ছবি : সংগৃহিত
মতামত
জ্বালানি করিডোর

ভারত-বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তায় নতুন মাত্রা

সামারা আশরাত : অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশকে তার জ্বালানি নিরাপত্তা ও দীর্ঘমেয়াদি স্থায়িত্ব নিশ্চিত করতে প্রচলিত জীবাশ্ম জ্বালানির উৎস থেকে উত্তরণ ঘটাতে হবে। রাশিয়া-ইউক্রেন সঙ্কটের কারণে জ্বালানি পরিবহন বিঘ্নিত হওয়ায় উন্নয়নশীল এবং স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য জ্বালানি নিরাপত্তা একটি প্রধান উদ্বেগের বিষয় হয়ে উঠেছে।

আরও পড়ুন : চলচ্চিত্র আবারও হয়ে উঠুক সমাজ বদলের হাতিয়ার

এই প্রেক্ষাপটে আন্তঃসীমান্ত জ্বালানি সহযোগিতা এবং ভারত-বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় জ্বালানি করিডোরের ব্যবহার বাংলাদেশের জন্য বর্তমান বৈশ্বিক জ্বালানি সঙ্কট মোকাবেলায় বিশেষভাবে সহায়ক হতে পারে।

জ্বালানি করিডোরের ধারণা :

২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় নেপাল ও ভুটান থেকে ভারতের মাধ্যমে বিদ্যুৎ আমদানির অনুমতি দেয়ার অনুরোধ করেছিল বাংলাদেশ। নেপাল ইলেকট্রিসিটি অথরিটি-এনইএ ভারতের বিদ্যমান ট্রান্সমিশন অবকাঠামোর মাধ্যমে বাংলাদেশে ৪০-৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ রফতানির জন্য ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে অনুমোদন চেয়েছিল। ২০২২ সালের আগস্টে বাংলাদেশ এবং নেপাল উচ্চ ভোল্টেজ বহরমপুর-ভেড়ামারা ক্রসবর্ডার পাওয়ার ট্রান্সমিশন লিঙ্ক ব্যবহার করে প্রাথমিক পর্যায়ে নেপাল থেকে বাংলাদেশে ৪০-৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ রফতানির অনুমতি দেয়ার জন্য ভারতকে অনুরোধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।

আরও পড়ুন : ঢাকার বিষবায়ু কতদিন টানতে হবে?

নেপাল-বাংলাদেশ জ্বালানি সহযোগিতার জন্য গঠিত সচিবপর্যায়ের জয়েন্ট স্টিয়ারিং কমিটি-জেএসসি চলাকালীন সমঝোতা অনুসারে এনইএ এবং বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড বিদ্যুৎ লাইন ব্যবহার করে একটি ত্রিপক্ষীয় জ্বালানি বিক্রয় ও ক্রয়চুক্তির জন্য ভারতকে অনুরোধ করেছিল। কিন্তু ভূ-বেষ্টিত দেশ হওয়ার কারণে নেপালের বিদ্যুৎ রফতানির পরিকল্পনার জন্য ভারতের ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা ও অংশীদারিত্ব প্রয়োজন।

ভারতের সেন্ট্রাল ইলেকট্রিসিটি রেগুলেটরি কমিশনের মতে, যেখানে ভারতের সংশ্লিষ্টতা আছে, সেখানে ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্য করার অনুমতি দেয়া হয়। কিন্তু ভারতে সংশ্লিষ্টতা না থাকলে এ ধরনের অনুমতি দেয়ার সুযোগ নেই।

আরও পড়ুন : জেসিন্ডা স্মরণ করিয়ে দিলেন ‘রাজনীতিকরাও মানুষ’

ত্রিপক্ষীয় চুক্তির একটি নির্দিষ্ট বিধান রয়েছে, যা ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে ভারত সরকার এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিবেশী দেশগুলোর সরকারের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় চুক্তির কাঠামোতে স্বাক্ষর করার অনুমতি দেয়। মূল কথা হলো, ভারতের সাথে আন্তঃসীমান্ত বিদ্যুৎ বাণিজ্যের জন্য বাংলাদেশ ও নেপালকে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি করতে হবে।

এখন ভারত কাঠমাণ্ডুকে ভারতীয় ভূখণ্ড ও ভারতীয় অবকাঠামোর মাধ্যমে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ বিক্রি করার অনুমতি দেয়ার জন্য নেপাল এবং বাংলাদেশের প্রস্তাব বিবেচনা করছে। তাই বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে ‘জ্বালানি করিডোর’ ইস্যু।

জ্বালানি করিডোরের সূচনায় ভারতের প্রাপ্তি :

ভারত ও বাংলাদেশ উভয়েই আগামী বছরগুলোতে তাদের নবায়নযোগ্য শক্তির অংশ উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়াতে আগ্রহী। ভারত সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে অ-জীবাশ্ম জ্বালানি উৎস থেকে ৫০০ গিগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপন্ন করার একটি উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা তৈরি করেছে, যা নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে ৫০ শতাংশ শক্তির চাহিদা পূরণ করবে।

একইভাবে বাংলাদেশও বিদ্যুৎ খাতে নবায়নযোগ্য শক্তির অংশ এখন ৩ শতাংশ থেকে ২০৫০ সালের মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশে উন্নীত করতে চায়। পানিসমৃদ্ধ নেপাল উভয় দেশকেই তাদের স্বপ্নপূরণে সহায়তা করতে পারে।

আরও পড়ুন : উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান : অগ্নিঝরা দিনের স্মৃতি

এখন ভারতের জন্য বাংলাদেশকে সহযোগিতা করার মূল কারণ কী হতে পারে? বাংলাদেশের যেমন ভারতের ভূখণ্ড প্রয়োজন, তেমনি ভারতেরও নিজ দেশের জ্বালানি সম্ভাবনার শতভাগ কাজে লাগাতে বাংলাদেশকে দরকার। এর প্রধান কারণ, উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ভারতের ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতা। উত্তর-পূর্বাঞ্চল হলো ভারতের নবায়নযোগ্য শক্তির ক্ষমতা বৃদ্ধির প্রধান কেন্দ্র।

ভারত তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অনাবিষ্কৃত প্রাকৃতিক সম্পদের কার্যকর ব্যবহার চায়। শুধু অরুণাচল প্রদেশেই ভবিষ্যতে ৫০ হাজার মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। ইন্ডিয়ান নর্থ-ইস্টার্ন ইলেকট্রিক পাওয়ার কো-অপারেশনের তথ্য অনুসারে, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে প্রায় ৫৮ হাজার ৯৭১ মেগাওয়াট বিদ্যুতের সম্ভাবনা রয়েছে, যা ভারতের মোট জলবিদ্যুৎ সম্ভাবনার প্রায় ৪০ শতাংশ। ভারত অরুণাচল প্রদেশ ও অন্যান্য উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোতে জলবিদ্যুতের উপযোগের পরিকল্পনা করছে।

বর্তমানে ভারতের মোট ১৪৫ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট জলবিদ্যুতের সম্ভাবনা রয়েছে কিন্তু মাত্র ৪৫ হাজার ৩৯৯ মেগাওয়াট ব্যবহার করা হচ্ছে। ২০১৯ সাল পর্যন্ত ২৫ মেগাওয়াটের বেশি ক্ষমতার ১৮টি প্রকল্প উত্তর-পূর্বজুড়ে নির্মাণাধীন ছিল। কিন্তু উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে জলবিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য ভারতকে বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হবে। কিন্তু শিলিগুড়ি করিডোর নামক ভৌগোলিক বাধা ভারতের জন্য তার সম্ভাবনা কাজে লাগানোর বড় অন্তরায়। কিন্তু খরচ কমাতে ভারত সহজেই বাংলাদেশকে জ্বালানি করিডোর হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।

আরও পড়ুন : গল্প বলার স্বাধীনতা চাই

২০২১ সালে বাংলাদেশ জ্বালানি করিডোরে আগ্রহ দেখিয়েছিল। বাংলাদেশ আশা করেছিল, তার ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে যাওয়া হাই-ভোল্টেজ গ্রিডলাইনের মাধ্যমে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ জলবিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে। বাংলাদেশের বড়পুকুরিয়ায় ছয় হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার সঞ্চালন লাইন নির্মিত হলে ১০০ কিলোমিটার এবং জামালপুরে ২০০ কিলোমিটার হলে প্রতিটি রুটে একটি সাব-স্টেশন নির্মাণ করা যাবে। ট্রান্সমিশন লাইনের দু’টি সম্ভাব্য রুট হলো- আসামের বনগাঁ থেকে বড়পুকুরিয়া (দিনাজপুর) বা জামালপুর থেকে বিহারের পুর্নিয়া এবং আসামের শিলচর থেকে মেঘনাঘাট-ভেড়ামারা হয়ে পশ্চিমবঙ্গ পর্যন্ত।

ত্রিপুরা-কুমিল্লা, বোঙ্গাইগাঁও (আসাম)-জামালপুর/দিনাজপুর-পুর্নিয়া (বিহার), শিলচর (আসাম) এবং ফেঞ্চুগঞ্জে এ ধরনের উচ্চক্ষমতার আন্তঃসংযোগকারী লাইন থাকতে পারে।

আরও পড়ুন : স্বাধীনতার অর্ধশতকে বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অর্জন

ভারত যদি শেষ পর্যন্ত নেপাল থেকে বিদ্যুৎ আমদানির জন্য বাংলাদেশকে একটি পাওয়ার করিডোরের অনুমতি দেয় তাহলে এটি দ্বিপক্ষীয় জ্বালানি সহযোগিতার একটি নতুন যুগের সূচনা করবে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের মাধ্যমে উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে জলবিদ্যুতের অব্যবহৃত সুযোগ অর্জন করতে পারে।

সুতরাং, বাংলাদেশ ও ভারত উভয়েরই দ্বিপক্ষীয় জ্বালানি করিডোরের পারস্পরিক সুবিধার কথা চিন্তা করে তাদের জ্বালানি নিরাপত্তা বাড়াতে ও দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সহযোগিতা বাড়াতে এগিয়ে আসা উচিত বলে মনে করি।

লেখক : পিএইচডি গবেষণা ফেলো, বুখারেস্ট ইউনিভার্সিটি

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

তারেক রহমানের ৩১ দফা বাস্তবায়নে হাতিয়াতে উঠান বৈঠক

নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়াতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ঘোষ...

ইসলামী ব্যাংক কর্মকর্তাদের বিশেষ যোগ্যতা মূল্যায়ন পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ

ইসলামী ব্যাংক কর্মকর্তাদের বিশেষ যোগ্যতা মূল্যায়ন পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ ইসলাম...

বাগেরহাটের কলার বাম্পার ফলন

বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জে কলার বাম্পার ফলন হয়েছে। জমিতে বসেই কলার দাম ভালো পাওয়ায়...

ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে শাপলা চত্বরের ঘটনা

ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে শাপলা চত্বরের গণহত্যার ঘটনা এমন মন্তব্য কর...

একীভূত হচ্ছে না গণঅধিকার পরিষদ ও এনসিপি

সম্প্রতি গুঞ্জন উঠে দেশের তরুণদের নিয়ে গঠিত দল দুইটি একীভূত হওয়ার বিষয়ে। তবে...

শাপলা নয় এনসিপিকে বালতি-বেগুনসহ ৫০ প্রতীকের অপশন

শাপলা প্রতীক নয় বরং বেগুন, বালতিসহ ৫০টি প্রতীক থেকে জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এন...

২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আরও ২ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ৩৯৬

ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ২৪ ঘণ্টায় আরও দুজনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে চলতি বছর এইডস ম...

আ. লীগের ঘাপটি মেরে থাকা অনুচরেরা এখনো তৎপর

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাজ...

লুটপাটের ভিডিও করায় সাংবাদিককে হেনস্তা 

লক্ষ্মীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য নুর উদ্দিন চৌধ...

গাজাগামী ত্রাণবাহী জাহাজ আটক, নিরাপত্তার দাবি জামায়াতের

গাজামুখী ত্রাণবাহী জাহাজ আটক করার ঘটনায় ইসরায়েলের ন্যাক্কারজনক ভূমিকার তীব্র...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা