আন্তর্জাতিক

ফিলিস্তিনে ইসরাইলি আগ্রাসন : জয়-পরাজয়ের সমীকরণ

সান নিউজ ডেস্ক : দখলদার ইহুদিবাদী ইসরাইলের সাথে ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ সংগঠনগুলোর যুদ্ধ শুরুর এক মাস আগ থেকেই সম্ভাব্য যুদ্ধের বিষয়ে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল। গত ১০ মে যুদ্ধ শুরু হয়। এ মাসটি ফিলিস্তিনিদের জন্য নাকাবা বা বিপর্যয়ের মাস হিসেবে পরিচিতি। কেননা ১৯৪৮ সালের ১৪মে অবৈধভাবে ইসরাইল নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ইসরাইল প্রতিষ্ঠার ৭৩ বছর পেরিয়ে গেলেও আজো ফিলিস্তিন ও ইসরাইলের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত অব্যাহত রয়েছে। এমনকি মাঝেমধ্যে বড় ধরনের কয়েকটি যুদ্ধও সংঘটিত হয়েছে। ইসরাইল নতুন করে ফের ফিলিস্তিনে যুদ্ধ বাধিয়েছে।

আরব ভূখণ্ড দখল করে অবৈধভাবে ইসরাইল রাষ্ট্রের আবির্ভাবই ইসরাইল ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে সংঘাতের মূল কারণ। ফিলিস্তিনের ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসের রাজনৈতিক শাখার প্রধান সালেহ আল-আরাভি বলেছেন, ইসরাইলকে আমরা এটা বুঝিয়ে দিতে চাই যে আমাদের যুদ্ধের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে আল কুদস মুক্ত করা এবং এটা আমাদের কাছে সবচেয়ে অগ্রাধিকারযোগ্য বিষয়। তিনি আরো বলেছেন, বর্তমানে ইসরাইলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের 'সোর্ড অব কুদস' নামে যে অভিযান চলছে তাতে প্রমাণিত হয়েছে প্রতিরোধ যোদ্ধাদের মূল লক্ষ্য এখন কুদস শরীফের দিকে।

এদিকে ফিলিস্তিনিদের ঠেকাতে দখলদার ইসরাইলও ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে বর্বরোচিত হামলা চালিয়ে বেসামরিক মানুষজনকে হত্যা করছে। ইসরাইল সম্প্রতি প্রথমে কুদস শহরের আল-জাররাহ এলাকার মুসলমানদের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ অভিযান শুরু করে এবং পরবর্তীতে মুসলমানদের তৃতীয় পবিত্রতম স্থান মসজিদুল আকসায় নামাজরত মুসল্লিদের ওপর ভয়াবহ হামলা চালায়। ইসরাইলের এ হামলার জের ধরে ফিলিস্তিনিরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ফলে তীব্র উত্তেজনা তৈরি হয় এবং বলা যায় এটাই নতুন করে যুদ্ধ শুরুর মূল কারণ।

চলমান যুদ্ধ ফিলিস্তিনিদের ওপর চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধ। ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ সংগঠনগুলো আল আকসা মসজিদ রক্ষা এবং বায়তুল মোকাদ্দাসের ফিলিস্তিনিদের রক্ষার জন্য ইসরাইলের কোনো হুমকিকেই পরোয়া করেনি। এটা একটা অসম যুদ্ধ। কেননা ইসরাইল সর্বাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত। অন্যদিকে ফিলিস্তিনিদের জন্য পার্থক্য এটাই যে তারা পাথর মেরে যুদ্ধের সময়গুলো পার করে এখন ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে যুদ্ধ করার পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। ফিলিস্তিনিদের কাছে উন্নতমানের অস্ত্রশস্ত্র না থাকলেও বর্তমানে তারা ক্ষেপণাস্ত্র শক্তিতে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে কয়েক মিনিটের মধ্যে শতশত রকেট বা ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ইসরাইলে আঘাত হানার ক্ষমতা রাখে।

আরেকটি বিষয় হচ্ছে, 'সোর্ড অব কুদস' অভিযানে ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ সংগঠনগুলো এবার প্রতিরোধের ক্ষেত্রে যে শক্তির পরিচয় দিয়েছে তার ফলে ইসরাইলের বহু শহর যুদ্ধ ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে এবং খুব শিগগিরি ইসরাইল জুড়ে গণঅসন্তোষ দানা বেধে উঠতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ইসরাইলের প্রেসিডেন্ট রিউভেন রিভলিন এ কথা স্বীকার করে বলেছেন, হামাসের মুহুর্মুহু রকেট হামলায় বেশিরভাগ ইসরাইলি হতচকিত হয়ে গেছে। যুদ্ধ পরিস্থিতি তারা স্বচক্ষে দেখেও বিশ্বাস করতে পারছে না। অন্যদিকে ইসরাইলের অভ্যন্তরে বিভিন্ন স্থানে ফিলিস্তিন ও ইসরাইলিদের মধ্যে উত্তেজনা ও সংঘর্ষের ব্যাপারে ইসরাইলি পার্লামেন্টের ডানপন্থী দলের প্রতিনিধি এবং সাবেক আইন ও বিচারমন্ত্রী ইয়ালাত শাকেদ এক টুইটবার্তায় বলেছেন, শহরের পুলিশ নির্বিকার এবং সহিংসতা রোধে তারা কিছুই করতে পারছে না।

যদিও চলমান যুদ্ধে গাজার ফিলিস্তিনিরা ব্যাপক প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে কিন্তু ইসরাইল কম ক্ষতির সম্মুখীন হয়নি। হামাসের রকেট হামলায় ইসরাইলি নাগরিকদের জীবনযাত্রা অচল হয়ে গেছে। আরব রাজনৈতিক বিশ্লেষক আব্দুল বারি আতাওয়ান ইসরাইলে ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ যোদ্ধাদের নজিরবিহীন রকেট ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলার বিষয়ে বলেছেন, ইসরাইলের ইয়াফা, হাইফা, আল-লুদ প্রভৃতি শহরগুলোর রাস্তায় রাস্তায় যেভাবে স্থানীয় ফিলিস্তিনি ও ইহুদি অভিবাসীদের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়েছে তা নজিরবিহীন এবং বলা যায় এখান থেকে ইসরাইল নামক অবৈধ রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিলীন হওয়ার দিন গণনা শুরু হয়েছে।

আরেকটি বিষয় হচ্ছে, চলমান এ যুদ্ধে কেউ পরাজিত হবে কেউ বিজয়ী হবে। এখন পর্যন্ত ফিলিস্তিনের জনগণ ও প্রতিরোধ যোদ্ধারা বিজয়ের ধারা অব্যাহত রেখেছে। যেখানে ফিলিস্তিনিরা আগে ইসরাইলের বুলেটের জবাব পাথর দিয়ে দিত এখন তারা ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে আগ্রাসী ইসরাইলকে নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছে এবং ইসরাইল গাজা দখল করার কথা স্বপ্নেও ভাবে না। ইসরাইলের মোকাবেলায় ফিলিস্তিনিরা এরইমধ্যে নিজেদের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছে।

হামাসের রাজনৈতিক শাখার উপপ্রধান সালেহ আল আরাভি বলেছেন, ‘শত্রুরা যেন এটা না ভাবে যে তাদের হামলায় ফিলিস্তিনের কয়েকজন কমান্ডার শহীদ হওয়ায় হামাস দুর্বল হয়ে পড়েছে বরং প্রতিরোধের এ ধারা অব্যাহত থাকবে এবং প্রতিদিনই প্রতিরোধ শক্তি জোরদার হচ্ছে। কুদস শহরের ওপর একত্র আধিপত্য বিস্তারের যে চেষ্টা ইসরাইল করেছিল তা কার্যত ব্যর্থ হয়েছে এবং তাদের এ ব্যর্থতা কালের সাক্ষী হয়ে থাকবে।' এ হামাস নেতা আরো বলেছেন, এ যুদ্ধে ফিলিস্তিনের জনগণই বিজয়ী। কেননা যুদ্ধ বাধিয়েও ইসরাইল কুদস এর পরিচিতি মুছে দিতে পারেনি।

আরেকটি বিষয় হচ্ছে, ফিলিস্তিনিদের সোর্ড অব কুদস অভিযানে যারা পরাজিত হয়েছে তাদের মধ্যে প্রথম সারিতে রয়েছে মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বাধীন ফিলিস্তিন স্বশাসন কর্তৃপক্ষ। কেননা মুসলমানদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও ধর্মীয় আবেগের সঙ্গে যুক্ত আল কুদস শহরকে মুক্ত করাই ছিল বর্তমান যুদ্ধের মূল কারণ। সেখানে বহু ফিলিস্তিনিও বসবাস করে। কিন্তু ফিলিস্তিনের সরকার হয়েও স্বশাসন কর্তৃপক্ষ চলমান যুদ্ধে প্রতিরোধ যোদ্ধাদেরকে সমর্থন দেয়নি এমনকি সামান্য সহযোগিতাও তারা করেনি।

চলমান যুদ্ধে আরেকটি পরাজিত শক্তি হচ্ছে ইসরাইলের যুদ্ধবাজ প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। মূলত তিনি তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী ইয়ের লাপিদের নেতৃত্বে যাতে নতুন মন্ত্রীসভা গঠিত না হয় সেজন্য জনমত নিজের পক্ষে টানার জন্য তাড়াহুড়া করে যুদ্ধ বাধিয়েছেন। কিন্তু ফল হয়েছে উল্টো। কারণ ইসরাইলিরাও হতাহত হওয়ায় এবং তাদের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ায়, এ ছাড়া রাস্তায় রাস্তায় ইহুদি অভিবাসী ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ায় এটা প্রমাণিত হয়েছে, নেতানিয়াহু ইসরাইলি নাগরিকদের স্বার্থ রক্ষার চাইতে নিজের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখাকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছে।

ফিলিস্তিনিদের 'সোর্ড অব কুদস' অভিযানে আরেক পরাজিত শক্তি হচ্ছে ইসরাইল ও আমেরিকার তল্পিবাহক আরব দেশগুলো। সৌদি আরব অনেক বিলম্বে ইসরাইলি আগ্রাসনের নিন্দা জানালেও কোনো আরব দেশ ফিলিস্তিনিদের সাহায্যে এগিয়ে আসছে না। একমাত্র কাতার ভিত্তিক আল জাজিরা টিভি চ্যানেলই ইসরাইলি বর্বরতার চিত্র তুলে ধরছে। কিন্তু অন্য আরব দেশগুলোর মিডিয়া ফিলিস্তিনিদের প্রতি সমর্থন দেয়া থেকে বিরত রয়েছে। তারা ইসরাইলের বর্বরতার বিষয়ে সম্পূর্ণ নীরব রয়েছে।

এ ছাড়া চলমান যুদ্ধে মার্কিন সরকার ও জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের পরাজয়ও ফুটে উঠেছে। বাইডেন প্রশাসন মুখে ইসরাইল এবং ‘ডিল অব দ্যা সেঞ্চুরি’ পরিকল্পনার সমালোচনা করলেও বাস্তবে তারা ইসরাইলকে পূর্ণ সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। ‘ইসরাইলেরও আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে' -এমন দাবি তুলে তারা সরাসরি তেলআবিবের প্রতি সমর্থন ঘোষণা করেছে। এটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য নৈতিক পরাজয়। অন্যদিকে জাতিসংঘও স্বাধীনভাবে পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। সূত্র : পার্সটুডে।

সান নিউজ/এসএম

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

কোচিং সেন্টারে মিলল বিপুল অস্ত্র-বিস্ফোরক

রাজশাহী নগরীর কাদিরগঞ্জ এলাকায় একটি বাড়ি থেকে অস্ত্র ও বিস্ফোরক তৈরি সরঞ্জাম...

আলাস্কায় ট্রাম্প-পুতিন বৈঠক শেষ, যুদ্ধ স্থগিতের ঘোষণা নেই

যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কায় রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট...

কোনো চাঁদাবাজকে বাংলাদেশে থাকতে দেওয়া হবে না : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

কোনো চাঁদাবাজকে বাংলাদেশে থাকতে দেওয়া হবে না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র...

রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মালয়েশিয়ার প্রভাব কাজে লাগাতে চায় বাংলাদেশ

দীর্ঘদিনের রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা জোরদার করা...

‘গোপন রাজনীতি’, ছাত্রশিবির ও ডাকসু নির্বাচন নিয়ে উত্তপ্ত ঢাবি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গেস্টরুম সংস্কৃতি এবং এই কেন্দ্রিক নির্যাতন গত ১৫ বছরে ছি...

ফের ৯৮ বাংলাদেশিকে বিমানবন্দর থেকে ফেরত পাঠাল মালয়েশিয়া

ফের কুয়ালালামপুর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আটকে দেওয়া হয়েছে ৯৮ বাংলাদেশিকে। বিম...

‘গোপন রাজনীতি’, ছাত্রশিবির ও ডাকসু নির্বাচন নিয়ে উত্তপ্ত ঢাবি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গেস্টরুম সংস্কৃতি এবং এই কেন্দ্রিক নির্যাতন গত ১৫ বছরে ছি...

রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মালয়েশিয়ার প্রভাব কাজে লাগাতে চায় বাংলাদেশ

দীর্ঘদিনের রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা জোরদার করা...

কোনো চাঁদাবাজকে বাংলাদেশে থাকতে দেওয়া হবে না : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

কোনো চাঁদাবাজকে বাংলাদেশে থাকতে দেওয়া হবে না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র...

আলাস্কায় ট্রাম্প-পুতিন বৈঠক শেষ, যুদ্ধ স্থগিতের ঘোষণা নেই

যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কায় রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা