শাহজাহানপুরে গুলিতে দু'জন নিহত হন (ছবি: সংগৃহীত)
মতামত

প্রীতির বাবা সন্তান হত্যার বিচার চান না কেন?

দেবব্রত চক্রবর্তী বিষুষ্ণ: গত ২৪ মার্চ ঢাকার শাহজাহানপুরে দুর্বৃত্তদের গুলিতে দু'জন নিহত হন। একজন মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপু এবং অন্যজন যানজটে আটকে পড়া রিকশারোহী কলেজছাত্রী সামিয়া আরেফিন প্রীতি। গুলিবিদ্ধ হন জাহিদুলের গাড়িচালকও। ওই নৃশংসতার মূল টার্গেট যে ছিলেন জাহিদুল ইসলাম টিপু, তা অনুমান করা কঠিন নয়। প্রীতির বাবা বলেছেন, তিনি তার সন্তান হত্যার বিচার চান না। মা-বাবার কাঁধে সন্তানের লাশের চেয়ে ভারী বোঝা আর কিছু হতে পারে না। সন্তানহারা একজন বাবার এই উচ্চারণ শুধুই কি তার ক্ষোভ ও বেদনার বহিঃপ্রকাশ নাকি জননিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায় যাদের কিংবা অপরাধের আইনি প্রতিকারের দায়িত্বের ভার যাদের হাতে, তাদের ওপর অনাস্থার বহিঃপ্রকাশ? মোটাদাগে স্পষ্টতই বোঝা যায়, প্রীতির বাবার বেদনাকাতর উচ্চারণ শেষেরটিরই প্রতিফলন।

২৭ মার্চ ভোরে রাজধানীর শেওড়াপাড়ায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে চিকিৎসক আহমদ মাহী বুলবুলের মৃত্যু হয়। ২৬ মার্চ রাতে রাজধানীর সবুজবাগ এলাকায় দুই শিশুসন্তানকে মুখে স্কচটেপ পেঁচিয়ে তাদের মা গৃহবধূ তানিয়া আফরোজ মুক্তাকে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ২৬ মার্চ দুপুরে ময়মনসিংহের তারাকান্দায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে উম্মে কুলসুম বিবি নামের এক নারী খুন হয়েছেন। এ ঘটনাগুলো ফের জননিরাপত্তাহীনতার প্রকট চিত্রই তুলে ধরেছে। প্রতিটি ঘটনার পরই নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মুখ্য দায় যাদের, সেই পুলিশের তরফে শোনা গেছে গৎবাঁধা কথা।

প্রীতির বাবার মতো এর আগেও ভুক্তভোগী কেউ কেউ নিদারুণ আক্ষেপে উচ্চারণ করেছেন- বিচার পাই না, তাই বিচার চাই না। হতাশা বুকে চেপে একজন সন্তানহারা বাবা কিংবা স্বজন হত্যাকাণ্ডের বিচার চাইতে অপারগতা প্রকাশ করে রাষ্ট্রশক্তিকে যে আত্মজিজ্ঞাসার মুখোমুখি দাঁড় করালেন, তারপরও কি অস্বীকার করা হবে কোনো সুস্থ-স্বাভাবিক সমাজে এমনটি যে হওয়ার কথা নয়?

যে দেশে জননিরাপত্তা ভঙ্গুর, সে দেশে যতই উন্নয়ন হোক, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অঙ্ক কষা চলুক- সবই মানবাধিকার, জীবনযাত্রার মান ও জননিরাপত্তার মানদণ্ডে খুব তুচ্ছ হয়ে যায়। এ সমাজ মানুষরূপী দানবদের অভয়ারণ্য হয়ে ওঠার পেছনের কারণ অনেক। এর অন্যতম কারণ যে সুশাসনের অভাব, এ নিয়ে সন্দেহ কী? আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর ব্যর্থতার কথা তো এমন প্রেক্ষাপটে সর্বাগ্রে আসবেই; কিন্তু এই বাহিনীগুলো যেহেতু রাষ্ট্র ব্যবস্থার অনুষঙ্গ এবং সরকার নিয়ন্ত্রিত, সেহেতু দায়ভারটা প্রথমত বর্তায় সরকারের ওপরই। নিকট অতীতেও এমন বীভৎস ঘটনা অনেক ঘটেছে এবং এরপর আইনি সংস্থা তো বটেই, সরকারের নীতিনির্ধারকদের মুখেও আমরা শুনেছি- অপরাধী যে-ই হোক, তার ছাড় নেই। কিন্তু বিদ্যমান বাস্তবতার সঙ্গে এসব অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতির মিল-অমিল কতটা? এ প্রশ্নের জবাবও সচেতন মানুষের কাছে অস্পষ্ট নয়।

শুনতে অপ্রীতিকর হলেও সত্য, আমাদের সমাজে অনেক ক্ষেত্রেই দুর্বৃত্তরা বেড়ে ওঠে, প্রতিপালিত হয় নীতি-আদর্শবিবর্জিত একশ্রেণির তথাকথিত রাজনীতিকের ছায়াতলে তাদের লাভালাভের হিসাব কষে অন্য রকম পরিচর্যায়। এর অনেক দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে আছে। আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে দুর্বৃত্তদের দুর্বৃত্তপনা থেকে নিবৃত্তকরণে প্রতিরোধের জায়গা থেকে ব্যক্তির মূল্যবোধ গড়ে তোলার বিষয়টি পুঙ্খানুপুঙ্খ দেখার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করি না। কিন্তু একই সঙ্গে এ প্রশ্নও রাখি, ব্যবস্থায় গলদ জিইয়ে রেখে অবস্থার পরিবর্তন কতটা সম্ভব? শুধুই মূল্যবোধের অবক্ষয়ের বিরূপ ফল এটুকু বলে শেষ করার অবকাশ কতটা আছে?

আমাদের সমাজ বাস্তবতায় অপরাধ সংঘটনের হোতারা নৃশংসতায় কে কাকে ছাপিয়ে যায়- অনেক সময়ই এরও হিসাব কষা খুব দুরূহ হয়ে পড়ে। আমরা এও দেখেছি, ভয়াবহ অপরাধ সংঘটিত করে অপরাধী ঠান্ডা মাথায় প্রমাণ মুছে ফেলার চেষ্টা করে থাকে। এমন বাস্তবতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'ন্যায়দণ্ড' কবিতার পঙ্‌ক্তিগুলো আরও বেশি গুরুত্ববহ হয়ে ওঠে। সংঘটিত একের পর এক নৃশংসতা শান্তিপ্রিয় মানুষকে শুধু ভীত-সন্ত্রস্তই করছে না, একই সঙ্গে এ প্রশ্নও সামনে নিয়ে আসছে- এর শেষ কোথায়? দুর্বৃত্ত কিংবা সমাজবিরোধীর সংখ্যা নগণ্য; কিন্তু জননিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব পালনকারীর সংখ্যা নিশ্চয়ই এর চেয়ে অনেক বেশি। তাহলে দুর্বৃত্তদের দুর্বৃত্তপনায় সমাজ থরথর করছে কেন? আমাদের সমাজে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারের দাবি নতুন নয়। এ ব্যাপারে সরকারের অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতিতেও কোনো ঘাটতি নেই। কিন্তু তারপরও কেন নৃশংসতার ছায়া বিস্তৃত হচ্ছে? এ প্রশ্নের জবাব দেওয়ার দায় রাষ্ট্রশক্তি, রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে জননিরাপত্তা নিশ্চিত করার সংশ্নিষ্ট বিভাগ কিংবা সংস্থাগুলোর দায়িত্বশীলদের ও সরকারের।

আরও পড়ুন: রোহিঙ্গা গণহত্যার মার্কিন স্বীকৃতি ও ন্যায়বিচার

আমরা বিদ্যমান বাস্তবতায় আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে স্মরণ করি নির্মল সেনের স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা চাওয়ার দাবিটি। কিন্তু স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি নিশ্চিত করতে গেলে ব্যবস্থা ও রাজনীতির শুদ্ধীকরণ জরুরি- এ সত্য কি এড়ানো যাবে? যতক্ষণ তা না করা যাবে, ততক্ষণ দুর্বৃত্ত কিংবা সমাজবিরোধী অপশক্তির আঁতুড়ঘর টিকে থাকবেই। যে ভূতল অপরাধীচক্র অদৃশ্য শক্তির আশীর্বাদ নিয়ে বারবার চেহারা বদলায়, এর উৎসেও নজর দিতে হবে। সন্তান হত্যার বিচার চাই না- এমন উচ্চারণ কেন একজন বাবার মুখে উচ্চারিত হয়, এবার অন্তত রাষ্ট্রশক্তি তা অনুধাবন করুক এবং এর নিরিখেই নিশ্চিত করুক দৃষ্টান্তযোগ্য প্রতিকার। আত্মজিজ্ঞাসা, জবাবদিহি, দায়বদ্ধতার পথও করুক কণ্টকমুক্ত।

দেবব্রত চক্রবর্তী বিষুষ্ণ: সাংবাদিক ও লেখক
[email protected]

সাননিউজ/এমএসএ

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

নোয়াখালীতে ভূমি দুস্যুর বিরুদ্ধে মানববন্ধন 

নোয়াখালী প্রতিনিধি: নোয়াখালীর কোম...

ফসলের ক্ষতি করে চলছে অবৈধ ব্যাটারি ইন্ডাস্ট্রি

কামরুল সিকদার, বোয়ালমারী (ফরিদপুর):

কেশবপুরে নির্বাচনী কার্যালয়ের শুভ উদ্বোধন

আব্দুর রাজ্জাক সরদার, কেশবপুরঃ আগামী ০৮ ই মে ২০২৪, রোজ বুধবা...

আজ শেরে বাংলার ৬২তম মৃত্যুবার্ষিকী

নিজস্ব প্রতিবেদক: আজ অবিভক্ত বাংল...

আফ্রিকায় ভারী বৃষ্টি, নিহত ১৫৫

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: আফ্রিকায় গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ভারী বৃষ্টি হ...

খাগড়াছড়িতে ছাত্রলীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত

আবু রাসেল সুমন, খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি:

বরিশালে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে ৩ জনের মৃত্যু

নিজস্ব প্রতিবেদক: বরিশালের বাকেরগ...

সেরা সুন্দরী হলেন ৬০ বছরের আলেজান্দ্রা 

বিনোদন ডেস্ক: সম্প্রতি ৬০ বছর বয়স...

সোনার দাম ফের কমলো 

নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশের বাজারে সো...

গরমে বারবার গোসল করা কি ক্ষতিকর?

লাইফস্টাইল ডেস্ক: বৈশাখের শুরু থে...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা