মতামত

পর্যটনশিল্পকে এগিয়ে নিতে সমন্বিত আন্তরিকতার প্রয়োজন

ড. জান্নাতুল ফেরদৌস: বিশ্বব্যাপী প্রধান অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গুলোর মধ্যে পর্যটন শিল্প অন্যতম হিসেবে সুপরিচিত। বর্তমান বিশ্বে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের প্রধান হাতিয়ার হিসেবে পর্যটন শিল্প সার্বজনীনভাবে বিবেচিত হয়ে আসছে।

আরও পড়ুন: ছাত্রলীগের সম্মেলনঢাকার যেসব রাস্তা বন্ধ থাকছে

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাংলাদেশে বহুমুখী পর্যটনের সম্ভাবনা রয়েছে। পরিচিত অপরিচিত অনেক পর্যটন-আকর্ষনীয় স্থান আছে। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে যুগে যুগে ভ্রমণকারীরা মুগ্ধ হয়েছেন। এর মধ্যে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, ঐতিহাসিক মসজিদ এবং মিনার, পৃথিবীর দীর্ঘতম প্রাকৃতিক সমুদ্র সৈকত, পাহাড়, অরণ্য, বিস্তীর্ণ হাওর, চা বাগানসহ ইত্যাদি অন্যতম।

তাই পর্যটন শিল্পে বিশ্বের বুকে এক অপার সম্ভাবনার নাম বাংলাদেশ। এ দেশের প্রাকৃতিক রূপবৈচিত্র্য পৃথিবীর অন্য দেশ থেকে অনন্য ও একক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। পর্যটন বিকাশে বাংলাদেশের রয়েছে অপার সম্ভাবনা।

এক সমীক্ষা অনুযায়ী ১৯৫০ সালে পৃথিবীতে পর্যটকের সংখ্যা ছিল মাত্র ২৫ মিলিয়ন; ২০১৬ সাল পর্যন্ত এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ১২৩৫ মিলিয়নে। ধারণা করা হচ্ছে, আসছে বছরগুলোতে প্রতিবছর প্রায় ১৩৯ কোটি ৫৬ লাখ ৬০ হাজার পর্যটক সারা পৃথিবী ভ্রমণ করবেন। অর্থাৎ বিগত বছরগুলোতে পর্যটকের সংখ্যা প্রায় ৫০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। পর্যটকের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ সংক্রান্ত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরিধি ব্যাপকতা লাভ করেছে। পর্যটনের মধ্যে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন সাধিত হয়ে থাকে। ২০১৭ সালে বিশ্বের জিডিপিতে ট্যুরিজমের অবদান ছিল ১০.৪ শতাংশ, যা ২০২৭ সালে ১১.৭ শতাংশে গিয়ে পৌঁছাবে। এছাড়া ২০১৭ সালে পর্যটকদের ভ্রমণখাতে ব্যয় হয়েছে ১৮৯৪.২ বিলিয়ন ডলার। আর একই বছর পর্যটনে বিনিয়োগ হয়েছে ৮৮২.৪ বিলিয়ন ডলার।

ভ্রমণ ও পর্যটন কাউন্সিলের (ডব্লিউটিটিসি) তথ্যানুযায়ী, বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই শিল্পের অবদান ৮ দশমিক ৯ ট্রিলিয়ন ডলার। ২০১৯ সালে পর্যটন শিল্প বৈশ্বিক অর্থনীতিতে ২ দশমিক ৯ ট্রিলিয়ন ডলার অবদান রাখে, যা বিশ্ব জিডিপির ১০ দশমিক ৩ শতাংশ। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করে ১৫৬ কোটি পর্যটক, অর্থাৎ প্রতি সাতজনের একজন পর্যটক। জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের ফলে সাধারণ মানুষের কাছে ভ্রমণ পিপাসা অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে বিধায় আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতে অনন্য অবদান রাখছে। বাংলাদেশে পর্যটন খাতে সরাসরি কর্মরত আছেন প্রায় ১৫ লাখ মানুষ।

আরও পড়ুন: ছাত্রলীগের জাতীয় সম্মেলন শুরু

এ ছাড়া পরোক্ষভাবে ২৩ লাখ। অর্থাৎ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ৪০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে, যার আর্থিক মূল্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী পর্যটকের সংখ্যা প্রায় ১১০ কোটি। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২২ সাল নাগাদ এ সংখ্যা ২০০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। আর বিপুল সংখ্যক পর্যটকের প্রায় ৭৫ শতাংশ ভ্রমণ করবে এশিয়ার দেশগুলোতে। বাংলাদেশ যদি এ বিশাল বাজারে টিকে থাকতে পারে, তাহলে পর্যটনের হাত ধরেই বদলে যেতে পারে দেশের অর্থনীতির রূপরেখা। বাংলাদেশের গ্রামগুলো হতে পারে পর্যটন আকর্ষণের অপার সম্ভাবনা।

দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বহুমাত্রিক পর্যটনশিল্পের সম্ভাবনা রয়েছে শুধু কক্সবাজারে। বহুমাত্রিক পর্যটনে সাংস্কৃতিক, ইকো, স্পোর্টস, কমিউনিটি ও ভিলেজ টুরিজম ব্যবস্থা করতে হবে। বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পে বেসরকারি বিনিয়োগ ধীরে ধীরে বাড়ছে। পর্যটকদের আবাসন সুবিধা বৃদ্ধির অভিপ্রায়ে কক্সবাজারে রাজধানী নগরী ঢাকা থেকেও বেশি হোটেল/মোটেল গড়ে উঠেছে। সকল পর্যটন কেন্দ্রেই বেসরকারি উদ্যোগের কারণে অভ্যন্তরীণ পর্যটকদের আকর্ষণ বৃদ্ধি পাচ্ছে উল্লেখযোগ্য হারে।

কক্সবাজার বাদে অন্যান্য ট্যুরিস্ট স্পটগুলোতে তেমন আধুনিকায়ন হয়নি। তবে ধীরে ধীরে হচ্ছে অনেক স্পটে। পাহাড়পুর, মহাস্তানগড়ে উন্নয়ন যথেষ্ট চোখে পড়ার মত। বিনোদনসহ অন্যান্য সুযোগসুবিধা বাড়াতে হবে। পর্যটনখাতে বিদেশি পর্যটক আকৃষ্ট করতে হবে। বিদেশিদের জন্য আলাদা আবাসিক ব্যবস্থা বা বিনোদনের ব্যবস্থা করতে হবে। বিশ্বে চীনা পর্যটকেরা বেশি ব্যয় করে। চীনের নাগরিকের বেশিরভাগ বৌদ্ধধর্মালম্বী। তাই তাদের আকৃষ্ট করতে বৌদ্ধস্থাপনাগুলোতে যোগাযোগ ও অন্যান্য সুবিধা বাড়াতে হবে। চীনা পর্যটকদের আনতে পারলে অর্থনীতিতে গতিসঞ্চার হবে। থাইল্যান্ড বা মালয়েশিয়ায় পর্যটনখাতে অনেক এগিয়ে। দেখা যায়, চীনা পর্যটকের হার অনেক বেশি এ দুদেশে।

আরও পড়ুন: কোয়ার্টার ফাইনালে ব্রাজিল সাম্বা ঝড়ে বিধ্বস্ত দ. কোরিয়া

পর্যটন শিল্পের অগ্রগতিতে বাংলাদেশের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বাধা রয়েছে। সম্প্রতি একটি সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে দেয়া এক প্রতিবেদনে এ তথ্য পাওয়া যায়। এরমধ্যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বাইরে পর্যটন উপযোগী উল্লেখযোগ্য ও উপযোগী উপাদানের অভাব। এই খাতে সরকারের বাজেট বরাদ্দের অপ্রতুলতা, সড়ক, নদীপথ, রেল ও বিমান যোগাযোগের নিরাপদ ও উপযুক্ত মানের পর্যটন উপযোগী পরিকল্পিত ও সমন্বিত যোগাযোগ ব্যবস্থাপনার অনুপযোগিতা ও অপর্যাপ্ততা, পর্যটন দৃষ্টিকোণে সঠিক বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নীতকরণে উপযুক্ত প্রচারণার অভাব, পর্যটন খাতকে সমৃদ্ধকরণে দেশের গণমাধ্যমের (প্রিন্ট, ইলেক্ট্রনিক্স ও ইন্টারনেটভিত্তিক সংবাদমাধ্যম) আন্তরিক সংশ্লিষ্টতা ও যথাযথ উদ্যোগের অভাব, আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সমন্বয়হীনতা ও কার্যকরী সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে দীর্ঘসূত্রিতা, পর্যটন শিল্প খাতটির সঠিক উপলব্ধি, মানসিকতা ও ধারণার অভাব, পর্যটন খাতে নিযুক্ত জনবলের মানসিকতা, পর্যাপ্ত জ্ঞান ও পেশাদারিত্বের অভাব। সেই সঙ্গে পর্যটন বিষয়ক সঠিক, উপযুক্ত শিক্ষিত ও মননের মানুষের অপর্যাপ্ততা, প্রান্তিক পর্যায়ে ট্যুরিজম সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান, যানবাহন, ব্যক্তি পর্যায়ে প্রদত্ত সেবা, পণ্যের বিপরীতে মাত্রাতিরিক্ত মূল্যমান আদায়ের, হয়রানিমূলক আচরণ সেই সঙ্গে সার্বিক নিরাপত্তাহীনতা, আন্তর্জাতিক ভাষাজ্ঞানসহ এ খাতের উপযোগী অন্যান্য ভাষাজ্ঞান সমৃদ্ধ জনবলের অপর্যাপ্ততাকে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়।

আশার কথা হলো ইতোমধ্যেই পুরো দেশকে আটটি পর্যটন জোনে ভাগ করেছে সরকার। এসব প্রকল্পে সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এইখাতে বিনিয়োগ করে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ হওয়ার মাধ্যমে দেশের পর্যটনে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে পারেন ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা।

আমাদের দেশে বিদেশি পর্যটকরা আসেন দু’ধরনের জিনিস দেখতে। এর একটি হচ্ছে ঐতিহাসিক নিদর্শনসমূহ এবং অন্যটি হচ্ছে নিঃসর্গ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। নিঃসর্গ প্রকৃতি আমাদের কম সুন্দর নয়, অথচ এর কাছে যাওয়ার, উপভোগ করার পরিকল্পিত ব্যবস্থা আমরা এখনো গড়ে তুলতে পারিনি। এক হিসাবে দেখা গেছে, বাংলাদেশে আগত প্রতিটি পর্যটক দৈনিক মাত্র ৫.৫ আমেরিকান ডলর ব্যয় করেন। আমরা এখনও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, জার্মানির কিংবা ইউরোপীয় পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য এখনো তেমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারিনি। বাংলাদেশে যে পরিমাণ পর্যটক আসে তার ৬০ ভাগই দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো থেকে।

আরও পড়ুন: বিশ্বজুড়ে বেড়েছে মৃত্যু

স্পষ্টত বলা যায়, ৪০ ভাগ আসে ভারত থেকে যাদের বেশির ভাগই বাংলাদেশে আসেন তাদের বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন ও ব্যবসায়িক বন্ধু-বান্ধবদের সাক্ষাত্ করতে। কাজেই এদের কাছ থেকে আশাপ্রদ বৈদেশিক মুদ্রা আমরা পাই না। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ইউরোপ থেকে বাংলাদেশে আসে ১৬ ভাগ পর্যটক। ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ড থেকে আসে শতকরা ৯ ভাগ। বাকি পর্যটক আসে পৃথিবীর অন্যান্য দেশ থেকে। নেপালে জাতীয় আয়ের ২০ ভাগ আসে পর্যটন খাত থেকে আর মালদ্বীপে ৪০ ভাগ।

এসব দিক বিবেচনায় আমাদের দেশের অবস্থান শূন্যের কোটায় বলা যায়। জাতীয় অর্থনীতির বিকাশে পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন করা ছাড়া বিকল্প নেই। পর্যটন শিল্পকে উন্নত এবং দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে পর্যটন স্পটগুলোকে আকর্ষণীয় করে তুলে ধরতে হবে। বাংলাদেশে বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলের ও পত্রপত্রিকারও দায়িত্ব রয়েছে এ ব্যাপারে। সকলেই আন্তরিক হতে হবে তাহলে সফলতা আসবে নিশ্চিত করে বলা যায়।

লেখক: ড. জান্নাতুল ফেরদৌস, সহযোগী অধ্যাপক, লোক প্রশাসন বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।

সান নিউজ /এসআই

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

ভোলায় অনুষ্ঠিত হলো প্রাণী প্রদর্শনী মেলা

ভোলা প্রতিনিধি: ‘প্রাণিসম্পদে ভরবো দেশ, গড়বো স্মার্ট ব...

সম্মিলনী বিদ্যালয়ের সভাপতি ফিরোজ আহমেদ

কামরুল সিকদার, বোয়ালমারী (ফরিদপুর) : ফরিদপুর জেলার সদর ইউনিয়...

বাংলাদেশ স্কাউট দিবস ২০২৪ পালিত

নিজস্ব প্রতিবেদক : আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউটে অনুষ্...

ভাসানচরে এক রোহিঙ্গাকে গলা কেটে হত্যা

নোয়াখালী প্রতিনিধি : নোয়াখালীর হাতিয়ার ভাসানচর রোহিঙ্গা ক্যা...

হিট স্ট্রোক প্রতিরোধে করণীয়

লাইফস্টাইল ডেস্ক : দেশে তাপপ্রবাহ বাড়ছে। আর এই গরমে সবচেয়ে ব...

ফরিদপুরে সংঘর্ষ, নিহত ২

জেলা প্রতিনিধি : ফরিদপুরে মাইক্রোবাস ও মাহেন্দ্র মুখোমুখি সং...

ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক

জেলা প্রতিনিধি: ঢাকা-টাঙ্গাইল-বঙ্...

বনশ্রীতে যুবকের লাশ উদ্ধার

নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজধানীর বনশ্রী...

পালিয়ে এল আরও ১৩ বিজিপি সদস্য

জেলা প্রতিনিধি: মিয়ানমারের চলমান...

রাজধানীতে শিশুর মৃত্যু

নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজধানীর ভাষানটেক এলাকার ১৩ নম্বর কালভার্ট...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা