করোনার নতুন ধরন ওমিক্রন (ছবি: প্রতীকী)
মতামত

ওমিক্রনের নতুন উপধরনে সতর্কতা জরুরি 

মুশতাক হোসেন: দীর্ঘদিন ধরে করোনার সংক্রমণের নানা রকম অভিঘাতের বিরূপ প্রভাব একের পর এক দেখা দিচ্ছে। বারবার ধরন পরিবর্তনকারী করোনার নতুন ধরন ওমিক্রন সৃষ্টি করেছে আবার এক নতুন পরিস্থিতির। দেশে সংক্রমণের হার ফের ঊর্ধ্বমুখী। তিন মাস আগে দক্ষিণ আফ্রিকার বতসোয়ানায় সৃষ্ট নতুন ধরন ওমিক্রন দ্রুত বিশ্বের কয়েকটি দেশে ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। আমরা জানি, করোনার ডেলটা ধরনের উল্লম্ম্ফনের চেয়ে ওমিক্রনের বিস্তার ছাড়িয়ে যায় বহুগুণ। আমরা দেখেছি ডেলটা ধরনে বিশ্বে এক দিনে প্রায় ৯ লাখ রোগী শনাক্ত হওয়ার রেকর্ড। আর ওমিক্রন ধরনের প্রভাবে এক দিনে গত মাসে প্রায় ৩৪ লাখ রোগী শনাক্ত হয়। এর মধ্যে মিলেছে ওমিক্রনের উপধরনের বার্তা। এ অবস্থায় আমাদের এখনই সতর্ক হওয়া জরুরি ও পরীক্ষার পরিসর বাড়াতে জোর দিতে হবে এবং তা আরও সহজলভ্য করা দরকার। প্রয়োজনে ভ্রাম্যমাণ কেন্দ্র খুলে পরীক্ষার বিষয়েও ভাবা যেতে পারে।

আমরা জানি, দেশে গত ডিসেম্বরে শনাক্ত হয়েছিল ৯ হাজারের কম রোগী। জানুয়ারি মাসে লক্ষ্য করা যায় সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি। ওই মাসে রোগী শনাক্তের সংখ্যা ২ লাখ ছাড়িয়ে যায়। এক মাসের ব্যবধানে সংক্রমণ বেড়ে যায় ২৩ গুণ। একই সঙ্গে বাড়ে মৃত্যুও। আমরা দেখছি, উচ্চ সংক্রমণের এই সময়ে কখনও বাড়ছে মৃত্যু, আবার কখনও শনাক্তের হার বাড়া-কমায়ও সূচকের ওঠানামা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গত কয়েক দিন ধরেই নতুন রোগী বাড়ছে এবং সংক্রমণের আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যেতে পারে- এই আশঙ্কাও রয়েছে। সংক্রমণ যেহেতু ঊর্ধ্বমুখী, তাই যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে চলায় কোনো ছাড় দেওয়ার অবকাশ নেই। সংক্রমণ নিম্নমুখী করতে সর্বাগ্রে জরুরি জনসচেতনতা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্নেষণে দেখা যাচ্ছে, মৃত ও সুস্থদের বাদে বর্তমানে চিকিৎসাধীন রোগীর সংখ্যা ২ লক্ষাদিক। তবে আক্রান্ত অনেকেরই হাসপাতালে ভর্তি না হওয়ার

তথ্যও জানা গেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তরফে। একই সঙ্গে জানা গেছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ওমিক্রনের নতুন উপধরন এ পর্যন্ত বিশ্বের ৫৭টি দেশে ছড়িয়েছে। যদিও আমাদের দেশে এর অস্তিত্ব মেলেনি; তবুও সতর্কতামূলক সব ব্যবস্থা নিয়ে রাখা প্রয়োজন।

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিউনোলজিস্ট শিব পিল্লাই জানিয়েছেন, এই নতুন রূপের ওমিক্রন আগের থেকে আরও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। একই সঙ্গে এ ব্যাপারে তিনি তার উদ্বেগের কথাও জানিয়েছেন। করোনা সংক্রমণের বিস্তার ঠেকাতে ব্যক্তির সচেতনতার বিষয়টি কতটা জরুরি, ফের এরও ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন। দীর্ঘদিন ধরে চলা এই ভাইরাসের গতি কখনও নিম্নমুখী, কখনও ঊর্ধ্বমুখী। এরই মধ্যে রয়েছে ধরন পরিবর্তনের বিষয়টিও।

এ পরিস্থিতিতে মানুষের উদাসীনতা, স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণে উপেক্ষা ভয়াবহ হয়ে দাঁড়াতে পারে। দেখা যাচ্ছে, যারা দুই ডোজ টিকা পেয়েছেন তাদেরও অনেকে আক্রান্ত হয়েছেন। তবে দুই ডোজ টিকা গ্রহীতার বেলায় এও দেখা যাচ্ছে, আক্রান্ত হলেও অনেককে বড় রকমের ঝুঁকির মুখে পড়তে হচ্ছে না। অর্থাৎ টিকা অনেকটাই সুরক্ষা দিয়েছে। তাই বলে যথেচ্ছ চলাফেরার অবকাশ নেই। কারণ নিজে সুরক্ষিত না থাকলে অন্যের ঝুঁকি বাড়বে। সামাজিক সংক্রমণের অনাকাঙ্ক্ষিত চিত্র দেখা দেবে। অনেকেই করোনা সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায়গুলো এতদিনে ভালো করে জেনেছেন। কিন্তু উদ্বেগের কারণ হলো, অনেকেই তা মানেন না।

যত বেশি মানুষ আক্রান্ত হবে, সে ক্ষেত্রে ঝুঁকিও বাড়বে। তা ছাড়া নানা রকম উপসর্গ দেখা যাচ্ছে আক্রান্তদের করোনামুক্ত হওয়ার পরও। আইইডিসিআরের গবেষণায় দেখা গেছে, করোনা থেকে মুক্ত হওয়ার ৩ মাস পর ৭৮ শতাংশ, ৬ মাস পর ৭০ শতাংশ, ৯ মাস পর ৬৮ শতাংশ এবং এক বছর পর ৪৫ শতাংশ মানুষের মাঝে নানা রকম শারীরিক জটিলতা দেখা যাচ্ছে। গবেষণায় উঠে এসেছে, কারও কারও শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ-ফুসফুস-হার্ট, কিডনি, ত্বক, স্নায়ুতন্ত্র ও পরিপাকতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আর মানসিক চাপ তো আছেই। এর ফলে বাড়ছে রক্তচাপ। দেখা দিচ্ছে অনিদ্রা, খাবারে অরুচিসহ শারীরিক দুর্বলতাসহ কিছু উপসর্গ। তাই যিনি বা যারা সুস্থ হবেন, তাদেরও চিকিৎসকের পরামর্শে চলতে হবে। করোনার অভিঘাত আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে যে ছায়া ফেলেছে, তাতে মানুষের মধ্যে নানা রকম উপসর্গ সৃষ্টি হচ্ছে। এ সংকট কাটিয়ে উঠতে হবে যূথবদ্ধ প্রয়াসে।

খুব সতর্ক থাকা প্রয়োজন করোনা-পরবর্তী শারীরিক জটিলতাগুলো সম্পর্কে। যে কোনো জটিলতায় চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ার পাশাপাশি মানসিক সুস্থতার জন্য পারিবারিক-সামাজিক উদ্যোগের প্রয়োজনীয়তার গুরুত্ব রয়েছে। টিকা করোনা সংক্রমণ পুরোপুরি রোধ করতে না পারলেও টিকা গ্রহীতার উপসর্গের তীব্রতা কম হবে। অনেক ক্ষেত্রেই প্রয়োজন হবে না হাসপাতালে ভর্তির। কাজেই আমাদের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার জনগোষ্ঠীর সবাইকে দ্রুত টিকার আওতায় আনতে হবে। দেশে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সাড়ে ৬শর বেশি পরীক্ষাগার সক্রিয়। আরটি-পিসিআর, জিন এক্সপার্ট এবং র‌্যাপিড অ্যান্টিজেন পরীক্ষার মাধ্যমে করোনা রোগী শনাক্ত করা হচ্ছে। হাসপাতালগুলোর অন্যান্য সেবা সক্ষমতাও বেড়েছে। কিন্তু কোনো কিছুরই কাঙ্ক্ষিত ফল মিলবে না, যদি মানুষের মধ্যে সচেতনতাবোধ পুষ্ট না হয়। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তির দায়ের কথা ভুললে চলবে কী করে?

সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়াদের মধ্যে ৮০ শতাংশই টিকা নেননি। টিকাদানে আমাদের কর্মপরিকল্পনা এখন অনেক বিস্তৃত। মানুষের নানা ক্ষেত্র থেকে টিকা পাওয়ার প্রেক্ষাপটও এখন তৈরি হয়েছে। টিকার মজুতও আছে। তবে টিকা নেওয়ায় মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার কার্যক্রম আরও গতিশীল করা দরকার। তৃণমূল পর্যায়ে টিকাদানে সরকারের যে কর্মপরিকল্পনা রয়েছে, তা বাস্তবায়নে জোর দেওয়া জরুরি। এ ব্যাপারে প্রচারণার পাশাপাশি এর সুফল এবং সুরক্ষা পাওয়ার বিষয় সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে আরও ব্যাপকভাবে জানানোর ব্যবস্থা নিতে হবে। আমরা দেখছি, টিকাদানে অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সহায়তা করছে। তাদের আরও সম্পৃক্ত করার পাশাপাশি জনপরিসরেও তা বাড়ানোর চেষ্টা জোরালো করা প্রয়োজন। টিকার মজুত ও সংগ্রহের যেহেতু আপাতত কোনো সংকট নেই, সেহেতু মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে টিকার আওতায় নিয়ে আসাটাই মুখ্য।

ওমিক্রনকে কোনোভাবেই হালকা করে নেওয়ার অবকাশ নেই। সংক্রমণের বিস্তার ঠেকাতে যূথবদ্ধ প্রয়াস ও সচেতনতা জরুরি। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ব্যাপারে কোনো শৈথিল্য কাম্য নয়। হাসপাতালের প্রস্তুতি চলমান বিষয়; এর শেষ নেই। হাসপাতাল ব্যবস্থাপনাসহ সংশ্নিষ্ট সবকিছু এখন অনেক ভালো বলা যায়; তবে একসঙ্গে অনেক মানুষ আক্রান্ত হলে সংকট দেখা দেবেই। এমনটি শুধু আমাদের নয়; সব দেশের জন্যই মুশকিল। সংক্রমণের ব্যাপকতা বাড়লে রোগীর পরিস্থিতি বাছাইক্রমে সেভাবে স্তরভিত্তিক চিকিৎসাসেবার পরিসর বাড়াতে হবে। হাসপাতাল প্রাঙ্গণে রোগীদের ক'দিন বাড়তি পর্যবেক্ষণে রাখার জন্য অস্থায়ী ব্যবস্থার বিষয়টিও আমলে রাখা দরকার। অর্থাৎ আইসোলেশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে বিশেষ করে তাদের জন্য, যাদের বাসাবাড়িতে সে রকম ব্যবস্থা নেই। একই সঙ্গে বাড়ানো প্রয়োজন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির পরিসর।

আরও পড়ুন: সিনহা হত্যার বিচার ও আইনের শাসন

কীভাবে মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণ বন্ধ করা যায়- এ পদ্ধতি সম্পর্কে দেশের সিংহভাগ মানুষই এখন জ্ঞাত। স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার দায় শুধু সরকারের নয়; ব্যক্তিরও। স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে ব্যক্তিকে এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। পুরো বিষয়টি হতে হবে সহায়তামূলক। এক সময় সবকিছু বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায়। তা করা এখন কঠিন। মনে রাখতে হবে, সংক্রমণ বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে ভাইরাস শক্তিশালী হতে পারে। তৈরি হতে পারে আরও নতুন ধরন। তখন বর্তমান টিকার কার্যকারিতা নাও থাকতে পারে। টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এসব বিষয় বিবেচনায় রেখে নতুন প্রজন্মের টিকা নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। এ জন্যই দেশে বাড়াতে হবে জিনোম সিকোয়েন্স। তা করা না গেলে আমরা বুঝতেই পারব না, আমাদের দেশে নতুন ধরন তৈরি হচ্ছে কিনা কিংবা এর শক্তি-সামর্থ্যই বা কেমন।

ডা. মুশতাক হোসেন: উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, আইইডিসিআর

সাননিউজ/এমএসএ

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

বোয়ালমারীতে স্বর্ণের কারিগরকে কুপিয়ে জখম

কামরুল সিকদার, বোয়ালমারী (ফরিদপুর) : ফরিদপুরের বোয়ালমারীতে...

নিজ্জর হত্যায় সন্দেহভাজন ৩ জন গ্রেফতার 

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: কানাডায় বসবাসর...

বজ্রপাতের সময় করণীয়

লাইফস্টাইল ডেস্ক: চলমান তাপপ্রবাহ...

ইন্দোনেশিয়ায় বন্যা-ভূমিধস, নিহত ১৫

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: ইন্দোনেশিয়ার ম...

ভালুকায় পানি ও স্যালাইন বিতরণ

ভালুকা (ময়মনসিংহ) প্রতিনিধি : ময়মনসিংহের ভালুকায় প্রচন্ড...

শাহজালালে বন্ধ থাকবে ফ্লাইট ওঠানামা

নিজস্ব প্রতিবেদক: হযরত শাহজালাল আ...

উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী পান্নার গণসংযোগ

রাজীব চৌধুরী, কেশবপুর : আসন্ন কেশবপুর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে...

লিফট কিনতে ফিনল্যান্ড গেলেন ঢাবির প্রো-ভিসি

নিজস্ব প্রতিবেদক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) বিভিন্ন ভবনের...

লন্ডনে ফের মেয়র হলেন সাদিক খান

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: যুক্তরাজ্যের র...

ইয়াবাসহ গ্রেফতার ১

জেলা প্রতিনিধি: চট্টগ্রাম জেলায় ক...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা