ঢাকার হৃদয়ে অবস্থিত কড়াইল বস্তিতে আবারও আগুন। মঙ্গলবার বিকেলে শুরু হওয়া অগ্নিকাণ্ড কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানেই ঘরবাড়ি, দোকান, ছোট ব্যবসা সবকিছু পুড়িয়ে ছাই করে দেয়। ফায়ার সার্ভিসের ইউনিটগুলো ঘটনাস্থলে পৌঁছালেও সংকীর্ণ পথ, পানির সীমাবদ্ধতা, এবং ঘরগুলোর কাছাকাছি অবস্থানের কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। অন্ধকার নামার সাথে সাথে পরিষ্কার হয়- শত শত পরিবার রাতটা আর নিজেদের ঘরে ফিরতে পারছে না।
ঢাকা শহর এমন আগুন নতুন দেখেনি; কড়াইলসহ বেশ কিছু বস্তি এলাকায় প্রায়ই এমন ঘটনা ঘটে। তবে প্রতিটি অগ্নিকাণ্ডের পরই একদল মানুষ একই প্রশ্ন তোলে: “এটা কি কেবল আগুন? নাকি অন্য কিছু ঘটছে?” এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
ঘটনার পর কিছুক্ষণের মধ্যেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, স্থানীয় মানুষের মন্তব্য, এমনকি বিভিন্ন মহলের প্রতিক্রিয়ায় একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে- মানুষ সন্দেহ করছে। সন্দেহের কেন্দ্রীয় উপাদানটি হলো সম্ভাব্য হাইটেক পার্ক নির্মাণ। বহু বছর ধরেই কড়াইল বস্তি ঢাকা শহরের অন্যতম মূল্যবান এলাকায় অবস্থিত হওয়ায় সেখানে জমি-স্বার্থ, পুনর্বিন্যাস পরিকল্পনা, এবং বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহের কথা শোনা যায়।এই আগুনের পর কিছু বাসিন্দা বলেন, আগেই নাকি ছোট ছোট বৈঠকে ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল- এলাকা “খালি রাখতে হবে”, “পরিবর্তনের সময় এসেছে”, এমনকি “পুনঃবিন্যাস হবে” এই ধরনের কথাবার্তা। আবার কেউ কেউ দাবি করেন, কয়েকজন অচেনা ব্যক্তি আগুনের আগের সপ্তাহে এসে “ঘর সরানোর নির্দেশনামূলক মন্তব্য” করেছেন। যদিও এসবই মৌখিক তথ্য; এর সমর্থনে কোনো সরকারি নথি বা স্বীকৃত সিদ্ধান্ত এখনো পাওয়া যায়নি।তবুও জনমনে প্রশ্ন থেকেই যায়—সন্দেহ কি ভিত্তিহীন? নাকি কোনো চাপের প্রতিধ্বনি?
সরকার এবং প্রশাসনের পক্ষ থেকে এসব গুঞ্জন সরাসরি নাকচ করা হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস বলেছে, আগুনের কারণ এখনো নিশ্চিত নয়; বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে শুরু করে গ্যাসের চুলা- যে কোনো উৎস হতে পারে। পুলিশ জানিয়েছে, নাশকতার কোনো প্রাথমিক প্রমাণ তাদের হাতে নেই।সরকারি কর্মকর্তারা আরও একটি বিষয় পরিষ্কার করেছেন, হাইটেক পার্ক নির্মাণের মতো বড় প্রকল্প কোথাও হলে তাকে ঘিরে আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া থাকে: ভূমি অধিগ্রহণ, বাজেট অনুমোদন, উন্নয়ন সংস্থার সম্পৃক্ততা, প্রজ্ঞাপন ইত্যাদি। তারা বলছেন, “কড়াইলে এমন কোনো প্রক্রিয়া চলমান নেই,” এবং আগুনকে কেন্দ্র করে অপপ্রচার ছড়ানো হলে তদন্তের ওপর প্রভাব পড়তে পারে।
সুশীল সমাজের বহু প্রতিনিধির মন্তব্য হলো, “সন্দেহের উৎস ভুল নয়, তবে প্রমাণ ছাড়া সিদ্ধান্তে পৌঁছানোও ঠিক নয়।” তাদের বক্তব্য, ঢাকার বস্তিগুলোর ইতিহাসই এমন যে প্রতিটি বড় অগ্নিকাণ্ডের পরই পুনর্বাসনহীন উচ্ছেদ, জমি নিয়ে প্রতিযোগিতা, অথবা বৃহৎ উন্নয়ন প্রকল্পের গুজব ছড়িয়ে পড়ে।নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, কড়াইল বস্তি দীর্ঘদিন থেকেই শহর পরিকল্পনার একটি ‘গ্রে জোন’। এখানে ঘনবসতি, অস্থায়ী আবাসন, অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ, পানি সংকট- সব মিলেই আগুনের ঝুঁকি খুব বেশি। তাদের যুক্তি, এই ঝুঁকি কমাতে কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণে বারবার একই ঘটনা পুনরাবৃত্তি ঘটছে।তবে বিশেষজ্ঞদের আরেকটি পর্যবেক্ষণ হলো, প্রতিটি তদন্ত দীর্ঘায়িত হয়, প্রতিবেদন প্রকাশ পায় না, দায়ী কেউ চিহ্নিত হয় না। ফলে মানুষের মনে সন্দেহ স্বাভাবিকভাবেই বাড়ে।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, আগুন দুর্ঘটনা হোক বা পরিকল্পনা- ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন এখন সবচেয়ে জরুরি। একই সঙ্গে তারা দাবি তুলছে, স্বাধীন তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে, যেখানে সরকারি কর্মকর্তাদের পাশাপাশি নাগরিক প্রতিনিধি, গবেষক ও মানবাধিকার আইনজীবীরা থাকবেন।তারা আরও প্রশ্ন তুলছে, “কেন বারবার সবচেয়ে মূল্যবান জমির বস্তিগুলোতেই বড় আগুন লাগে? কেন তদন্ত প্রতিবেদন জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয় না? এভাবে কি মানুষের আস্থা ফিরে আসবে?”তাদের বক্তব্য, আগুন নিভে যাওয়ার পর মূল সত্য আরও অদৃশ্য হয়ে যায়—এটাই সবচেয়ে বিপজ্জনক।
কড়াইলের আগুন মানুষের ঘর পুড়িয়েছে, কিন্তু তার চেয়েও বড় ক্ষতি করেছে তাদের নিরাপত্তাবোধে। আগুন নিভে গেলেও যে প্রশ্নগুলো দাউ দাউ করে জ্বলছে- সেগুলো এখনো অমীমাংসিত।এই অগ্নিকাণ্ড কি সত্যিই একটি দুর্ভাগ্যজনক দুর্ঘটনা- নাকি শহরের জমি-রাজনীতির অদৃশ্য খাতায় নতুন কোনো পরিকল্পনার মাত্র প্রথম পৃষ্ঠা? তদন্ত হয়তো তথ্য দেবে। কিন্তু শহরের রাজনীতিতে সব তথ্য কি কখনো প্রকাশ পায়?
এই প্রশ্নই কড়াইলের ধোঁয়ার মতো—আকাশে মিলিয়ে যায় না।