মতামত

বৈধতার সংকটে তালেবান

আফ্রাসিয়াব খটক : আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়ার পর দেশটিতে বিস্ময়কর দ্রুততায় তালেবানের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় আফগানরা একেবারেই হতবাক। তারা চার দিন ধরে তালেবানের নৃশংস শাসনে গভীর আর্তনাদ করছে। এই পরিস্থিতিতে তালেবান নেতারা বৈধতার সংকটে পড়েছেন।

এই চ্যালেঞ্জের কথা মাথায় রেখেই দেশটিতে ভবিষ্যৎ তালেবান শাসনের প্রকৃতি সম্পর্কে জানাতে সংগঠনটির প্রধান মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ গত মঙ্গলবার কাবুলে প্রথম সংবাদ সম্মেলন করেন। অজ্ঞাত স্থান থেকে যিনি অনেক বছর ধরে তালেবানের আত্মঘাতী বোমা হামলাসহ বিভিন্ন হামলার দায় টেলিফোনে স্বীকার করতেন, তিনি প্রথমবারের মতো কাবুলে গণমাধ্যমের সামনে শারীরিকভাবে উপস্থিত হলেন।

সংবাদ সম্মেলনে জাবিউল্লাহ মুজাহিদ তালেবানের সন্ত্রাসের কলঙ্কিত অতীতকে ঢাকাতে সচেষ্ট ছিলেন। তিনি তালেবানকে একটি মধ্যপন্থী শক্তি হিসেবে দেখাতে চেয়েছেন, যারা তার বিরোধীদের ক্ষমা করার জন্য প্রস্তুত। তিনি নারীর অধিকার-সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন সতর্কতার সঙ্গে। দাবি করেছেন, তালেবানের ইসলামিক আমিরাত মেয়েদের শিক্ষা অর্জনের অনুমতি দেবে। শরিয়া অনুযায়ী নারীদের কাজ করতে দেবে।

এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে শরিয়ার ক্ষেত্রে তালেবান তাদের নিজস্ব কঠোরতা ও ব্যাখ্যার ওপর জোর দেয়।

গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে জাবিউল্লাহ মুজাহিদ তিনটি শর্তের কথা বলেছেন। এক, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ইসলামি মূল্যবোধের লঙ্ঘন করবে না। দুই, গণমাধ্যমকে নিরপেক্ষ হওয়া উচিত (তালেবানবিরোধী হওয়া উচিত নয়, সে বিষয়ে ইঙ্গিত)। তিন, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা জাতীয় ঐতিহ্যকে অপমান করবে না।

তালেবানের ইসলামিক আমিরাতের সরকার গঠনে সব পক্ষের অন্তর্ভুক্তির জন্য সবার সঙ্গে আলোচনার কথা উল্লেখ করেছেন জাবিউল্লাহ মুজাহিদ। তিনি এই অঞ্চল ও বিশ্বকে আশ্বস্ত করেন, তাঁরা আফগান মাটিকে অন্য কোনো দেশের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে দেবেন না।

এই সংবাদ সম্মেলনে হাজির সাংবাদিকেরা ভবনের চারপাশে বন্দুকধারী তালেবানের উপস্থিতি সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। তালেবানের বর্তমান যুদ্ধের সঙ্গে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সন্ত্রাসী নেটওয়ার্কের জড়িত থাকাসহ কঠিন বিষয়ে তাঁরা প্রশ্ন করতে পারেননি।

১৯৯৪ সালে যখন মোল্লা ওমরের নেতৃত্বে তালেবানের একটি দল প্রথম কান্দাহারে উপস্থিত হয়, তখন তাদের কোনো অতীত রাজনৈতিক হঠকারিতা ছিল না। তারা অজনপ্রিয় মুজাহিদিন যুদ্ধবাজদের চ্যালেঞ্জ জানাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, যারা নিজেদের মধ্যে লড়াই, হত্যা, নির্যাতন, চাঁদাবাজি ও অপহরণের মাধ্যমে সাধারণ আফগানদের জীবনকে নরকে পরিণত করেছিল। সেই পর্যায়ে তালেবান ক্ষমতার খেলায় আগ্রহী নয়, এমন একটি তৃণমূল আন্দোলনকারী সংগঠনের বলে ভান ধরেছিল।

কিন্তু ১৯৯৬ সালের সেপ্টেম্বরে পাকিস্তান যখন তালেবানের কাবুল দখলকে সমর্থন করে, তখন তারা কোনো সংবিধান বা যথাযথ রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রবর্তন না করেই আফগানিস্তানে সন্ত্রাসের রাজত্ব শুরু করে।

এ কারণে এবার তালেবান অন্তত তিনটি ক্ষেত্রে বিশ্বাসযোগ্যতার একটি গুরুতর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে।

প্রথমত, ১৯৯০-এর দশকে তালেবানের ইসলামিক আমিরাতের নিষ্ঠুর-নিপীড়ক-অসহিষ্ণু শাসন নারী, জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নৃশংসতার জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ আফগান এবং বিশ্বে ব্যাপকভাবে নিন্দিত হয়।

সেই অতীত নিয়ে বর্তমান আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের পথে অগ্রসরমাণ আফগানিস্তানের উপযুক্ত নেতৃত্ব হিসেবে নিজেদের যথার্থতা তারা কীভাবে তুলে ধরবে?

দেশটির প্রতিটি কোণে কয়েক ডজন শহুরে কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক সময়ে আফগান গণমাধ্যম এই অঞ্চলের সবচেয়ে স্বাধীন গণমাধ্যম হয়ে উঠেছে। আফগান নারীরা রাজনীতি, অর্থনীতি, কূটনীতি, শিল্প, সংস্কৃতিসহ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করতে শুরু করেছে। বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রায় ১ কোটি শিক্ষার্থী রয়েছে। কীভাবে সমাজের এই অংশগুলোকে আবার অন্ধকার যুগে ঠেলে নেওয়া যায়?

তালেবানদের পাকিস্তানি ও পশ্চিমা আত্মপক্ষ সমর্থনকারীরা একটি ‘পরিবর্তিত তালেবান’ সম্পর্কে লম্বা দাবি করছে। কিন্তু তালেবান তাদের অতীতের নৃশংসতার জন্য দুঃখপ্রকাশ সূচক একটা কথা পর্যন্ত বলেনি। তাদের সম্পর্কে বিশ্বের যে দৃষ্টিভঙ্গি, বর্তমান সামরিক অভিযানের সময়ও তাতে তারা কোনো পরিবর্তন আনেনি।

দ্বিতীয়ত, তালেবান শুরু থেকেই বিদেশি সন্ত্রাসী নেটওয়ার্কের সঙ্গে দৃঢ় বন্ধন গড়ে তুলেছিল। কারণ, তারা সাবেক মুজাহিদিন আমল থেকে আল-কায়েদা, কিছু পাকিস্তানি ও মধ্য এশীয় সন্ত্রাসী সংগঠনের উপস্থিতি উত্তরাধিকার সূত্রেই পেয়েছে।

প্রকৃতপক্ষে এই কারণটি আফগানিস্তানকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের কেন্দ্র ও পরবর্তী সময়ে একটি আন্তর্জাতিক যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করেছে।

মজার বিষয় হলো, তালেবানের সঙ্গে বিতর্কিত দোহা চুক্তিকে যুক্তরাষ্ট্র এই বলে সমর্থন করে যে তালেবান আল-কায়েদার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ছিন্ন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তারা যুক্তরাষ্ট্রকে আশ্বস্ত করেছে যে কোনো সন্ত্রাসী সংগঠনকে আফগান মাটি যুক্তরাষ্ট্র বা তার মিত্রদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে দেবে না।

কিন্তু জাতিসংঘের প্রতিবেদনে দেখা যায়, তালেবান আল-কায়েদা, আইএমইউ, ইটিআইএম, টিটিপি ও অন্যদের শুধু অতিথি হিসেবে সঙ্গে নেয়নি, বরং তারা তাদের যুদ্ধের কাজেও লাগিয়েছে। এই নেটওয়ার্কগুলো অবশ্যই সেখানে পিকনিকের জন্য যায়নি।

তৃতীয়ত, আফগানিস্তানে তালেবানের বিশ্বাসযোগ্যতার জন্য সবচেয়ে কঠিন প্রশ্ন হলো, পাকিস্তানের সঙ্গে তাদের সংযোগ।

চার দশক ধরে পাকিস্তানে বসবাসরত আফগান শরণার্থী পরিবারগুলো থেকে অধিকাংশ তালেবান যোদ্ধা এসেছে। এমনকি তাদের অধিকাংশই পাকিস্তানে জন্মগ্রহণ করেছে। তালেবানের সঙ্গে তাদের সংযোগ গড়ে ওঠে বিভিন্ন মাদ্রাসার মাধ্যমে। ১৯৮০-এর দশকে আফগান জিহাদের সময় ডলার ও পেট্রোডলারে প্রায় ৩৬ হাজার মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। দরিদ্র আফগান শরণার্থী পরিবারগুলোর তাদের সন্তানদের আধুনিক স্কুলে পাঠানোর সামর্থ্য নেই। দুর্ভাগ্যবশত পাকিস্তান রাষ্ট্র তার লম্বা দাবি সত্ত্বেও মাদ্রাসা ব্যবস্থার সংস্কার করেনি। বিশেষ করে পাঠ্যক্রম, যার লক্ষ্য ধর্মীয় জঙ্গিবাদের জন্য তরুণদের মগজধোলাই করা।

৯/১১ পর্যন্ত পেশোয়ার, কোয়েটার মতো পাকিস্তানি শহরে আফগান তালেবানের অফিসগুলো প্রকাশ্যে পরিচালিত হতো। পরে তালেবান নেতৃত্ব আত্মগোপনে যায়। তারা পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার সুরক্ষাবলয়ে থাকে বলে জানা যায়।

তালেবান শাসনের পতনের পর তাদের নেতৃত্ব ও অনুসারীরা পাকিস্তানে আসে। সেখানে তাদের শুধু পুনর্গঠিত হওয়ারই সুযোগ দেওয়া হয়নি, আফগানিস্তানে মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনীর বিরুদ্ধে তাদের নতুন যুদ্ধে পূর্ণ সমর্থনও দেওয়া হয়।

পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশের রাজধানী কোয়েটায় তালেবানের সমান্তরাল সরকার পরিচালিত হয়েছিল, যা পাকিস্তানি সরকারগুলোকে জোরালোভাবে অস্বীকার করার শামিল।

তালেবানের প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা ওমর করাচিতে মারা যান বলে শোনা যায়। তাঁর উত্তরসূরি প্রয়াত মোল্লা আখতার মনসুর ও বর্তমান আমির হাবিতুল্লাহ আখুনদজাদা কোয়েটায় ছিলেন।

তালেবান নেতারা পাকিস্তানি পাসপোর্টে ভ্রমণ করে আসছেন। পাকিস্তানে তাঁদের সহায়সম্পত্তি আছে বলে জানা যায়।

পাকিস্তানি জেনারেলরা আফগানিস্তানে তাঁদের ‘কৌশলগত গভীরতা’ অর্জনের নীতি বাস্তবায়নে তালেবানকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে খুবই আগ্রহী। তারা কি পাকিস্তানের সঙ্গে তাদের নাড়ির বন্ধন ছিন্ন করতে পারে, সেটি একটি মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন।

লেখক : আফ্রাসিয়াব খটক, পাকিস্তানের সাবেক সিনেটর ও আঞ্চলিক রাজনীতিবিষয়ক বিশ্লেষক।

সান নিউজ/এনএম

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

কোচিং সেন্টারে মিলল বিপুল অস্ত্র-বিস্ফোরক

রাজশাহী নগরীর কাদিরগঞ্জ এলাকায় একটি বাড়ি থেকে অস্ত্র ও বিস্ফোরক তৈরি সরঞ্জাম...

আলাস্কায় ট্রাম্প-পুতিন বৈঠক শেষ, যুদ্ধ স্থগিতের ঘোষণা নেই

যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কায় রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট...

কোনো চাঁদাবাজকে বাংলাদেশে থাকতে দেওয়া হবে না : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

কোনো চাঁদাবাজকে বাংলাদেশে থাকতে দেওয়া হবে না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র...

রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মালয়েশিয়ার প্রভাব কাজে লাগাতে চায় বাংলাদেশ

দীর্ঘদিনের রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা জোরদার করা...

‘গোপন রাজনীতি’, ছাত্রশিবির ও ডাকসু নির্বাচন নিয়ে উত্তপ্ত ঢাবি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গেস্টরুম সংস্কৃতি এবং এই কেন্দ্রিক নির্যাতন গত ১৫ বছরে ছি...

ফের ৯৮ বাংলাদেশিকে বিমানবন্দর থেকে ফেরত পাঠাল মালয়েশিয়া

ফের কুয়ালালামপুর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আটকে দেওয়া হয়েছে ৯৮ বাংলাদেশিকে। বিম...

‘গোপন রাজনীতি’, ছাত্রশিবির ও ডাকসু নির্বাচন নিয়ে উত্তপ্ত ঢাবি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গেস্টরুম সংস্কৃতি এবং এই কেন্দ্রিক নির্যাতন গত ১৫ বছরে ছি...

রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মালয়েশিয়ার প্রভাব কাজে লাগাতে চায় বাংলাদেশ

দীর্ঘদিনের রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা জোরদার করা...

কোনো চাঁদাবাজকে বাংলাদেশে থাকতে দেওয়া হবে না : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

কোনো চাঁদাবাজকে বাংলাদেশে থাকতে দেওয়া হবে না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র...

আলাস্কায় ট্রাম্প-পুতিন বৈঠক শেষ, যুদ্ধ স্থগিতের ঘোষণা নেই

যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কায় রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা