ভারতের দাবি অনুযায়ী, গত মঙ্গলবার (৭ মে) মধ্যরাতে তারা পাকিস্তানের ৬টি স্থানের ৯টি নিশানায় বিমান হামলা চালিয়েছে। পাকিস্তানের দাবি, তারা এসব হামলা প্রতিহত করেছে। এতে ভারতের পাঁচটি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করা হয়েছে। এই পাল্টাপাল্টি আক্রমণে এখন পর্যন্ত পাকিস্তানের ২৬ জন এবং ভারতের ১০ নাগরিক নিহত হয়েছেন বলে জানা গেছে।
ডিসমিসল্যাবের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে পাল্টাপাল্টি হামলা ও সংঘাত নিয়ে বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ছাড়াও বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বিভ্রান্তিকর ও ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে পড়ছে। এগুলোর মধ্যে আছে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ও যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার বিভিন্ন ছবি ও ভিডিও। এসব তথ্য অনেক সময় পুরোনো বা ভিন্ন প্রেক্ষাপটের হলেও সেগুলোকে বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে মিলিয়ে প্রচার করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি ভুয়া দাবি এবং বিভ্রান্তিকর ছবি-ভিডিও যাচাই করেছে ডিসমিসল্যাব।
একটি ভিডিও পোস্ট করে দাবি করা হচ্ছে, ‘ভারতের যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার দৃশ্য। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ভারতীয় পাঁচটা যুদ্ধবিমান ধ্বংস করেছে পাকিস্তান। কয়েকজন ভারতীয় পাইলটকে আটক করেছে পাকিস্তান।’ ভিডিওতে বিস্ফোরণের পর একটি বাড়িতে আগুন জ্বলতে দেখা যাচ্ছে।
যাচাইয়ে দেখা যায়, এটি সাম্প্রতিক কোনো ভিডিও নয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ইউটিউবে একই ভিডিওটি পাওয়া যায়, যা ২০২৪ সালের ১১ মার্চ আপলোড করা হয়েছিল। এটির সঙ্গে চলমান ভারত-পাকিস্তানের উত্তেজনার কোনো সম্পর্ক নেই।
আরেকটি ভিডিও পোস্ট হতে দেখা যাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে। ভিডিওতে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে একটি বিমানকে ভূপাতিত করার দৃশ্য দেখা যায়। এটিকেও ভারতের যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার দৃশ্য বলে প্রচার করে হচ্ছে।
ডিসমিসল্যাবের যাচাইয়ে দেখা যায়, এটি মঙ্গলবার রাতে পাকিস্তান কর্তৃক ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার ভিডিও নয়। অন্তত ৯ দিন আগেও ভিডিওটি ইউটিউবে আপলোড করা হয়েছিল।
ভারতের যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার সংবাদে ছবিটি ব্যবহার করতে দেখা যাচ্ছে সংবাদমাধ্যমে। ছবিটিতে একটি বিধ্বস্ত বিমানে আগুন জ্বলতে দেখা যাচ্ছে। কিছু গণমাধ্যম ফটোকার্ডে এই ছবিটি ব্যবহার করলেও পরবর্তী সময়ে সরিয়ে নিয়েছে।
যাচাইয়ে দেখা যায়, এটি ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের রাজস্থানে বিধ্বস্ত হওয়া একটি যুদ্ধবিমানের ছবি। প্রযুক্তিগত ত্রুটির কারণে প্রশিক্ষণের সময় ভারতীয় বিমানবাহিনীর মিগ-২৯ যুদ্ধবিমানটি বিধ্বস্ত হয়। এটির সঙ্গে চলমান ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার কোনো সম্পর্ক নেই।
ফেসবুকে আরেকটি ভিডিও পোস্ট হতে দেখা যাচ্ছে। এতে ক্যাপশনে ‘আল্লাহু আকবার,✊পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ এবং ‘আলহামদুলিল্লাহ’ লেখা হয়েছে। ভিডিওটিতে দেখা যাচ্ছে, এক ব্যক্তি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে একটি হেলিকপ্টার ভূপাতিত করেছেন।
ডিসমিসল্যাবের যাচাইয়ে দেখা যায়, এটি একটি ভিডিও গেমের দৃশ্য। চলতি বছরের ৩১ মার্চ ইউটিউবে আপলোড হওয়া এই ভিডিওটির শিরোনাম ছিল ‘অন টার্গেট! গ্রোজনিতে মার্কিন জেভেলিন রাশিয়ান হেলিকপ্টার ধ্বংস করেছে! আরমা৩ হলো একটি ভিডিও গেম। ভিডিওর বিবরণেও এটিকে গেমের দৃশ্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, এমন দাবিযুক্ত ফেসবুক পোস্টে ভিডিও যুক্ত করা হচ্ছে, যেখানে একটি এলাকায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হতে দেখা যাচ্ছে। ভিডিওটির ডান দিকে ওপরের প্রান্তে ‘ইন্ডিয়া’ লেখাটি দেখা যায়।
যাচাইয়ে দেখা যায়, ভিডিওটি ভারত বা পাকিস্তানের নয়। অন্তত সাত মাস পুরোনো ভিডিওটি পোস্ট করতে দেখা যায় ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা ইরান ন্যাশনাল নিউজ এজেন্সিতে (ইরনা)। ২০২৪ সালের অক্টোবরে ইরনা তাদের অফিশিয়াল টুইটার হ্যান্ডেলে ভিডিওটি শেয়ার করেছিল। তারা এটিকে ‘উত্তর তেল আবিবের হারজেলিয়ায় ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র হামলার দৃশ্য’ বলে উল্লেখ করেছিল।
‘আবারো পাকিস্তানে হামলা চালাচ্ছে ভারত’-এমন দাবিতে একটি ভিডিও পোস্ট হচ্ছে ফেসবুকে। ভিডিওতে একটি এলাকায় সেনা মহড়া দিতে দেখা যাচ্ছে। বেশ কিছু ট্যাংক থেকে গোলা নিক্ষেপ করতেও দেখা যায়।
ডিসমিসল্যাবের যাচাইয়ে ভিডিওটির প্রায় পাঁচ বছরের পুরোনো সূত্র সামনে আসে। ‘ডিফেন্স দিল্লি রিভিউ’ নামের একটি ইউটিউব চ্যানেল থেকে ২০২০ সালের ১৬ জানুয়ারিতে পোস্ট করা হয়। ভিডিওর শিরোনাম ছিল, ‘দেবলালি রেঞ্জে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ১২২ মিমি “আপগ্রেডেড” গ্র্যাড মাল্টি ব্যারেল রকেট লঞ্চারের গুলিবর্ষণ।’ অর্থাৎ এই ভিডিওর সঙ্গেও চলমান সংঘাতের কোনো সম্পর্ক নেই।পাকিস্তানে ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা দাবি করে একটি ভিডিও পোস্ট হচ্ছে ফেসবুকে। ভিডিওতে একটি এলাকায় বোমা হামলা হওয়ার দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। হামলার সঙ্গে সঙ্গে তাঁবু থেকে কিছু মানুষকে দৌড়াতে দেখা যায়।
যাচাইয়ে দেখা যায়, এই ভিডিওটি মূলত ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলি বোমা হামলার। ২০২৩ সালের ৯ নভেম্বর সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার একটি ভিডিও প্রতিবেদনে এই দৃশ্যটি দেখা যায়। ভিডিওর শিরোনাম ছিল, ‘গাজার ইন্দোনেশিয়ার হাসপাতালে আহত ব্যক্তিদের খবর পাওয়া যাচ্ছে’। ভিডিওর ৫ মিনিট ৭ সেকেন্ড থেকে ভুল দাবিতে ছড়ানো ভিডিওর দৃশ্যের সঙ্গে হুবহু মিল পাওয়া যায়। অর্থাৎ এটি পাকিস্তান-ভারত সংঘাতের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়।
‘ভারতের যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী এবং ভারতীয় বিমানসেনাকে আটক করেছে পাকিস্তানি ক্ষুব্ধ জনতা, যা পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করে।’ এমন ক্যাপশনে ভিডিও প্রচার হতে দেখা যাচ্ছে ফেসবুকে। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে একটি বিধ্বস্ত বিমানে আগুন জ্বলছে এবং কয়েকজন ব্যক্তি আগুন নেভানোর চেষ্টা করছেন।
ভিডিওটির সূত্র যাচাইয়ে দেখা যায়, এটি চলতি বছরের এপ্রিলের একটি ঘটনার দৃশ্য। গত ১৬ এপ্রিল প্রকাশিত পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যম ডনের এক প্রতিবেদনে এটিকে পাকিস্তানের একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার দৃশ্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
ভিডিওর ১৪ সেকেন্ড থেকে অপর একটি ঘটনার দৃশ্য যোগ করা হয়েছে। যাচাইয়ে দেখা গেছে সেটিও পুরোনো একটি ঘটনার ভিডিও। ভারতের মধ্যপ্রদেশে গত ৬ ফেব্রুয়ারি সে দেশের বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনা এটি।
সাননিউজ/ইউকে