মতামত

পরীমনি বন্দী, আমরা কি মুক্ত

নিশাত সুলতানা : সম্প্রতি চিত্রনায়িকা পরীমনিকে আটক করা হয়েছে। স্বল্প সময়ের ক্যারিয়ারে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা পরীমনি হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে হঠাৎই যেন সশব্দ মাটিতে আছড়ে পড়েছেন। তাঁর পতনের সেই শব্দ এতটাই তীব্র আর বিস্তৃত যে তা যেন কিছুতেই থামতে চাইছে না। এত দিন যে পরীর সংস্পর্শে অনেকেই আমোদিত, আহ্লাদিত হয়েছেন, আজ যেন তাঁদের অধিকাংশই সেই চিহ্ন মুছে ফেলতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। পরীমনি অপরাধী সমাজের চোখে, আইনের চোখে। তবে মজার ব্যাপার হলো, পরীমনির সঙ্গে সম্পর্কিত অপরাধের আকর্ষণও এতটাই প্রবল যে সেসব অপরাধ উল্টিয়ে-পাল্টিয়ে দুর্গন্ধ গায়ে মাখতে সামান্যতম অপরাধবোধও জন্ম নিচ্ছে না আমাদের মনে। অন্যের অপরাধ নিয়ে আস্ফালন করতে করতে আমরা নিজেরা যে কখন নিজেদের সীমা লঙ্ঘন করছি, সে বিবেচনাবোধটুকুও যেন আজ হারিয়ে গেছে আমাদের। অন্যের অপরাধের চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে করতে নিজেরাই নিজেদের অজান্তে আজ অপরাধীতে পরিণত হয়েছি। শুধু পরীমনির ঘটনায়ই নয়; মিন্নি, পাপিয়া, ডা. সাবরিনাসহ সাম্প্রতিক এই ধরনের প্রায় প্রতিটি ঘটনায় আমরা দেখছি এই নোংরামি।

সম্প্রতি গ্রেপ্তার হওয়া পরীমনি কিংবা অভিনয়শিল্পী বা মডেল পরিচয়ের যেসব নারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাঁদের কী অবলীলায় ‘রাতের রানি’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে কিছু সংবাদমাধ্যম কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, তা আমরা দেখেছি। মজার ব্যাপার হলো, ‘রানি’ হিসেবে পরিচয় লাভ করতে হলে রাজার পরিচয় কিন্তু অপরিহার্য। অথচ অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করলাম, সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোয় পাবলিক, সংবাদমাধ্যম এমনকি আইন প্রয়োগকারী সংস্থাও যেন রাজাদের পরিচয় নিয়ে তেমন একটা বিচলিত নন। রানিকে নিয়েই চারদিকে চলছে তুলকালাম কাণ্ড।

আহা! সর্বক্ষেত্রেই যদি এমনটা হতো, তবে নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে এত দিন এত কাঠখড় পোড়াতে হতো না। ‘রাতের রানি’দের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ নানা মাধ্যমে, নানাভাবে উন্মুক্ত করে বিকৃত আনন্দ নেওয়া মানুষগুলো রাজাদের উন্মুক্ত করতে অনিচ্ছুক। অথচ এই রাজাদের রাজত্ব আছে বলেই প্রায় প্রত্যেক নারী রাস্তায় কিংবা বাসে যৌন হয়রানির শিকার হন, কর্মক্ষেত্রে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা কিংবা সহকর্মীর হাত নারীর শরীর ছুঁয়ে যায়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রী শিক্ষকের হাতে লাঞ্ছনা কিংবা ধর্ষণের শিকার হন। দিনে-রাতে রাজারা সর্বত্র ঘুরে বেড়ান বলেই হয়তো আমরা রাজার প্রতি আগ্রহ হারিয়েছি। রাজাদের অনেকেই হয়তো বাস করেন আমাদের চেনাজানা পরিসরেই।

পরীমনির উত্থান কিংবা পতনের কাহিনি আজ আমাদের সবার জানা। আমরা জেনেছি, পরীকে সঠিক পথে পরিচালনা করার কেউ ছিল না। শৈশবে মা-বাবা হারানো পরীমনির অপরিকল্পিত ও ছন্নছাড়া জীবনে বারবার এসেছে প্রেম, প্রলোভন আর ওপরে ওঠার সিঁড়ির হাতছানি। তবে এসব হাতছানি যে শুধু পরী কিংবা পরীর মতো মেয়েদের জীবনেই এসেছে বা আসে, তা কিন্তু নয়। প্রায় প্রত্যেক নারীর জীবন এ ধরনের অভিজ্ঞতায় পরিপূর্ণ। শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য পেরিয়ে নারীর জীবনপরিক্রমায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে নানান প্রলোভন, অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত পুরুষের নির্লজ্জ স্তুতি, প্রেমের আবেদন-নিবেদন কিংবা যৌনতার ইঙ্গিত। যেসব নারী এই সব পায়ে ঠেলে, ভারসাম্য বজায় এগিয়ে যেতে পারেন, তাঁরাই টিকে থাকেন।

অবাক করা বিষয় হলো, জীবনের ভারসাম্য রক্ষার এই জটিল যুদ্ধজয়ের জন্য নারীর না আছে কোনো সামাজিক সুরক্ষার আয়োজন, না আছে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। যুদ্ধজয়ের এই সব অস্ত্র প্রত্যেক নারী স্বকীয়ভাবে তৈরি করেন, তাঁর ব্যক্তিগত পরিস্থিতি মাথায় রেখে। কাজটি কিন্তু মোটেও সহজ নয়। অথচ ভারসাম্য রক্ষা করতে গিয়ে পা পিছলে গেলে কিংবা ভুল পথে পা বাড়ালে সেসব নারীর দায় নেয় না সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের কেউ। টিকে থাকার এই লড়াই যেন নারীর একান্তই একার। আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলতে পারি, যুদ্ধজয়ের এই কৌশল যদি নারী রপ্ত করতে না জানতেন, তবে অনেক পুরুষের সঙ্গেই আজীবনের জন্য সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যেত নারীর। পুরুষেরা তো বটেই, নারীরাও কখনো বিষয়টি তলিয়ে দেখেন বলে মনে হয় না। একটু তলিয়ে দেখলে পরীমনি আটক–পরবর্তী সংবাদ শিরোনামে অন্তত নারীরা নোংরা মন্তব্যে মেতে উঠতেন না।

আজ আমরা যারা পরীমনির আটক হওয়ার ঘটনায় স্বস্তি পাচ্ছি কিংবা সস্তা চটকদার সংবাদ পড়ে অথবা নির্লজ্জ মন্তব্য করে নিপাট আনন্দ লাভ করছি, তারা কেউ কিন্তু বিপদের আশঙ্কা থেকে মুক্ত নন। বিত্তশালীদের প্রতারণার ফাঁদ, মিডিয়া ট্রায়াল, প্রমাণিত হওয়ার আগেই অভিযুক্ত ব্যক্তিকে সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন করা এবং সর্বোপরি নারীর প্রতি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ক্রোধের আগুন ভীতিকর এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। তাই সতর্ক থাকতে হবে।

অন্যদিকে প্রযুক্তির সহজলভ্যতা, প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রণহীন ব্যবহার আর ব্যক্তিগত বিষয়কে সবার সামনে নিয়ে আসার বর্তমান প্রবণতার কাছে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ছে আমাদের জীবন। তাই প্রতিবাদ জানাতে হবে সস্তা মিডিয়ার অসভ্যতার বিরুদ্ধে, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা সর্বসমক্ষে প্রকাশের বিরুদ্ধে। শুধু অপরাধী নয়, আমাদের আওয়াজ তুলতে হবে অপরাধ আর অপরাধের প্ররোচনাকারীদের বিরুদ্ধেও। নতুবা দিন দিন সংকীর্ণ হয়ে আসবে আমাদের গণ্ডি। শুধু কারাগারে থাকলেই বন্দী হয় না মানুষ; বরং বন্দিত্ব মানে দম বন্ধ করা ভীতিকর এক পরিবেশ, যেখানে প্রতি মুহূর্তে নিশ্বাস ফেলে অনিষ্ট আর অপমানের আশঙ্কা।

লেখক : নিশাত সুলতানা, লেখক ও উন্নয়নকর্মী।

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী পান্নার গণসংযোগ

রাজীব চৌধুরী, কেশবপুর : আসন্ন কেশবপুর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে...

বোয়ালমারীতে স্বর্ণের কারিগরকে কুপিয়ে জখম

কামরুল সিকদার, বোয়ালমারী (ফরিদপুর) : ফরিদপুরের বোয়ালমারীতে...

বজ্রপাতের সময় করণীয়

লাইফস্টাইল ডেস্ক: চলমান তাপপ্রবাহ...

নিজ্জর হত্যায় সন্দেহভাজন ৩ জন গ্রেফতার 

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: কানাডায় বসবাসর...

ইন্দোনেশিয়ায় বন্যা-ভূমিধস, নিহত ১৫

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: ইন্দোনেশিয়ার ম...

কেমব্রিজ পরীক্ষায় ডিপিএস শিক্ষার্থীদের সাফল্য

নিজস্ব প্রতিবেদক: সম্প্রতি প্রকাশ...

ফরিদপুরে স্টপেজের দাবিতে মানববন্ধন 

বিভাষ দত্ত, ফরিদপুর: ফরিদপুরে রেল...

পাবনায় আন্তর্জাতিক মিডওয়াইফ দিবস পালিত

পাবনা প্রতিনিধি: ‘জলবায়ু স...

অস্ট্রেলিয়া গেলেন বিমানবাহিনী প্রধান

নিজস্ব প্রতিবেদক: সরকারি সফরে অস্...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা