মতামত

এটা পরীক্ষা, নাকি ‘অটো পাস’

মো. তৌহিদ হোসেন : ১৫ জুলাই শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির পক্ষ থেকে বহুল প্রতীক্ষিত সরকারি সিদ্ধান্ত এসেছে। তিনি জানিয়েছেন, নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে এসএসসি পরীক্ষা হবে, আর ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে হবে এইচএসসি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলবে না, ক্লাস হবে না, আর পরীক্ষা হবে তিনটি; ঐচ্ছিক বিষয়ের ওপর সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে। বাংলা, ইংরেজি, অঙ্ক বাদ। তিনি আরও বলেছেন, যদি সশরীর পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব না হয়, তবে পূর্ববর্তী জেএসসি, জেডিসি, এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল এবং অ্যাসাইনমেন্টের ভিত্তিতে এসএসসি-এইচএসসি পরীক্ষার মূল্যায়ন করা হবে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় যে লেখাপড়ার চেয়ে পরীক্ষা বেশি গুরুত্বপূর্ণ, আরেকবার চোখে আঙুল দিয়ে তা দেখিয়ে দেওয়া হলো।

করোনা মহামারির পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০ সালের ১৮ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। প্রাথমিকভাবে ধারণা ছিল, মাস তিন-চার হয়তো এ অবস্থা চলবে। সে হিসাবে রোজার ঈদের পর জুন মাসে বা তা-ও যদি না হয়, ২০২০-এর সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলতে পারে, এমন ধারণা পত্রপত্রিকায় এসেছিল। তখনো একবার সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষা নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের ওপরের ক্লাসে তুলে দেওয়ার চিন্তা করা হয়েছিল।

মহামারি হিসাবনিকাশ উল্টে দিয়েছে। স্কুল-কলেজে লেখাপড়া ১৬ মাস ধরে বন্ধ। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও বন্ধ। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অনুমতি দেওয়া হয়েছে অনলাইন কার্যক্রম চালানোর। তা-ও ইউজিসি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বিভ্রান্তিকর নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছে। যেমন ক্লাস হলেও পরীক্ষা হবে না, পরীক্ষা নিলেও নম্বর দেওয়া যাবে না, ইত্যাদি।

১৯৭১ সালে এসএসসি পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল সে বছরের এপ্রিল মাসে। সে অনুযায়ী আমরা প্রস্তুতিও নিয়েছিলাম মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগ পর্যন্ত। মুক্তিযুদ্ধ এবং পূর্বাপর মিলিয়ে এক বছর লেখাপড়া হয়নি। বোর্ডের পরীক্ষা অবশ্য নিয়েছিল তদানীন্তন সরকার, যে পরীক্ষায় কিছু ছাত্র অংশও নিয়েছিল। এ পরীক্ষার ফলাফল স্বাধীনতার পর বাতিল করা হয়। যথারীতি এক বছর দেরিতে ১৯৭২-এর এপ্রিলে আমরা এসএসসি পরীক্ষা দিই। এ সময়ে আরও কয়েকটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যার সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক ফলাফল ছিল। প্রথমত, এক বছরের অটো প্রমোশন, যার ফলে আমাদের এক বছরের কনিষ্ঠ যারা, যাদের স্বাভাবিকভাবে ১৯৭২-এ পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল, তারাও আমাদের দুই মাস পরেই পরীক্ষা দেয়। এই ব্যাচ সত্যিকার অর্থে দশম শ্রেণিতে পড়েইনি। একইভাবে এইচএসসিতেও ১৯৭২ সালে পরপর দুটো ব্যাচ পরীক্ষা দেয়।

দ্বিতীয় সিদ্ধান্তটি ছিল আরও গুরুতর। আমরা তো নবম-দশম পুরো দুই বছর পড়ে সিলেবাস শেষ করে ১০০০ নম্বরের পরীক্ষার জন্য তৈরিই ছিলাম। কিন্তু সম্পূর্ণ বিনা কারণে ৩০০ নম্বরের একটা সংক্ষিপ্ত পরীক্ষা নিয়ে আমাদের এসএসসি সার্টিফিকেট দেওয়া হলো। সিদ্ধান্তের বাইরে আরও একটি কাজ হলো, সেটি হচ্ছে ১৯৭২ সালের চারটি পরীক্ষাতেই অবাধ এবং সীমাহীন নকলবাজি, যার কারণে মেধার স্বাভাবিক মূল্যায়নও ওলটপালট হয়ে গেল। আমার যে বন্ধু দুই বছর পরের এইচএসসি পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হয়, সে এসএসসিতে হয়ে গিয়েছিল মেধাতালিকায় দ্বিতীয়! পাসের হারও হঠাৎ করে ৬০-৬২ থেকে এক লাফে ৯৫ পার হয়ে যায়।

এই তাড়াহুড়োয় শেষ পর্যন্ত লাভ হয়নি কোনো, বরং ক্ষতি হয়েছে অনেক। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এই চাপ নিতে পারেনি, ফলে সেশনজট প্রকট আকার ধারণ করে (সেশনজটের জন্য অবশ্য আরও কারণ এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল)। ১৯৭৭-এর এমএ পরীক্ষা আমরা দিয়েছিলাম ১৯৮০ সালের ফেব্রুয়ারিতে। মুক্তিযুদ্ধে আমরা এক বছর ব্যয় করেছি, এটা মেনে নিয়ে সবারই সেশন এক বছর পিছিয়ে দিয়ে সে অনুযায়ী পরীক্ষা নিলে এ অরাজকতা অনেকটা পরিহার করা যেত।

এক বছরের বেশি সময় বসে থাকার পর সম্প্রতি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের ভর্তির নোটিশ এসেছে। ভর্তি প্রক্রিয়া শেষ করে কবে তারা ক্লাস শুরু করবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এর মধ্যে এ বছরই আরেকটি ব্যাচকে সংক্ষিপ্ত পরীক্ষা বা অটো পাস দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির লাইনে দাঁড় করিয়ে কী ফায়দা হবে?

কোভিডের আগে জীবনযাত্রা যখন স্বাভাবিক ছিল, তখনো আমাদের বিদ্যালয়গুলোতে পড়াশোনার মান নিয়ে উদ্বেগ ছিল। বিশেষত গ্রামের বেসরকারি স্কুলগুলোর একটা বড় অংশে মানসম্মত লেখাপড়া ছিল প্রায় অনুপস্থিত। সাবেক শিক্ষামন্ত্রীর প্রবল জিপিএ-৫ প্রীতির কারণে কাগজে-কলমে অনেক ‘মেধাবী’ সহজ বাংলা-ইংরেজিও ঠিকমতো পড়তে পারে না। গ্রামের কলেজগুলোর ক্ষেত্রেও প্রায় একই কথা খাটে। এককথায়, এর ফল বলা যায় বিপুলসংখ্যক ‘অশিক্ষিত’ গ্র্যাজুয়েটের বহর, যারা কর্মবাজারে সম্পূর্ণ অপাঙ্‌ক্তেয় এবং যাদের সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এই নভেম্বরে যাদের এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্ন উঠছে, ২০২০-এর জানুয়ারিতে তারা মাত্র দশম শ্রেণিতে উঠেছে। অর্থাৎ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের আগে তারা মাত্রই দুই মাস সময় পেয়েছে বিদ্যালয়ে। আর ঐতিহ্যগতভাবেই এই সময়ে পড়াশোনা হয় বেশ কম। (শহরের নামী স্কুলগুলোর কথা আমি বলছি না)। গত ১৫ মাসে কোনো পড়াশোনা হয়নি এই ছেলেমেয়েদের। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলবে না, কাজেই আগামী চার মাসেও প্রাতিষ্ঠানিক কোনো লেখাপড়া তাদের হচ্ছে না। এইচএসসি পরীক্ষার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এই পর্যায়ে ক্লাস শুরু হয় আরও দেরিতে। তাই মার্চ ২০২০-এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের আগে তাদের একাদশ শ্রেণির পাঠই শেষ হয়নি। কতটুকু কী শিখেছে তারা যে তাদের সার্টিফিকেট দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো হচ্ছে? যেভাবেই হোক, পাস করিয়ে ওপরের শ্রেণিতে তুলে দেওয়ার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এ সিদ্ধান্ত, অশিক্ষিত গ্র্যাজুয়েটের তালিকাকে আরও সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে যুগান্তকারী অবদান রাখবে।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন আছে এখানে। ২০২০ সালের এসএসসি পরীক্ষার পরই স্কুল-কলেজ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে এইচএসসি পরীক্ষা নেওয়া হয়নি, তাদের অটো পাস দেওয়া হয়েছে পূর্ববর্তী পরীক্ষায় প্রাপ্ত ফলাফল বিবেচনায়। তবে এরা অন্তত তাদের কোর্স সমাপন করে পরীক্ষার প্রস্তুতি পর্যায়ে ছিল মহামারি শুরুর আগে। এক বছরের বেশি সময় বসে থাকার পর সম্প্রতি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের ভর্তির নোটিশ এসেছে। ভর্তি প্রক্রিয়া শেষ করে কবে তারা ক্লাস শুরু করবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এর মধ্যে এ বছরই আরেকটি ব্যাচকে সংক্ষিপ্ত পরীক্ষা বা অটো পাস দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির লাইনে দাঁড় করিয়ে কী ফায়দা হবে?

সংক্ষিপ্ত কোর্স পরিকল্পনা নিয়ে শিক্ষাবিদেরা ইতিমধ্যে তাঁদের বিরুদ্ধ মত প্রকাশ করেছেন। বাংলা, ইংরেজি, অঙ্কের মতো মৌলিক বিষয় বাদ দেওয়ার পরিকল্পনা নিতান্ত অবিবেচনাপ্রসূত। সিলেবাস যদি কমাতেই হয়, বরং অন্যগুলো বাদ দিয়ে বা কমিয়ে এ তিন বিষয় কয়েক মাস পড়িয়ে পরীক্ষা নেওয়া উচিত।

করোনা মহামারিতে অন্তত ১৬ মাস সময় হারিয়েছে শিক্ষার্থীরা। বিনীত পরামর্শ, এ বাস্তবতাকে মেনে নিন। ২০২০-এর স্কুল, কলেজ সেশন এক বছর পিছিয়ে ২০২১ থেকে গণনা করা হোক সব শ্রেণির জন্যই। সে ক্ষেত্রে ২০২১-এর এসএসসি বা এইচএসসি পরীক্ষা বলতে কিছু থাকবে না। এ পরীক্ষা হতে পারে ২০২২-এর মার্চ-এপ্রিলে এবং এইচএসসি তার পরের মাসে। আর স্কুল খোলার ব্যবস্থা করুন যত তাড়াতাড়ি পারা যায়, তা শ্রেণিকক্ষে মাস্ক পরিয়ে দূরে দূরে অর্ধেক ছাত্র বসিয়ে হোক বা টিকা দিয়েই হোক।

মো. তৌহিদ হোসেন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব

সান নিউজ/এনএম

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

কোচিং সেন্টারে মিলল বিপুল অস্ত্র-বিস্ফোরক

রাজশাহী নগরীর কাদিরগঞ্জ এলাকায় একটি বাড়ি থেকে অস্ত্র ও বিস্ফোরক তৈরি সরঞ্জাম...

আলাস্কায় ট্রাম্প-পুতিন বৈঠক শেষ, যুদ্ধ স্থগিতের ঘোষণা নেই

যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কায় রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট...

কোনো চাঁদাবাজকে বাংলাদেশে থাকতে দেওয়া হবে না : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

কোনো চাঁদাবাজকে বাংলাদেশে থাকতে দেওয়া হবে না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র...

রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মালয়েশিয়ার প্রভাব কাজে লাগাতে চায় বাংলাদেশ

দীর্ঘদিনের রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা জোরদার করা...

ফের ৯৮ বাংলাদেশিকে বিমানবন্দর থেকে ফেরত পাঠাল মালয়েশিয়া

ফের কুয়ালালামপুর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আটকে দেওয়া হয়েছে ৯৮ বাংলাদেশিকে। বিম...

ফের ৯৮ বাংলাদেশিকে বিমানবন্দর থেকে ফেরত পাঠাল মালয়েশিয়া

ফের কুয়ালালামপুর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আটকে দেওয়া হয়েছে ৯৮ বাংলাদেশিকে। বিম...

‘গোপন রাজনীতি’, ছাত্রশিবির ও ডাকসু নির্বাচন নিয়ে উত্তপ্ত ঢাবি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গেস্টরুম সংস্কৃতি এবং এই কেন্দ্রিক নির্যাতন গত ১৫ বছরে ছি...

রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মালয়েশিয়ার প্রভাব কাজে লাগাতে চায় বাংলাদেশ

দীর্ঘদিনের রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা জোরদার করা...

কোনো চাঁদাবাজকে বাংলাদেশে থাকতে দেওয়া হবে না : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

কোনো চাঁদাবাজকে বাংলাদেশে থাকতে দেওয়া হবে না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র...

আলাস্কায় ট্রাম্প-পুতিন বৈঠক শেষ, যুদ্ধ স্থগিতের ঘোষণা নেই

যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কায় রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা