মতামত

টিভিতে কী দেখবো?

নাজনীন মুন্নী

বিষয়টি আমি খেয়াল করছিলাম অনেক দিন আগেই। যেহেতু সাংবাদিকতা করি তাই কোনও বিষয়ে চট করে সিদ্ধান্ত নেওয়াটা কঠিন। তাই দিনের পর দিন আমি এই বিষয়ে পর্যবেক্ষণ করে আসছি। ফলাফল আমাকে ভীষণ রকম মন খারাপ করিয়েছে, সাথে আতঙ্কিত করেছে।

বলছি আমাদের দেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর কনটেন্টের কথা। কী দেখায় আমাদের চ্যানেলগুলো? জনগণ কি আসলেই সেসব দেখতে চায়?

প্রশ্নটা তৈরি হয়েছিল একেবারেই ব্যক্তিগত জায়গা থেকে। আমি দেখছিলাম একই জিনিস আমি করে যাচ্ছি বছরের পর বছর। চোখ যখন নিজের ওপর থেকে পুরো মিডিয়ার ওপর দিয়েছি তখন দেখেছি ঘটনা একই।

একই অনুষ্ঠান, একই ধরনের নিউজ বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে। প্রশ্ন তখনই ছিল সংবাদকর্মী হিসেবে যা আমাকে আকর্ষণ করছে না, তা কী করে জনগণকে করবে? এই প্রশ্নের উত্তর পেয়েছি আমি অনেকখানিই।

বাংলাদেশে ফেসবুক সবচেয়ে জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। এই দেশে প্রায় ৫ কোটি মানুষ বুঁদ হয়ে থাকে ফেসবুকের পাতায়। মুখ ফিরিয়ে নেওয়া দর্শক ধরে রাখতে টিভি চ্যানেলগুলো আশ্রয় নিলো ফেসবুকে। নিজের প্রচার বা বিস্তারের জন্য সবগুলো টেলিভিশন চ্যানেল ফেসবুকে তাদের নিজেদের জমি তৈরি করে ফেললো। যাকে বলে ‘ফেসবুক পেজ’।

সেখানে নিজের রাজত্বে জনগণও কম নয়। একেক চ্যানেলের ফলোয়ার ৭০ থেকে ৮০ লাখ মানুষ। একটা ছোটখাটো দেশের সমান। খুবই সুখবর আপাতদৃষ্টিতে। কিন্তু এই সব জনগণ ফেসবুকে বসে কি চ্যানেলের প্রচার করা অনুষ্ঠান দেখে? উত্তর হলো, খুবই কম।

এই যে দেখে কী দেখে না সেই হিসাব করতে জটিল টিআরপি লাগে না। ফেসবুক ভিউ তাৎক্ষণিক বলে দিচ্ছে কী দেখছে মানুষ। ফেসবুকজুড়ে নানা প্রতিষ্ঠান আর ব্যক্তিগত ব্যবসার হাট। একজন শাড়ি বিক্রেতার লাইভে যেখানে একসাথে ৬ বা ৭ হাজার মানুষ চোখ রাখছে সেখানে টেলিভিশনে প্রচারিত হওয়া কোনও শো যখন ফেসবুকে স্ট্রিমিং করা হয় সেখানে দর্শক ৩শ’ও থাকে না।

এটা তো ফেসবুকের হিসাব, বাস্তবেও কি মানুষ টিভিতে আমাদের চ্যানেল দেখে? এই প্রশ্ন আমি নিজে অনেককে করেছি, অনেকে যেচেই বলেছেন– দেখতে ইচ্ছে করে এমন কী দেখান টিভিতে? আমারও একই প্রশ্ন– কী দেখাই আমরা, যা দেখার মতো? যদি জানতে চাই চট করে, বলুন তো এই দেশের জনপ্রিয় একটা শো বা অনুষ্ঠানের নাম। আমি নিশ্চিত বেশিরভাগ মানুষই পারবেন না। আমরা যারা কাজ করি গণমাধ্যমে, তারাও পারবো না।

এই দেশের অধিকাংশ চ্যানেলে বাধ্যতামূলক টকশো আর নিউজ। প্রতিঘণ্টার নিউজে এমন নতুনত্ব বা বৈচিত্র্য থাকে না যা সারা দিন-রাত মানুষকে ধরে রাখতে সাহায্য করে। যেকোনও এক চ্যানেলের খবর দেখলেই আপনি বুঝতে পারবেন কী ঘটছে দেশ-বিদেশে।

একজন আরেকজনকে অনুকরণ করাই আমাদের প্রধানতম কাজ। কয়েকটি নিউজ চ্যানেল আছে যেখানে প্রায় সব একই। হঠাৎ যদি লোগো মুছে দেন আমি নিশ্চিত অনেকেই বুঝতে পারবেন না কোনটা কোন চ্যানেল।

এই দুর্দশা তো একদিনে হয়নি। হয়েছে বছরের পর বছর। একুশে টিভি এই দেশে এক দারুণ পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল। ঘটনা ২১ বছর আগের। সেই সময় একুশে টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ যাদের তৈরি করেছিলেন তারাই এ দেশের ৩২ টি চ্যানেলের সাথে নানাভাবে কাজ করছেন। ২১ বছর আগের সময় আর এখনকার চাহিদা কি এক? ২১ বছর আগে মানুষ যা দেখে বাহবা দিয়েছে বা মুগ্ধ হয়েছে এই সময়ে তা-ই দেখতে চাইবে- এই ধারণা কীভাবে আমরা ধরে রাখলাম?

চ্যানেল মানেই এক বা একাধিক টকশো, সেখানে যারা গেস্ট থাকেন তারাও সবাই সব চ্যানেলে কথা বলেন। একই কথা ঘুরে ফিরে সব জায়গায়। টকশোর বাইরে কোনও অনুষ্ঠান কি চ্যানেলগুলোতে খুঁজে পায় না। বিনোদন কোথায় পাবে মানুষ? ‘ইত্যাদি’র মতো ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান বা ‘সংশপ্তক’ বা ‘কোথাও কেউ নেই’- এর মতো নাটক কি এই দেশে কেউ বানায় এখন?

নিজেদের যদি স্বকীয়তা না থাকে তাহলে অন্তত ‘কৌন বনেগা ক্রোড়পতি’ বা ‘সা রে গা মা পা’ বা ‘আমেরিকান আইডল’ কেন আমরা অন্তত বানানোর চেষ্টা করি না বা অন্তত একটা রান্নার প্রতিযোগিতা?

আসলে আমরা কি চেষ্টা করি কোনও? এই দেশে মেধাবী মানুষের অভাব নেই। তাদের কাছ থেকে আদায় করার কষ্টটাই আমরা হয়তো কেউ নেই না। কারণ, আমাদের কাছে ৩ জনকে এনে কথা শোনা সবচেয়ে সহজ। ‘দামে কম, মানে ভালো’ টাইপ।

দিন বদলায়, সাথে মানুষের রুচি, সাথে কারা টিভি দেখে সেই গোষ্ঠীও। আমরা যারা চ্যানেলগুলো নিয়ন্ত্রণ করি তারা কি জানি যে ২০ বছরের একজন তরুণ কী দেখতে চায়, তার মনোজগৎ কী? আমরা কি জানতে চাই আমার বাসার মা থেকে শুরু করে কাজের সহকারী মানুষটি একযোগে কোন লোভে ভারতীয় চ্যানেলে আটকে থাকে? আমরা কি জানতে চাই এ দেশের প্রায় ৪ কোটি শিশু আছে; তারা কী দেখতে চায়? আমরা কি কিছু জানতে চাই?

প্রায়ই মনে হয় আমরা চাই না। অল্প টাকায় কয়েকজন কর্মী দিয়ে আমরা কেবল অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে চাই, যাতে নিজেদের নানা প্রয়োজনে এই চ্যানেলগুলো ব্যবহার করতে পারি এই কারণে। পুরো ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আগে আমরা কি একবার জনগণের দিকে তাকাবো নাকি ঘরের টিভিকে কেবল ‘বাক্স’ হিসেবে দেয়ালে ঝুলাবো সেই সিদ্ধান্ত এখন কেবলই আমাদের। সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে দ্রুত।

লেখক: সাংবাদিক

সান নিউজ/এফএআর

সূত্র বাংলা ট্রিবিউন

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

চাকরি হারিয়ে জি-নাইন কলা চাষে ভাগ্যবদল  

বাগেরহাটের ফকিরহাটে জি-নাইন (গ্রান্ড নাইন) জাতের কলা চাষ করে আলোচনায় এসেছেন স...

মোরেলগঞ্জে সেতুর অভাবে দুর্ভোগে ৫ লাখ মানুষ

মোরেলগঞ্জে পানগুছি নদীটিতে ব্রিজ না থাকায় সুন্দরবনের উপকূলের মোরেলগঞ্জ ও শরণখ...

ঢাকাই সিনেমার নব্বইয়ের দশকের চিত্রনায়িকা বনশ্রী মারা গেছেন।

ঢাকাই সিনেমার নব্বইয়ের দশকের চিত্রনায়িকা বনশ্রী মারা গেছেন। মঙ্গলবার সকাল মাদ...

সৌন্দর্যের লীলাভূমি ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন

অপার প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর সুন্দরবন যারা দেখেননি তারা ছুটিতে বেড়িয়ে যেতে প...

ফিরে দেখা ৬২'র শিক্ষা আন্দোলন

১৯৬২ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর ঐতিহাসিক শিক্ষা দিবস। শিক্ষার অধিকার আদায়ে এই দিনেই...

এনসিপি রাজনীতিতে নয়া সমীকরণ

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকাশ করা তরুণদের নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয়...

পটুয়াখালী পাওয়ার প্লান্টে ভয়াবহ আগুন

পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার ধানখালীতে সম্প্রতি চালু হওয়া পটুয়াখালী ১৩২০ মেগাওয়...

ছাত্রদল নেতাকে চাঁদা না দেয়ায় যুবদল নেতার ওপর হামলা, উত্তাল ভালুকা!

আনন্দ মোহন কলেজ ছাত্রদলের সাবেক সহ-সভাপতি মাহমুদুর রহমান মাহমুদের কাছে ময়মনসি...

ফিরে দেখা ৬২'র শিক্ষা আন্দোলন

১৯৬২ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর ঐতিহাসিক শিক্ষা দিবস। শিক্ষার অধিকার আদায়ে এই দিনেই...

সৌন্দর্যের লীলাভূমি ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন

অপার প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর সুন্দরবন যারা দেখেননি তারা ছুটিতে বেড়িয়ে যেতে প...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা