ছবি: সংগৃহীত
মতামত

বর্ধিত ভাড়ার নামে ডবল প্রতারণা

আনিস আলমগীর

গণপরিবহনে ভাড়া বেড়েছে। তার আগে বেড়েছে ডিজেলের দাম। সেটা নিয়েই তুলকালাম কাণ্ড চলছে ক’দিন ধরে। গণপরিবহন চলাচল পুরোপুরি বন্ধ ছিল। জ্বালানি এবং পরিবহনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব সেক্টরে প্রভাব পড়েছে পরিবহন ধর্মঘট এবং ডিজেলের দাম বৃদ্ধি। আরেকটি বিষয় আবারও স্পষ্ট হয়েছে যে পরিবহন সেক্টরে একটা নৈরাজ্য বিরাজ করছে। সেক্টরটি আর সরকারের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নেই। উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, সরকার নতুন করে যে ভাড়া নির্ধারণ করেছে তার চেয়ে বেশি ভাড়া এখনও পরিবহন সেক্টরে বিদ্যমান আছে। নতুন ভাড়া যাত্রীদের অন্যায্যভাবে আরেকবার পকেট কাটার সুযোগ করে দিয়েছে।

ঘটনার শুরু হঠাৎ ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বৃদ্ধি নিয়ে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় ৩ নভেম্বর ২০২১ রাতে এক বিজ্ঞপ্তিতে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে ১৫ টাকা বাড়িয়ে ৮০ টাকা করে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এর ব্যাখ্যায় বলেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য হ্রাস পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশে তার প্রতিফলন ঘটবে। ভারতে ডিজেলের দাম ৮০ রুপির ওপরে। প্রায় ৪০০০ কিলোমিটার সীমান্ত দিয়ে ভারতে তেল পাচার হচ্ছিল এবং সেটি ঠেকানো যাচ্ছে না, এটি আরেকটি অলিখিত কারণ জ্বালানির দাম বাড়ার সঙ্গে।

কিন্তু পরিবহন মালিকরা কাউকে তোয়াক্কা না করে পরদিন থেকে ধর্মঘটে চলে যায়। সরকার পড়ে বিপাকে। তারা ভুলেও ভাবেনি এমন এক পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। চারদিন জনগণকে ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে। ফলে পরিবহন মালিকদের ডেকে সমঝোতা। প্রায় ২৭ শতাংশ ভাড়া বাড়ানোর ঘোষণা আসে ৭ নভেম্বর। অথচ সরকার বুদ্ধি খরচ করলে এই নৈরাজ্য ঠেকাতে পারতো। আপাতত তেলের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত স্থগিত রেখে পরিবহন মালিকদের পরিবহন চালাতে বাধ্য করতে পারতো। কারণ, পরিবহন মাফিয়ারা তেলের দাম কমানোর জন্য কর্মবিরতির নামে অঘোষিত ধর্মঘটে যায়নি, তারা ভাড়া বাড়ানোর অজুহাত হিসেবে ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধিকে হাতিয়ার করেছিল।

ধর্মঘট ডাকতে হলে অন্তত ১৫ দিন আগে ঘোষণা দিতে হয়। হঠাৎ করে গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দেশের মানুষকে এভাবে জিম্মি করার সুযোগ নেই প্রচলিত আইনে। তা করলে রুট পারমিট, ফিটনেস ও রেজিস্ট্রেশন বন্ধ বা স্থগিত করার সুযোগ আছে। সরকার সেদিকে না গিয়ে, জনগণকে ভোগান্তির দায় কার ছিল তা স্পষ্ট না করে সমঝোতায় গিয়েছে।

জনগণের ভোগান্তি এখানে শেষ নয়। সরকার নির্ধারিত নতুন ভাড়ার চেয়েও বেশি ভাড়া আদায় শুরু করেছে পরিবহন মালিকরা। কিন্তু দেখার কেউ নেই। না আছে ভাড়ার চার্ট, না আছে পরিবহনের গায়ে সিএনজি চালিত কিনা সেই পরিচয়। পরিচয়টা খুব দরকার। কারণ, সরকার ডিজেল চালিত গাড়ির ভাড়া বাড়িয়েছে, গ্যাস চালিত গাড়ির না।

সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী এখন দূরপাল্লার বাস ভাড়া কিলোমিটার প্রতি ১ টাকা ৪২ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১ টাকা ৮০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরের বাস-ভাড়া কিলোমিটার প্রতি ১ টাকা ৭০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ২ টাকা ১৫ পয়সা করা হয়েছে। অন্যদিকে মিনিবাসের ভাড়া হবে এর চাইতে ১০ পয়সা কম। মিনিবাসের নতুন নির্ধারিত ভাড়া বেড়ে প্রতি কিলোমিটার ২ টাকা ৫ পয়সা হয়েছে। সেই সঙ্গে বাসের সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ টাকা, মিনিবাস ৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে সিএনজি চালিত বাস/মিনিবাসের ক্ষেত্রে নতুন নির্ধারিত এই ভাড়া প্রযোজ্য হবে না বলে জানানো হয়।

কিন্তু এই ভাড়া সব ধরনের বাসে নেওয়া হচ্ছে। যাত্রীদের অধিকার নিয়ে আন্দোলনকারী একটি সংগঠন যাত্রী কল্যাণ সমিতির পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ঢাকার ৯৫ শতাংশ বাস সিএনজি-চালিত। সেটা দেখার কোনও কর্তৃপক্ষ এখনও দেখা যাচ্ছে না। বাসের বর্ধিত ভাড়ার তালিকা বা চার্ট নিয়ে দিনভর ভোগান্তির অভিযোগের পর বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ বিআরটিএ বলেছে, ৯ নভেম্বর থেকে ঢাকাসহ সারাদেশে নতুন ভাড়ার চার্ট দেওয়া হবে।

বিআরটিএ চেয়ারম্যান নূর আহমেদ মজুমদার বলেছেন, ভাড়ার বিষয়টি নজরদারির জন্য তাদের প্রতিষ্ঠানের ১৩ জন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে মোবাইল কোর্ট বা ভ্রাম্যমাণ আদালত মাঠে নেমেছে। কোন বাসে বেশি ভাড়া নেওয়া হচ্ছে তা ভ্রাম্যমাণ আদালতের নজরে এলে তাৎক্ষণিক শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে।

বাসের সঙ্গে লঞ্চের ভাড়াও কিলোমিটার প্রতি ৬০ পয়সা বাড়ানো হয়েছে। নতুন ভাড়া এখন কিলোমিটার প্রতি হয়েছে ২ টাকা ৩০ পয়সা, যা আগে ১ টাকা ৭০ পয়সা ছিল। লঞ্চের সর্বনিম্ন ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ৩০ টাকা।

প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, সারা দেশের জনগণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, ভাড়া বাড়ানোর মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বিআরটিএ-এর যোগ্যতা কোথায়? তাদের এই বিষয়ে কী গবেষণা আছে? এই মার্কেটে তারাও একটা প্লেয়ার, তবে খুব দুর্বল। জনগণের কোটি কোটি টাকা খরচ করে তারা বিদেশ থেকে বাস কিনে এনে কয়দিন পর তা চলাচলের অযোগ্য করে সের দরে বিক্রি করে। তাদের বিআরটিসি বাসের লিজ পেতে প্রকৃত পরিবহন ব্যবসায়ীদের ভোগান্তি এবং ঘুষ দিতে হয়। তাদের ব্যর্থতার কারণে আজ গণপরিবহনে মাফিয়া রাজত্ব চলছে। এই পরিবহন মাফিয়াদের হাতে জনগণ জিম্মি হয়ে আছে। পরিবহন একটি সেবা খাত, কিন্তু সেটি আজ আচরণ করছে রাজনৈতিক গোষ্ঠীর মতো।

সারাদেশে কত গাড়ি আছে সেটা তারা সঠিক জানে না। চলাচল উপযোগী ক’টি আছে তার খবর রাখে না। ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে মানুষকে হয়রানির শিকার হতে হয়। টাকা দিলে ভুয়া লাইসেন্স পাওয়া যায়। এমন একটি বিভাগের কতিপয় কর্মকর্তা কোন স্পর্ধায় ভাড়া নির্ধারণ করেন! এখানে সংসদ কোথায়, মন্ত্রিসভা কোথায়? পরিবহন সেক্টর আজ সরকারি দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের পুঁজিতে ভরে গেছে। ঢাকা শহরের সিংগভাগ গাড়ির মালিক পুলিশ। রাস্তাঘাটে পরিবহনের অনাচার দেখার তাই কারও সাহস নেই। শ্রমিক নেতারা ঢাল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে এসব মালিকের।

তেলের দাম বাড়ানোর যৌক্তিকতা কতটুকু তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। কিন্তু সরকারি মহল থেকে যুক্তি দেওয়া হচ্ছে যে বিশ্ববাজারে তেলের দাম বেড়েছে। ২০০১ থেকে ২০০৬ সালে বিএনপির আমলে ৬ বার তেলের দাম বেড়েছে, কিন্তু গত ১৩ বছরে এই সরকার বাড়িয়েছে ৫ বার। গত ৮ বছরে ডিজেলের দাম বাড়েনি। তার পাল্টা যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছে, বিগত বছরগুলোতে, বিশেষ করে কোভিডকালে তেলের দাম কমলেও সরকার তো কমায়নি। সরকারি লোকেরা বলছে, কোভিডকালে তেলের ব্যবহারই বা কী হয়েছে, সরকার যে লাভ করবে?

তবে সরকার পক্ষ এটা স্বীকার করছে বিগত দিনের ৫২ হাজার কোটি টাকার লোকসান কাটিয়ে সরকারি জ্বালানি খাত এখন ৩২ হাজার কোটি টাকা লাভে আছে। জ্বালানি পরিবহনের খরচ এবং সিস্টেম লস কমানোর জন্য সরকার ১৩৫ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন তৈরি করছে, তার ৭০ শতাংশ কাজ হয়ে গেছে। জনগণের টাকাতেই তা হচ্ছে। জ্বালানি সেক্টরকে ভর্তুকি না দিয়ে নিজস্ব আয়ে টিকে থাকার জন্য এটি দরকার আছে।

সরকারের সংশ্লিষ্টদের ভাবা উচিত ছিল যে জ্বালানি তেল এমন একটি পণ্য, যার প্রভাব প্রত্যেক মানুষের ওপর পড়ে, পণ্যের দামে পড়ে। তেলের দাম বাড়ায় তা সরাসরি মানুষের যাতায়াত খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে। পরোক্ষভাবে কৃষিপণ্যের উৎপাদন ও সব পণ্যের পরিবহন ব্যয় বাড়ছে। যার প্রভাব পড়ে। করোনার সময়ে মানুষের একটি বড় অংশের আয় কমে গেছে। অনেকে চাকরি হারিয়েছেন। এখন জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সীমিত আয়ের মানুষের কষ্টের সীমা নেই। কিন্তু সেদিকে সরকার নজর না দিয়ে জ্বালানি সেক্টরকে লাভজনক করার কথা এখন না ভাবলেও হতো। এখানে লাভের চেয়ে সেবা দেওয়া জরুরি। কারণ, এটি সেবা সেক্টর। যেটুকু লাভ হয়েছে সেটা দিয়ে আরও কয়েক বছর লোকসান দিলেও ক্ষতি হতো না।

সবচেয়ে বড় কথা সরকার এখনও যেটুকু বাস ভাড়া বাড়িয়েছে তা যদি সঠিকভাবে মনিটর করা হয়, দেখা যাবে বাস ভাড়া আসলে বাড়েনি। পাবলিক সেখানে প্রতিবাদ করতো না। কারণ, যে ভাড়া এতদিন নেওয়া হচ্ছিল সেটাও বাড়তি ছিল। নতুন নির্ধারিত ভাড়াও সঠিকভাবে কার্যকর করা হলে দেখা যাবে যে ভাড়া তারা দিয়ে আসছে তার চেয়ে এটা কম। পরিবহন মাফিয়ারা সরকারের তদারকির অভাবে মানুষ থেকে বাড়তি ভাড়া নিচ্ছে এবং বর্ধিত ভাড়ার নামে এবার ডবল প্রতারণা করবে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

সান নিউজ/এফএইচপি

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

কোচিং সেন্টারে মিলল বিপুল অস্ত্র-বিস্ফোরক

রাজশাহী নগরীর কাদিরগঞ্জ এলাকায় একটি বাড়ি থেকে অস্ত্র ও বিস্ফোরক তৈরি সরঞ্জাম...

আলাস্কায় ট্রাম্প-পুতিন বৈঠক শেষ, যুদ্ধ স্থগিতের ঘোষণা নেই

যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কায় রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট...

কোনো চাঁদাবাজকে বাংলাদেশে থাকতে দেওয়া হবে না : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

কোনো চাঁদাবাজকে বাংলাদেশে থাকতে দেওয়া হবে না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র...

রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মালয়েশিয়ার প্রভাব কাজে লাগাতে চায় বাংলাদেশ

দীর্ঘদিনের রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা জোরদার করা...

‘গোপন রাজনীতি’, ছাত্রশিবির ও ডাকসু নির্বাচন নিয়ে উত্তপ্ত ঢাবি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গেস্টরুম সংস্কৃতি এবং এই কেন্দ্রিক নির্যাতন গত ১৫ বছরে ছি...

ফের ৯৮ বাংলাদেশিকে বিমানবন্দর থেকে ফেরত পাঠাল মালয়েশিয়া

ফের কুয়ালালামপুর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আটকে দেওয়া হয়েছে ৯৮ বাংলাদেশিকে। বিম...

‘গোপন রাজনীতি’, ছাত্রশিবির ও ডাকসু নির্বাচন নিয়ে উত্তপ্ত ঢাবি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গেস্টরুম সংস্কৃতি এবং এই কেন্দ্রিক নির্যাতন গত ১৫ বছরে ছি...

রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মালয়েশিয়ার প্রভাব কাজে লাগাতে চায় বাংলাদেশ

দীর্ঘদিনের রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা জোরদার করা...

কোনো চাঁদাবাজকে বাংলাদেশে থাকতে দেওয়া হবে না : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

কোনো চাঁদাবাজকে বাংলাদেশে থাকতে দেওয়া হবে না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র...

আলাস্কায় ট্রাম্প-পুতিন বৈঠক শেষ, যুদ্ধ স্থগিতের ঘোষণা নেই

যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কায় রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা