সাহাবুদ্দীন আহমদ (ফাইল ফটো)
মতামত

ক্রান্তিকালের কাণ্ডারি

এম হাফিজ উদ্দিন খান: নব্বইয়ের গণআন্দোলনে এইচএম এরশাদ সরকারের পতনের পর দেশে সৃষ্ট অচলাবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ রাষ্ট্রপতি ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেব দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তাকে আবার রাষ্ট্রপতি করা হয়। নিভৃতচারী, নির্মোহ, নীতিনিষ্ঠ, দায়িত্বের প্রতি প্রতিজ্ঞাতবদ্ধ এ মানুষটির জীবনালেখ্য বর্ণাঢ্য। গত কিছুদিন ধরে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) তিনি চিকিৎসাধীন ছিলেন। এ অবস্থায় শনিবার সকালে তার জীবনাবসান হয়। ৯২ বছরের তার জীবনের উল্লেখযোগ্য অংশ কেটেছে কর্মমুখরতায়। কিন্তু এত কর্মের মাঝেও তিনি নিজেকে প্রকাশে ছিলেন খুব অনাগ্রহী।

তার নেতৃত্বাধীন সরকার দেশে প্রথম নির্দলীয় সরকার। ওই সরকার ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করে। তখন দেশে জাতীয় নির্বাচন ব্যবস্থায় যে পরিবর্তন আসে, তা দেশের শাসনকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে এক আলোচিত অধ্যায়। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর প্রথমে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিলেও দ্বিতীয় মেয়াদে ১৯৯৬ সালের ৯ অক্টোবর তিনি দলীয় সরকারের আমলে পুনর্বার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করে ২০০১ সালের ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত পূর্ণ মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেন প্রশ্নমুক্তভাবে। আমাদের স্মরণে আছে, এরশাদ সরকারের পদত্যাগের পর রাষ্ট্রপতি এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান কে হবেন- এ বিষয়ে তখন আন্দোলনকারী রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারছিল না।

দেশে তখন ক্রান্তিকালের ছায়া বিস্তৃত। পরে আন্দোলনকারী রাজনৈতিক দলগুলো যখন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের ব্যাপারে এক মত ও পথে আসে, তখন সংকট নিরসনের পথ সৃষ্টি হয়। শেষ পর্যন্ত তিনি শর্তসাপেক্ষে দায়িত্বভার গ্রহণে রাজি হন। এর মধ্যে মুখ্য ছিল- তিনি আবার ফিরে যাবেন প্রধান বিচারপতি পদে। তার ওই শর্ত মেনে নেওয়া হয় এবং এ কারণে সংবিধানে সংশোধনীও আনতে হয়েছিল। দেশের শাসনতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় এটি অবশ্যই একটি বড় ঘটনা। তার দৃঢ়তা, দূরদর্শিতা, ন্যায়পরায়ণতা এবং সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে যে অবিচলতা আমরা দেখেছি, তা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। তার কর্মজীবনের সূচনা ঘটেছিল একজন ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে। তারপর ধাপে ধাপে তিনি অনেক পথ মাড়িয়ে দেশের বিচারালয় ও দেশের শীর্ষজন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

আমরা জানি, দেশের সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী সম্পর্কিত মামলায় তার যুগান্তকারী রায়ের কারণেই সংবিধান পরিশোধনের পথ উন্মুক্ত হয়। আরও স্মরণযোগ্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৮৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে পুলিশের গুলিতে হতাহতের মর্মন্তুদ ঘটনার পর গঠিত তদন্ত কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। নব্বইয়ে যে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্বে দেশে গণআন্দোলন গড়ে উঠেছিল; এর পরিপ্রেক্ষিতে এইচএম এরশাদ সরকারের পতন ঘটলেও পরে বড় দুটি দলের মধ্যে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে সৃষ্টি হয় আস্থার সংকট। সেই সময়ে সাহাবুদ্দীন আহমদ দেশের শাসনকার্যে প্রধান ব্যক্তি হিসেবে যুক্ত হয়ে একটি দৃষ্টান্তযোগ্য জাতীয় নির্বাচন জাতিকে উপহার দেন। এ জন্যই তাকে আমাদের ক্রান্তিকালের কাণ্ডারি বলে মনে করি।

১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি দেশের পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর তিনি যখন তার মূল পদ প্রধান বিচারপতি হিসেবে ফের যোগ দেন, তখনও তিনি তার পুরোনো অঙ্গনের দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেই অবসর নেন। আমাদের সংবিধান অনুসারে সংসদীয় গণতন্ত্রে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা অসীম নয়। কয়েকটি বিষয় ছাড়া রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নিয়েই দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু সদ্য প্রয়াত সাহাবুদ্দীন আহমদ দলীয় সরকারের রাষ্ট্রপতি হয়েও তার সততা, বিবেক কারও কাছে বন্ধক রাখেননি। তিনি তার সততা ও প্রজ্ঞার দ্বারাই দেশের মানুষের মন জয় করেন। রাষ্ট্রপতির পদ থেকে অবসর নিয়ে ঢাকায় তার গুলশানের বাড়িতে নিভৃতে কাটিয়ে গেছেন।

কাজের সূত্রে তার সঙ্গে আমার অনেকবারই দেখা করার সুযোগ হয়েছে। আমি যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা, তখনও তিনি রাষ্ট্রপতি। অনেকবার তখন ডেকেছেন। জানতে চেয়েছেন অনেক কিছু এবং মনোযোগ দিয়ে সব শুনেছেনও। আমি এ জন্য গর্ববোধ করি। কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতি তার কখনও কোনো দুর্বলতা প্রকাশ পায়নি। তিনি বলতেন, কবর জিয়ারত করা ছাড়া রাষ্ট্রপতির কোনো
কাজ নেই। তার দূরদর্শিতা, প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতার প্রকাশ ঘটেছে তার কাজের প্রতিটি ধাপে এবং নীরবে। তাকে কখনোই 'আমিত্ব'র ভারে নুইয়ে পড়তে দেখিনি। তার সঙ্গে ব্যক্তিগত স্মৃতি আজ আমাকে খুব কাতর করছে।

১৯৩০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি তিনি নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। সাহাবুদ্দীন দম্পতির তিন কন্যা ও দুই পুত্র সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে দ্যুতি ছড়িয়েছেন। নান্দাইলের চণ্ডীপাশা উচ্চ থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করার পর ভর্তি হন কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল কলেজে। সেখান থেকে আইএ পাস করে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। দেশে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে তদানীন্তন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস (সিএসপি) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে প্রথমে লাহোরে সিভিল সার্ভিস একাডেমি, পরে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে জনপ্রশাসনে উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। শিক্ষাজীবনের প্রতিটি স্তরে তিনি স্বাক্ষর রেখেছেন ঔজ্জ্বল্যের। তার খ্যাতির সীমানা কত বিস্তৃত, এর ব্যাখ্যা-বিশ্নেষণ নতুন করে নিষ্প্রয়োজন।

দেশের চতুর্থ প্রধান বিচারপতি ফজলে কাদেরী মোহাম্মদ আবদুল মুমিনের পর সাহাবুদ্দীন আহমদই প্রধান বিচারপতি হিসেবে দীর্ঘ সময় দায়িত্ব পালনকারী দ্বিতীয় জন। তিনি এতই নিভৃতচারী ছিলেন; মিডিয়াও তাকে সেই বৃত্ত ভেদ করে আনতে পারেনি। তিনি নিভৃতচারী ছিলেন বটে, কিন্তু দেশ-জাতির ক্রান্তিলগ্নে অর্পিত দায়িত্ব পালনে কুণ্ঠা বোধ করেননি। সিদ্ধান্ত গ্রহণে কোনো তাড়াহুড়া যেমন ছিল না, তেমনি গৃহীত সিদ্ধান্তেও থাকতেন অটল।

দেশের শাসনতান্ত্রিক বিকাশে তার ভূমিকা মূল্যায়িত-পর্যালোচিত হতেই থাকবে। তিনি যখন বাংলাদেশ রেড ক্রস সোসাইটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, তখনও তার কর্মঅধ্যায়ে একই রকম দ্যুতি দেখা গেছে। তার স্ত্রীবিয়োগ ঘটে ২০১৮ সালে। তার পুত্র-কন্যারা তার আলোয়ই আলোকিত হয়েছেন এবং জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তাদের শ্রদ্ধা-ভালোবাসা নিয়েই ছিলেন। ভালোমানুষ আর দক্ষ বিচারক কিংবা প্রশাসক হিসেবে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও খ্যাতি অর্জন সবার ক্ষেত্রে সমভাবে প্রতিফলিত হয় না।

আরও পড়ুন: জ্বালানি সাশ্রয়ে জোর দিতে হবে

কিন্তু সাহাবুদ্দীন আহমদের ক্ষেত্রে এ সবকিছুর প্রতিফলন ঘটতে দেখা গেছে একটি ছাড়িয়ে অন্য ক্ষেত্রে আরও বেশি করে। তার ব্যাপৃত জীবন-অধ্যায় পর্যালোচনা করলে স্পষ্টতই এমনটি প্রতীয়মান। তিনি ছিলেন দেশের ষষ্ঠ প্রধান বিচারপতি এবং দু'বার রাষ্ট্রপ্রধান ও প্রখ্যাত আইনবিদ। কিন্তু কোনো মোহই তাকে টেনে ধরতে পারেনি। ক্ষমতা ও সুযোগের অপব্যবহারের তো প্রশ্নই আসে না। অনেকেই মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে ফুরিয়ে যান না। সমাজে একটি কথা বহুল প্রচলিত- 'মরেও অমর'। এই 'মরেও অমর' অনেকেই। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে সাহাবুদ্দীন আহমদও ওই কারাতভুক্ত থাকবেন। তার মৃত্যুতে গভীর শোক ও পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাই। তার প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা।

এম হাফিজ উদ্দি খান :সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও সভাপতি, সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন

সাননিউজ/এমএসএ

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

পরিবেশ রক্ষায় গাছ কাটা বন্ধে রিট 

নিজস্ব প্রতিবেদক: পরিবেশ রক্ষায়...

সেনাবাহিনীকে আধুনিক করে তোলা হচ্ছে

নিজস্ব প্রতিবেদক: প্রধানমন্ত্রী শ...

নাতির হাতে বৃদ্ধা খুন, আটক ৩

ভালুকা (ময়মনসিংহ) প্রতিনিধি: ময়মন...

হিট অ্যালার্টের মধ্যেই ঝড়ের আভাস

নিজস্ব প্রতিবেদক: ২৪ ঘণ্টার ‘হিট অ্যালার্ট’ জারি...

নবনির্মিত এএফআইপি ভবন উদ্বোধন

নিজস্ব প্রতিবেদক: ঢাকা সেনানিবাসে...

দেশে তীব্র ঝড়ের পূর্বাভাস

নিজস্ব প্রতিবেদক : দেশের তিন অঞ্চলের ওপর দিয়ে তীব্র ঝড় বয়ে...

নিয়ন্ত্রণে সুন্দরবনের আগুন

জেলা প্রতিনিধি : বাগেরহাটে পূর্ব সুন্দরবনে লাগা আগুন নিয়ন্ত্...

ভূমিকম্পে কাঁপল ইন্দোনেশিয়া

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ ইন্দোনেশিয়া ৬ দশ...

বাস-পিকআপ সংঘর্ষে নিহত ২

নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে বাসের ধাক্কায় পিকআপ...

সোমবার রাজধানীর যেসব মার্কেট বন্ধ

সান নিউজ ডেস্ক: প্রতি সপ্তাহের একেক দিন বন্ধ থাকে রাজধানীর ব...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা