলে তাদের নাগাল পাওয়া খুবই অসাধ্য।

সেদিন শুনে তো বিস্মিত হয়ে গেলাম, অনলাইন জুয়ার সবচেয়ে বড় ডিজিটাল ভাণ্ডার ‘ইবঃ৩৬৫-এর বিশ্বজুড়ে গ্রাহকসংখ্যা দেড় কোটি! তাদের মতো জুয়ার ভাণ্ডারীদের তথাকথিত আত্মপক্ষ সমর্থনের মধ্যে ‘ইতিবাচক’ দিকগুলো হলো, এতে বিনিয়োগ কম (১০ ডলার), এই জুয়া ‘অত্যন্ত বিনোদনমুখী’, সুবিধাজনক ও ‘উত্তেজনায় ভরপুর’, বেটিং গ্রাহকের ‘সাধ্য ও অভিরুচির’ ওপর নির্ভরশীল, বিষয়টি ‘ব্যক্তিগত গোপনীয়তার’ নিশ্চয়তা দেয় এবং ‘নিরাপদ’। তা ছাড়া রয়েছে ‘বোনাস এবং নানা ধরনের পুরস্কার’।

আরও পড়ুন: উন্নয়নে সামাজিক মূলধনের ভূমিকা

আরো রয়েছে জুয়াকে খেলাধুলার সাথে জড়িত করার নানা ফন্দিফিকির। যেমন- ‘স্পোর্টস বেটিং’, ‘ক্যাসিনো গেমিং’, ‘পোকার’, ‘হর্স রেসিং (ঘৌড়দৌড় প্রতিযোগিতা),’ কিংবা ‘ডেইলি ফ্যান্টাসি স্পোর্টস’।

এসব ভাণ্ডারীদের অনেকগুলোই অসৎ, ধাপ্পাবাজ ও ঠগ। তাদের দেশের ব্যক্তি স্বাধীনতাকে (লিবার্টি) কাজে লাগিয়ে তারা জুয়ার হাট-বাজার-পসার খুলে বসেছে। জুয়াকে এরা এতই ‘গ্রাহকবান্ধব’ করে ফেলেছে যে, আবহাওয়া রিপোর্ট দেখার চেয়েও এগুলোর অপারেশন সহজ (রেশমের মতো মিহি)।

আরও পড়ুন: বঙ্গবন্ধু ও শান্তি

অনলাইন জুয়ার অনেক মাস্টার-পণ্ডিতও গজিয়েছে। অনেক কনসালটিং ফার্ম তাদের ওয়েবসাইট খুলে হাতে-কলমে জুয়ার তালিম দিয়ে থাকে। তবে ডিজিটাল জালিয়াতি (ঝপধস) সম্পর্কে কিছু বলে না এরা। সাইটগুলোর আইনগত বৈধতাও নেই।

‘ক্যাশআউট’ প্রক্রিয়াও জটিল ও সময়সাপেক্ষ। মাঝে মধ্যে ঝপধস অষবৎঃ ঝলক দিয়ে স্ক্রিনে উঠে এলেও এর প্রতিকারের কোনো ব্যবস্থা বা ঝপধহ অহঃরারৎঁং-এরও তেমন কোনো বালাই নেই।

আরও পড়ুন: বিনিয়োগ বান্ধব বাজেট চাই

গত করোনা অতিমারীকালে অনলাইন জুয়া আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেড়ে যায়। শুধু ২০২২ সালেই জগতজুড়ে অনলাইন জুয়াড়িরা উপার্জন করে এক বিলিয়ন ডলার আর একই পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, এই বছরে বিশ্বজুড়ে অনলাইন জুয়া ও অনলাইন ক্যাসিনো ভাণ্ডারীরা আয় করে ২৭ বিলিয়ন ডলার।

এ থেকেই বোঝা যায়, ২৬ বিলিয়ন ডলারই গিলেছে জুয়ার ভাণ্ডারীরা। ভাণ্ডারীদের বিপক্ষে রয়েছে আদর্শ সমাজ কিন্তু তাদের পক্ষে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ সমর্থন রয়েছে রাষ্ট্র ও শাসকমহলের। কারণ জুয়া থেকে খাজনা আসে। জুয়ার নেশায় ডুবিয়ে রেখে ক্ষমতাসীনরা যা ইচ্ছে তাই করে যেতে পারে। সমাজ উচ্ছন্নে যায় যাক, সমাজ বদলের জাগরণ তো থেমে থাকে!

নৈতিক আদর্শে বলীয়ান কোনো সমাজ অনিয়ম ও অগণতান্ত্রিক কাজ কারবার সহ্য করে না।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও চিত্রপরিচালক
[email protected]

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

নোয়াখালীতে ভূমি দুস্যুর বিরুদ্ধে মানববন্ধন 

নোয়াখালী প্রতিনিধি: নোয়াখালীর কোম...

ফসলের ক্ষতি করে চলছে অবৈধ ব্যাটারি ইন্ডাস্ট্রি

কামরুল সিকদার, বোয়ালমারী (ফরিদপুর):

গরমে বারবার গোসল করা কি ক্ষতিকর?

লাইফস্টাইল ডেস্ক: বৈশাখের শুরু থে...

আজ শেরে বাংলার ৬২তম মৃত্যুবার্ষিকী

নিজস্ব প্রতিবেদক: আজ অবিভক্ত বাংল...

খাগড়াছড়িতে ছাত্রলীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত

আবু রাসেল সুমন, খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি:

হিটস্ট্রোকে একদিনেই ৬ জনের মৃত্যু

নিজস্ব প্রতিবেদক: তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে হিট স্ট্রোকে আক্রা...

আইনি সেবায় মানবিকতাকেও স্থান দেয়া উচিত

নিজস্ব প্রতিবেদক: আইনি সেবা প্রদানকালে পুঁথিগত আইন প্রয়োগের...

ভূঞাপুরে বৃষ্টির জন্য নামাজ আদায় 

খায়রুল খন্দকার, টাঙ্গাইল: প্রচণ্ড তাপদাহে জনজীবন অতিষ্ট। নেই...

প্রধানমন্ত্রী দেশে ফিরছেন কাল

নিজস্ব প্রতিবেদক: থাইল্যান্ড সফর শেষে আগামীকাল ব্যাংকক থেকে...

ডিপিএস এসটিএস স্কুলে গ্র্যাজুয়েশন অনুষ্ঠান

নিজস্ব প্রতিবেদক: ডিপিএস এসটিএস স্কুল ঢাকার ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা