বিজ্ঞান

অবহেলায় হারিয়ে যাচ্ছে দেশের বিজ্ঞানী: রাফায়েল আহমেদ শামীম

মতামত

রাফায়েল আহমেদ শামীম
দেশের উন্নয়নের মূল চালিকা শক্তি হলো মানুষ, বিশেষ করে তার মেধা ও সৃজনশীলতা। বিজ্ঞানী ও গবেষকরা জাতির প্রযুক্তিগত, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক অগ্রগতির ভিত্তি গড়ে, উদ্ভাবনের মাধ্যমে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। কিন্তু বর্তমানে আমাদের বাস্তবতা অনেক দূরে। দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের স্বার্থপরতা, দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অভাব এবং নীতিগত দুর্বলতার কারণে লক্ষ লক্ষ সম্ভাবনাময় বিজ্ঞানী হারিয়ে যাচ্ছে, যা দেশের ভবিষ্যতকে হুমকির মুখে ফেলছে।
বাংলাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা, বিশেষ করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষায় বরাদ্দ বাজেট ও সুযোগ পর্যাপ্ত নয়। সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ল্যাব, যন্ত্রপাতি এবং অন্যান্য সরঞ্জামের অভাব রয়েছে। তরুণ বিজ্ঞানীরা প্রায়ই প্রয়োজনীয় বৃত্তি, গবেষণা অনুদান বা আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষণ থেকে বঞ্চিত হন। ফলে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী বিদেশের উন্নত দেশগুলোর দিকে ঝুঁকে পড়ে, যেখানে তাদের গবেষণা এবং উদ্ভাবনের সুযোগ অনেক বেশি। এই প্রক্রিয়াটিকে সাধারণভাবে “ব্রেইন ড্রেন” বলা হয়। ব্রেইন ড্রেন শুধু ব্যক্তির ক্ষতি করে না; এটি জাতীয় অর্থনীতি, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এবং আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। অবহেলার মূল কারণগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রথমত, স্বল্পমেয়াদী রাজনৈতিক স্বার্থ।
অনেকবার দেখা যায়, সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং নীতি নির্ধারকরা স্বল্পমেয়াদী জনসেবামূলক প্রকল্পকে প্রাধান্য দেন যা রাজনৈতিকভাবে ফলপ্রসূ মনে হয়, কিন্তু বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের দিকে প্রয়োজনীয় মনোযোগ দেয় না। তারা বোঝেন না যে আজকের গবেষকরা আগামী দিনের উদ্ভাবক এবং দেশের দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিশীলতার মূল ভিত্তি। দ্বিতীয়ত, অপর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ। দেশের গবেষণা খাতে বরাদ্দ অর্থ জাতীয় বাজেটের মাত্র ১–৩% হারে, যা উন্নত দেশগুলোর তুলনায় অনেক কম। এ অর্থ যথাযথ ব্যবস্থাপনা ও প্রয়োগের অভাবে প্রায়শই ল্যাব সরঞ্জাম, সফটওয়্যার, আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষণ এবং গবেষণা প্রকল্পে পৌঁছায় না। তৃতীয়ত, মেন্টরশিপ এবং পেশাগত সহায়তার অভাব। একজন সম্ভাবনাময় বিজ্ঞানী যদি সঠিক দিকনির্দেশনা, গবেষণা সহযোগিতা এবং পেশাগত পরামর্শ না পায়, তাহলে তার মেধা পুরোপুরি বিকশিত হয় না। অনেক শিক্ষার্থী বা গবেষকই সঠিক সুযোগের অভাবে তাদের মেধা বহির্মুখীভাবে প্রয়োগ করতে পারেন না। চতুর্থত, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মনোভাবের প্রভাবও গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সমাজে এখনও বিজ্ঞানকে প্রায়শই ঝুঁকিপূর্ণ বা অচেনা পেশা হিসেবে দেখা হয়। পরিবার এবং সমাজের সমর্থন না থাকায় অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী সহজ পথ বেছে নেয়, যেমন সরকারি চাকরি বা বিদেশে স্থায়ী জীবন, যা দেশের জন্য ক্ষতিকর। হারানো সম্ভাবনার পরিমাণ বিশাল। উচ্চমানের শিক্ষার্থী ও গবেষক হারালে জাতীয় অর্থনীতি, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এবং আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক অবদান সীমিত হয়ে যায়।
উদাহরণস্বরূপ, উন্নত দেশগুলো তাদের মেধাবী তরুণদের গবেষণা সুযোগ দিয়ে জ্ঞানভিত্তিক শিল্পে রূপান্তরিত করছে। প্রতিটি সম্ভাবনাময় বিজ্ঞানী যারা দেশের বাইরে চলে যায়, তারা হারিয়েছে দেশের উদ্ভাবন ক্ষমতা, বৈজ্ঞানিক উৎকর্ষ এবং আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার সুযোগ। হারানো বিজ্ঞানীদের প্রভাব শুধুমাত্র অর্থনৈতিক নয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও পড়ে। দেশের প্রযুক্তিগত নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পায়, গবেষণার মান কমে যায় এবং পরবর্তী প্রজন্ম বিজ্ঞানী হওয়ার উৎসাহ হারায়। দীর্ঘমেয়াদে দেশ তার স্বাধীন গবেষণার সক্ষমতা হারাতে পারে।
সমস্যার সমাধান একটিমাত্র বিষয় নয়; এটি সঠিক পরিকল্পনা, স্বচ্ছ প্রশাসন এবং দীর্ঘমেয়াদী নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে সম্ভব। প্রথমে, সরকার এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ করতে হবে। ল্যাব, যন্ত্রপাতি, সফটওয়্যার এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার জন্য পর্যাপ্ত তহবিল নিশ্চিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, বৃত্তি ও প্রশিক্ষণ বৃদ্ধি করতে হবে। সম্ভাবনাময় শিক্ষার্থী ও গবেষকদের দেশীয় ও আন্তর্জাতিক উচ্চমানের গবেষণার সুযোগ দেওয়া উচিত। মেন্টরশিপ প্রোগ্রাম চালু করে তরুণদের পেশাগত দিকনির্দেশনা নিশ্চিত করতে হবে। তৃতীয়ত, সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা আবশ্যক। বিজ্ঞানকে সম্মানজনক, অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ এবং দেশের উন্নয়নের মূল চালিকা শক্তি হিসেবে প্রচার করতে হবে। পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক সংস্থা এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করতে পারে। চতুর্থত, দীর্ঘমেয়াদী নীতি প্রণয়ন অপরিহার্য। প্রতিটি সরকারী পদক্ষেপের ক্ষেত্রে স্বল্পমেয়াদী রাজনৈতিক স্বার্থের চেয়ে দেশের বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত স্বায়ত্তশাসনকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। নিয়মিত গবেষণা প্রতিবেদন, বাজেটের স্বচ্ছতা এবং কার্যকারিতা মূল্যায়নের মাধ্যমে ক্ষতি কমানো সম্ভব।
আন্তর্জাতিক তুলনায় দেখা যায়, উন্নত দেশগুলোতে বিজ্ঞানী তৈরিতে ব্যয় করা প্রতিটি টাকা বহুগুণে ফেরত আসে। যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপান তাদের গবেষক ও বিজ্ঞানী তৈরিতে বরাদ্দ বাজেটকে দেশের উন্নয়নের মূল কৌশল হিসেবে ব্যবহার করছে। তারা দেশীয় তরুণদের গবেষণা এবং উদ্ভাবনের সুযোগ দিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে শক্তিশালী করছে। আমাদের দেশে যদি একই মনোভাব গ্রহণ করা হয়, হারানো মেধাকে ফেরানো সম্ভব এবং দেশের বৈজ্ঞানিক উৎকর্ষ নিশ্চিত করা যায়। দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের অবহেলা ও স্বার্থপরতার কারণে হারিয়ে যাচ্ছে লক্ষ লক্ষ সম্ভাবনাময় বিজ্ঞানী। তাদের হারানো শুধুমাত্র ব্যক্তি বা পরিবারের ক্ষতি নয়; এটি জাতীয় অর্থনীতি, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি, সামাজিক উন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক প্রভাবের জন্য দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি। সরকার, নীতি নির্ধারক এবং সমাজকে একত্রে কাজ করতে হবেÑযাতে গবেষণার জন্য যথাযথ অর্থ বরাদ্দ, প্রশিক্ষণ, মেন্টরশিপ এবং সামাজিক স্বীকৃতি নিশ্চিত করা যায়। বিজ্ঞানী তৈরিতে ব্যয় করা অর্থকে কেবল খরচ হিসেবে দেখা উচিত নয়। এটি জাতির শক্তি, দেশের ভবিষ্যত এবং আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অবস্থান নিশ্চিত করার একটি বিনিয়োগ। আজ যদি পদক্ষেপ নেই, আগামী প্রজন্ম দেখবে যে দেশের সম্ভাবনাময় সন্তানরা হারিয়েছে অবহেলার কারণে। আর যদি সচেতনতা, বাজেট বরাদ্দ এবং কার্যকর নীতি প্রয়োগ করা হয়, হারানো মেধাকে ফিরে পাওয়া সম্ভব এবং দেশকে বৈজ্ঞানিক উৎকর্ষে নিয়ে যাওয়া সম্ভব।

রাফায়েল আহমেদ শামীম, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও কলাম লেখক।

[email protected]

সান নিউজ/আরএ

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

মানবতাবিরোধী অপরাধে শেখ হাসিনাসহ ৩ জন দোষী সাব্যস্ত

ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের সত্যতা ম...

শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের সাজা দিয়ে রায় ঘোষণা

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্র...

সাবেক আইজিপি মামুনের ৫ বছর কারাদণ্ড

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আসামি থেকে রাজসাক্ষী পুল...

এই রায়ে জুলাই শহীদেরা ন্যায়বিচার পেয়েছে: অ্যাটর্নি জেনারেল

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গণহত্যার মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ...

শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায়ে দেশজুড়ে মিষ্টি বিতরণ

ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ড ঘোষণার পর আন্তর্জাতিক অপরাধ...

উলিপুরে মানব পাচারকারীকে গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন

কুড়িগ্রামের উলিপুরে প্রতারণার অভিযোগে চিহ্নিত মানব পাচারকারী মমিনুল ইসলাম বাব...

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে পাকিস্তানের জাতীয় কবির তত্ত্ব নিয়ে সেমিনার

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে পাকিস্তানের জাতীয় কবি ও চিন্তাবিদ আল্লামা ইকবালের &lsqu...

বিদ্যালয়ে কর্মচারী নিয়োগে অনিয়ম ও দুর্নীতি, দুদকের অভিযান

মাদারীপুর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) উত্তর রমজানপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ...

কুষ্টিয়া-২ আসনে মনোনয়ন পুনর্বিবেচনার দাবিতে নারীদের বিক্ষোভ

কুষ্টিয়া-২ (মিরপুর-ভেড়ামারা) আসন পুনর্বিবেচনা করে সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক শহ...

পাওনা টাকা আদায়ে উকিল নোটিশ জারী

সাতক্ষীরার তালা থানার পাঁচরোর্থী গ্রামের আফজাল হোসেন একই গ্রামের জান্নাত এন্ট...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা