আন্তর্জাতিক

ভারতীয় ‘গুরু’নারী শিষ্যের ভয়ঙ্কর অধ্যায়

আর্ন্তজাতিক ডেস্ক: ১৯৩১ সালে ভারতের ভোপালে গডম্যান ওশো রজনীশের জন্ম । তিনি অন্যধারার আধ্যাত্মিক গুরু ছিলেন। দেশ-বিদেশের লাখ লাখ শিষ্য পুনেতে তার আশ্রমে আসতেন। আশ্রমে নগ্ন হয়ে ঘুরে বেড়ানো, শিষ্যদের মধ্যে অবাধ মিলনের মানসিকতা জাগরণের জন্য তিনি সারা বিশ্বের কাছে হয়ে উঠেছিলেন ‘সেক্স গুরু’।

প্রভাবশালী এই গুরুর এক কথাতেই প্রাণ লুটিয়ে দিতে রাজি থাকতেন হাজার হাজার মানুষ। সেই তিনি ‘অন্ধ’ হয়েছিলেন এক নারী শিষ্যের প্রেমে। ওই নারী শিষ্য মা আনন্দ শীলাই বিশ্বাসঘাতকতা করেন।

প্রেমের জালে জড়িয়ে ক্ষমতা হরণ করে নেন। একপ্রকার নির্বাক করে রেখে দেন গডম্যান ওসোকে। ক্ষমতার লোভে নিজের প্রথম স্বামীকে খুন, বিষ দিয়ে গণহত্যার চেষ্টাসহ একাধিক অপরাধের অভিযোগের তীর রয়েছে শীলার দিকে।

একাধিক অপরাধ মাথায় নিয়ে হাজতবাস করা শীলা আজও একই প্রতিপত্তিতে জীবন কাটিয়ে চলেছেন। সংবাদ মাধ্যমে সাক্ষাৎকার, একাধিক তথ্যচিত্র তাকে রীতিমতো তারকা করে তুলেছে। গুজরাটের বদোদরায় জন্ম নেওয়া শীলা অম্বালা পটেলের মা আনন্দ শীলা হয়ে ওঠার গল্প কোনো সিনেমার থেকে কম নয়।

মাত্র ১৮ বছর বয়সে পড়াশোনার জন্য আমেরিকার নিউ জার্সি যান তিনি। খুব কম বয়সে আমেরিকাতেই মার্ক হ্যারিস সিলভারম্যান নামে একজনকে বিয়ে করেন। তারপর ১৯৭২ সালে স্বামীকে নিয়েই তার ভারতে ফেরত আসেন। রজনীশের আশ্রমে শিষ্য হয়েই থাকতে শুরু করেন স্বামী-স্ত্রী। নাম নেন মা আনন্দ শীলা।

কিন্তু শীলার লক্ষ্য ছিলেন ওশো রজনীশ। রজনীশের কাছে পৌঁছনোর ছক কষতে শুরু করেছিলেন প্রথম থেকেই। রজনীশ ও তার মাঝের সমস্ত বাধাকে সরিয়ে ফেলেছিলেন।

এমনকি রজনীশের কাছে পৌঁছনোর জন্য স্বামীকে বিষ ইঞ্জেকশন দিয়ে খুনেরও অভিযোগ রয়েছে তার ওপর। যা পরবর্তীকালে আশ্রমেরই এক শিষ্য প্রকাশ করেছিলেন। প্রথম দিকে আশ্রমের ক্যান্টিনে কাজ করতেন তিনি।

তারপর রজনীশের ব্যক্তিগত সহায়কের সহকারী হিসাবে কাজ শুরু করেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই রজনীশের মন জিতে নেন। ১৯৮১ সালে রজনীশ তাকে নিজের ব্যক্তিগত সহকারী নিয়োগ করেন। রজনীশের আশ্রমে যে পদ্ধতিতে আধ্যাত্মিকতার পাঠ দেওয়া হতো তা ভারতের মতো দেশে গ্রহণযোগ্য ছিল না। বিভিন্ন মহল থেকে আশ্রমের ওপর চাপ আসতে শুরু করেছিল।

ওই বছরই জুলাই মাসে মা শীলার কথায় রজনীশ ভারত ছেড়ে গোটা আশ্রম তুলে নিয়ে চলে যান আমেরিকাতে। একদিনেই বিমানে উড়িয়ে নিয়ে চলে যান তার পুনের আশ্রমের সমস্ত শিষ্যদেরও।

আমেরিকার ওরেগনের ওয়াসকো কাউন্টি। সেখানেই ২৬০ বর্গ কিলোমিটার জায়গা কিনে দ্রুত নতুন আশ্রম বানিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। রজনীশের আশ্রমের ‘সেকেন্ড ইন কমান্ড’ হয়ে উঠতে বেশি সময় লাগেনি বুদ্ধিমতী শীলার। রজনীশের সংস্থার সভাপতিও হয়ে যান শিলা।

দ্রুত শিলার পদোন্নতি হয়ে চলে। রজনীশেরও সবচেয়ে কাছের মানুষ হয়ে ওঠেন। রজনীশের কাছে পৌঁছনোর আগে তার দরজায় কড়া নাড়তে হতো শিষ্যদের। আশ্রমের যাবতীয় বিষয় রজনীশের আগে তার কানে পৌঁছত। এগুলোর মধ্যে রজনীশকে কোন কথা কতটা বলা উচিত এবং কোনটা নয় তা খুব ভাল ভাবেই জানতেন শীলা।

ওয়াসকো কাউন্টিতে আশ্রম চালু হওয়ার প্রথম দিন থেকেই তাদের হাবভাব স্থানীয়দের সন্দেহের কারণ হয়ে দাঁড়াতে শুরু করেছিল। ৩ বছরের মধ্যে সেখানকার স্থানীয়রাও রজনীশের আশ্রমের বিরোধিতা করতে শুরু করেন। আশ্রমে যাতে কোনোভাবে স্থানীয়েরা হামলা না করতে পারে তার জন্য শীলার নির্দেশেই শিষ্যদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র তুলে দেওয়া হয়। সেগুলো নিয়েই এলাকায় দাপিয়ে বেড়াতে শুরু করেন তারা।

আশ্রমের একচ্ছত্র ক্ষমতাবান হয়ে ওঠেন শীলা। কিন্তু এটুকুতেই তিনি স্থির হতে পারছিলেন না। আরও ক্ষমতা চাইছিলেন তিনি। ওয়াসকো কাউন্টি কোর্টের অন্তত দুটো আসন নিজের দখলে আনতে চেয়ে নির্বাচনেও লড়েন।

তার জন্য ওয়াসকো কাউন্টি এবং তার আশপাশ থেকে ভবঘুরেদের বাসে চাপিয়ে আশ্রমে নিয়ে আসেন। উদ্দেশ্য ছিল খাওয়া-পোশাক-আশ্রয়ের বিনিময়ে এসব মানুষদের ভোট নিজের দিকে টানা। কিন্তু তার জন্য ওই সব ভবঘুরেদের ওয়াসকো কাউন্টির ভোটার হতে হতো। শেষে তাদের ভোটার করতে পারেননি শীলা।

এর পর মাস্টারস্ট্রোক চালেন শীলা। যাতে তার প্রতিদ্বন্দ্বীরা ভোটে না জেতেন তার জন্য ওয়াসকো কাউন্টির বেশির ভাগ ভোটারকেই অসুস্থ করে দেওয়ার ছক কষেন। বিষাক্ত সালমোনেলা ব্যাকটিরিয়া খাবারে মিশিয়ে অন্তত সাড়ে ৭০০ ভোটারকে অসুস্থ করেছিলেন। ওয়াসকো কাউন্টির ১০টি রেস্তোরাঁর খাবারে এই ব্যাকটিরিয়া মিশিয়েছিলেন তিনি।

তত দিনে আশ্রমের সর্বেসর্বা ওশো আড়াল হয়ে গেছিলেন। তিনি শীলা ছাড়া আর কারও সঙ্গেই কোনো কথা বলতেন না। শীলার সঙ্গেও যেটুকু কথা হত সবই বন্ধ দরজার পিছনে। বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজের অভিযোগে শীলা এতোটাই জড়িয়েছিলেন যে ১৯৮৫ সালে তাকে আশ্রম ছেড়ে ইউরোপে গা ঢাকা দিতে হয়। শীলা গা ঢাকা দেওয়ার পরই মুখ খোলেন রজনীশ।

খুনের চেষ্টা, গণ বিষপ্রয়োগ, গোপনে তার ওপরে নজর রাখা, তার সমস্ত কথা রেকর্ড করার মতো মারাত্মক অভিযোগ আনেন শীলার ওপর। আমেরিকার পুলিশ শীলার ঘর তল্লাশি করে একটি ল্যাবরেটরি পেয়েছিল যাতে সালমোনেলা ব্যাকটেরিয়ার সন্ধার মিলেছিল। পাশাপাশি রজনীশের আনা অন্যান্য অভিযোগেরও প্রমাণ মেলে।

১৯৮৬ সালে পশ্চিম জার্মানিতে গ্রেফতার হন শীলা। ৪ লাখ ৭০ হাজার ডলার জরিমানা ও ২০ বছরের জেল হয় তার। কিন্তু মাত্র ৩৯ মাসের মধ্যেই ভাল আচরণের জন্য মুক্তি পেয়ে যান। তারপর সুইজারল্যান্ডে গিয়ে জীবনের অন্য অধ্যায় শুরু করেন। সংসার পাতেন তিনি।

একদা রজনীশের শিষ্য সুইৎজারল্যান্ডের নাগরিক বির্নস্টেইলকে বিয়ে করেন তিনি। তারপর দুটি নার্সিং হোম কিনে সেগুলো চালাতে শুরু করেন।

এরপরও ১৯৮৫ সালে চার্লস টার্নার নামে আমেরিকার এক পুলিশকে খুনের অপরাধে ১৯৯৯ সালে সুইস আদালত তাকে কারাদণ্ডের সাজা দেয়। সাজা কাটিয়ে আপাতত সুইজারল্যান্ডেই থাকছেন তিনি।

২০১৮ সালে নেটফ্লিক্সের তথ্যচিত্র ‘ওয়াইল্ড ওয়াইল্ড কান্ট্রি’ সম্প্রচারিত হয়। তাতে তিনি সাক্ষাৎকার দেন। এরপর ২০১৯ সালে করন জোহর দিল্লিতে তার সাক্ষাৎকার নেন। ২০২১ সালের এপ্রিলে নেটফ্লিক্সে ‘সার্চিং ফর শীলা’ নামে করন জোহরের তথ্যচিত্রও মুক্তি পায়।

১৯৯০ সালের ১৯ জানুয়ারি ওশো রজনীশের মৃত্যু হয় পুণেতে। সবচেয়ে কাছের মানুষ হয়ে ওঠা শীলা তার জীবনের শেষের দিকে সবচেয়ে দূরের মানুষে পরিণত হয়েছিলেন। সবচেয়ে বিশ্বাস করেছিলেন যাকে তার কাছ থেকেই সবচেয়ে বড় আঘাত পেয়েছিলেন রজনীশ। শীলার বিরুদ্ধে প্রথম মুখ খুলেছিলেন তিনিই। তা সত্ত্বেও শীলা আজও নিজেকে রজনীশের প্রেমিকা বলতেই ভালবাসেন।

সাননিউজ/এএসএম

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

কোচিং সেন্টারে মিলল বিপুল অস্ত্র-বিস্ফোরক

রাজশাহী নগরীর কাদিরগঞ্জ এলাকায় একটি বাড়ি থেকে অস্ত্র ও বিস্ফোরক তৈরি সরঞ্জাম...

আলাস্কায় ট্রাম্প-পুতিন বৈঠক শেষ, যুদ্ধ স্থগিতের ঘোষণা নেই

যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কায় রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট...

কোনো চাঁদাবাজকে বাংলাদেশে থাকতে দেওয়া হবে না : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

কোনো চাঁদাবাজকে বাংলাদেশে থাকতে দেওয়া হবে না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র...

রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মালয়েশিয়ার প্রভাব কাজে লাগাতে চায় বাংলাদেশ

দীর্ঘদিনের রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা জোরদার করা...

ফের ৯৮ বাংলাদেশিকে বিমানবন্দর থেকে ফেরত পাঠাল মালয়েশিয়া

ফের কুয়ালালামপুর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আটকে দেওয়া হয়েছে ৯৮ বাংলাদেশিকে। বিম...

ফের ৯৮ বাংলাদেশিকে বিমানবন্দর থেকে ফেরত পাঠাল মালয়েশিয়া

ফের কুয়ালালামপুর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আটকে দেওয়া হয়েছে ৯৮ বাংলাদেশিকে। বিম...

‘গোপন রাজনীতি’, ছাত্রশিবির ও ডাকসু নির্বাচন নিয়ে উত্তপ্ত ঢাবি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গেস্টরুম সংস্কৃতি এবং এই কেন্দ্রিক নির্যাতন গত ১৫ বছরে ছি...

রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মালয়েশিয়ার প্রভাব কাজে লাগাতে চায় বাংলাদেশ

দীর্ঘদিনের রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা জোরদার করা...

কোনো চাঁদাবাজকে বাংলাদেশে থাকতে দেওয়া হবে না : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

কোনো চাঁদাবাজকে বাংলাদেশে থাকতে দেওয়া হবে না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র...

আলাস্কায় ট্রাম্প-পুতিন বৈঠক শেষ, যুদ্ধ স্থগিতের ঘোষণা নেই

যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কায় রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা