অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া
কেটে যাচ্ছে মেঘের ঘনঘটা, সুদিন আসতে শুরু করেছে পর্যটন শিল্পে। আগস্ট থেকে ধাপে ধাপে খুলছে দেশের বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্র, হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট, এয়ারলাইনস, ট্রাভেল এজেন্সি, ট্যুর অপারেশন ও পর্যটনসংশ্লিষ্ট অন্যান্য কার্যক্রম। যুক্তরাজ্য সরকার ৩২টি দেশকে ভ্রমণের অনুমতি দিয়েছে। ভারত ১৫ অক্টোবর থেকে বিদেশি পর্যটকদের জন্য ভিসা সেবা দেবে। এ ছাড়া প্রতিবেশী দেশগুলো ভ্রমণের ওপর বিধিনিষেধ তুলে নিতে শুরু করেছে। বাংলাদেশ সরকার পর্যটনকে গতিশীল করতে হাতে নিয়েছে বিভিন্ন যুগোপযোগী প্রকল্প। ইতিমধ্যে পর্যটন কেন্দ্রগুলো খুলে গেছে। লাখ লাখ পর্যটকে মুখরিত হচ্ছে দেশের পর্যটনস্থানগুলো। সরকার পর্যটন শিল্পের বিকাশ ও উন্নয়ন গতিশীল করতে বহুবিধ প্রকল্প হাতে নিয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩ হাজার ৬৩৪ কোটি টাকা। করোনা-পরবর্তী দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকার ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। সম্প্রতি সরকার পর্যটন শিল্পের ব্যাপক উন্নয়ন ও বিকাশের পাশাপাশি দেশি-বিদেশি পর্যটক আকর্ষণে একটি মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করছে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড। আগামী ১৮ মাসের মধ্যে এটি সম্পন্ন হবে। মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা অনুযায়ী পর্যটন উন্নয়ন কাজ পরিচালিত হবে। ২০১৬-২০২১ সালকে পর্যটন বর্ষ হিসেবে উদযাপন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। উন্নয়ন ও বিকাশের লক্ষ্যে ২০১৫-২০১৮ তিন অর্থবছরে আনুমানিক ২০০ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। এর মাধ্যমে পর্যটন শিল্পের বিদ্যমান ও সম্ভাব্য স্থানগুলোর পরিকল্পিত উন্নয়ন নিশ্চিত করা হবে। ২০২৫ সালের মধ্যে পর্যটন শিল্পের সর্বোচ্চ বিকাশে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। পুরো দেশকে আটটি পর্যটন জোনে ভাগ করে প্রতিটি স্তরে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রথমবারের মতো সরকারি-বেসরকারি যৌথ বিনিয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর অংশ হিসেবে কক্সবাজারে পর্যটন অবকাঠামো নির্মাণে ২৫টি প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এগুলোয় প্রায় প্রত্যক্ষভাবে বিনিয়োগ হবে ৩৭ হাজার কোটি টাকা। পরোক্ষভাবে বিনিয়োগ হবে ১ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া সরকারের প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে : কক্সবাজার বিমানবন্দর উন্নয়ন, আধুনিক হোটেল-মোটেল নির্মাণ, মহেশখালীতে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ, সোনাদিয়াকে বিশেষ পর্যটন এলাকা হিসেবে গড়ে তোলা, ইনানী সৈকতের উন্নয়ন, টেকনাফের সাবরাং ইকো ট্যুরিজম পার্ক নির্মাণ, শ্যামলাপুর সৈকতের উন্নয়ন, ঝিলংঝা সৈকতের উন্নয়ন, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণ, কুতুবদিয়ায় বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্পের সম্প্রসারণ, চকরিয়ায় মিনি সুন্দরবনে পর্যটকদের গমনের জন্য যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন, ডুলাহাজারা সাফারি পার্কের আধুনিকায়ন ইত্যাদি। এ ছাড়া আরও চারটি নতুন প্রকল্প নিতে যাচ্ছে সরকার। এসব বাস্তবায়ন হলে আগামীতে দেশের পর্যটন খাত আরও চাঙা হবে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতেও পিপিপির মাধ্যমে বিনিয়োগ করা হবে। এর মধ্যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কক্সবাজারে যাতায়াত করার জন্য রেললাইন নির্মাণ করা হচ্ছে। ৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে চাঁদপুরের মেঘনার চরে গড়ে তোলা হচ্ছে আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন কেন্দ্র। নির্মাণ শুরু হতে যাওয়া এ পর্যটন প্রকল্পে থাকবে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যের জাদুঘর, পানির ওপর ভাসমান কটেজ, ৪ কিলোমিটার দীর্ঘ ক্যাবল কার, ট্র্যাডিশনাল কটেজ, স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট, পাঁচ তারকা হোটেল, থিমপার্ক, রিভারক্রুজ, স্পিডবোট, হেলিকপ্টার, কনভেনশন হল, থিয়েটার, মিউজিয়াম, ইন্টারন্যাশনাল এক্সপো সেন্টার, মার্কেট, জিমনেসিয়াম, ইনডোর ও আউটডোর গেমস, ক্রিকেট অ্যারোনা, সুইমিং ক্লাব, ওয়াটার রাইড, হসপিটাল, পার্টি সেন্টার, হলিকর্নার, রিসার্চ ইনস্টিটিউট, স্টাফ রেসিডেনশিয়াল এরিয়া, এগ্রিট্যুরিজম, গ্রিন-এনার্জি, পর্যটন ডিপ্লোমা কোর্স স্কুল প্রভৃতি। ব্লু-রিভার আইল্যান্ড রিসোর্ট অ্যান্ড ট্যুরিজম ক্লাবের তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যটন কেন্দ্রে প্রতিদিন লক্ষাধিক লোকের ভ্রমণের ব্যবস্থা ও ২০ হাজার পর্যটকের রাতযাপনের সুবিধা থাকবে। প্রায় ৫ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হবে। বর্তমানে চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী পর্যন্ত রেললাইন রয়েছে। এ লাইন আরও সংস্কার করা হচ্ছে। দোহাজারী থেকে কক্সবাজার হয়ে ঘুমধুম পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে। এ খাতে বিনিয়োগ হবে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। ইতিমধ্যে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে। বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন কক্সবাজারে আরও দুটি মোটেল নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। এ খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৮০০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ বিমান ও নৌ বাহিনীর উদ্যোগে সেখানে একটি বড় গেস্টহাউস নির্মিত হচ্ছে। রামুতে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অসংখ্য ঐতিহাসিক নিদর্শন রয়েছে। ইতিমধ্যে কক্সবাজার থেকে টেকনাফ প্রায় ৮০ কিলোমিটার পর্যন্ত মেরিন ড্রাইভ সড়ক নির্মিত হয়েছে। শাহপরীর দ্বীপের নাফ নদ ও বঙ্গোপসাগরের মোহনায় গড়ে উঠেছে বিশাল চর। এখান থেকে যেমন সেন্টমার্টিন দ্বীপ দেখা যায়, তেমনি সাগর ও নদীর পানির মিলনস্থলের পার্থক্য বোঝা যায় পরিষ্কারভাবে। এগুলো পর্যটকদের কাছে তুলে ধরতে সেখানে ও একটি প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। টেকনাফ এলাকায় তৈরি হচ্ছে ইকো ট্যুরিজম পার্ক। নাফ নদের মাঝে একটি চরকে গড়ে তোলা হচ্ছে পর্যটন এলাকা হিসেবে। মহেশখালীকে পাওয়ার হাব হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে। শুধু মহেশখালীতেই বিনিয়োগ হচ্ছে লাখ কোটি টাকা। সোনাদিয়া দ্বীপ অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ পর্যটন এলাকা হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কুতুবদিয়া দ্বীপে বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প রয়েছে। এটি দেখতে অনেক পর্যটক সেখানে যান। এ কারণে একে আরও সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। কক্সবাজার ছাড়াও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিতে (পিপিপি) বাস্তবায়নের জন্য সাতটি প্রকল্প নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে পায়রা গভীর সমুদবন্দর ও বন্দরের পার্শ্ববর্তী এলাকায় পর্যটন শিল্পের বিকাশ প্রকল্প। খানজাহান আলী বিমানবন্দর নির্মাণ প্রকল্প নির্ধারণ করা হয়েছে। বর্তমান সরকারের পদক্ষেপ বিশেষ করে নাফ ট্যুরিজম পার্ক গড়ে তোলার ঘোষণা পর্যটন বিকাশকে নতুন মাত্রা সংযোজন করেছে। কারণ এতে বিনিয়োগ করছে থাইল্যান্ডের বিখ্যাত কোম্পানি সিয়ামসিয়াম ইন্টারন্যাশনাল। প্রাথমিকভাবে কোম্পানিটি ৫০ কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করবে। ২৭১ একর জায়গাজুড়ে প্রায় ৪ হাজার ২০০ কোটি টাকার এ প্রকল্পটি ১২ হাজারের বেশি লোকের কর্মসংস্থান জোগাবে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) নাফ ট্যুরিজম পার্কের উন্নয়ন কাজ হাতে নিয়েছে। সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় দেশের প্রথম পর্যটননির্ভর অর্থনৈতিক অঞ্চল হতে যাচ্ছে সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক। কক্সবাজারের টেকনাফের সাবরাং সমুদ্রতীরে এ পর্যটন অঞ্চল গড়ে উঠছে। পরিকল্পিত এ আধুনিক পর্যটন পার্কে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছেন দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তারা। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) কাছে বেশ কিছু কোম্পানির বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে। এগুলো পর্যালোচনা করে ইতিমধ্যে ১২টি কোম্পানির প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছে বেজার নির্বাহী বোর্ড। কোম্পানিগুলো পার্কের মধ্যে তারকা হোটেল, মোটেল ও রিসোর্ট নির্মাণ করবে। তাদের প্রস্তাব অনুযায়ী প্রায় সাড়ে ২৪ কোটি ডলার বা ২ হাজার ৭৭ কোটি টাকা বিনিয়োগ হবে। বেজার তথ্যানুযায়ী পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য ১ হাজার ৪৭ একর আয়তনের এ পার্কে অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধা রেখে অবকাঠামো নির্মাণ হচ্ছে। প্রস্তাব অনুমোদন পাওয়া ১২ কোম্পানি ১১৬ একর জমিতে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করবে। এতে ১০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হবে। বাংলাদেশ এভিয়েশন খাত নতুনভাবে সাজানো হচ্ছে। নতুন নতুন বিমানবন্দর স্থাপনের অনুমোদন, বিমান সংস্থাগুলোর সঙ্গে সংযোগ বৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট বৃদ্ধি, বিমানবন্দর আধুনিকায়নে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় একযোগে কাজ করছে। বাংলাদেশ পর্যটনকে আধুনিকায়নে ও আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন সেবা প্রদানের জন্য নিরলসভাবে কাজ করছে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা। যে কোনো ক্ষেত্রে উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড সম্পাদনের লক্ষ্যে, সিদ্ধান্ত গ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের ব্যবহার পারে টেকসই উন্নয়ন সম্ভাবনা নিশ্চিত করতে।
লেখক : সাবেক চেয়ারম্যান, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
 
                                     
                                 
                                         
                     
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                        
                         
                                 
                                 
                                 
                                 
                                 
                                 
                     
                             
                             
                     
                         
                                 
                                 
                                 
                                 
             
                     
                             
                             
                     
                            