অপরাধ
ধর্ষণ ও হত্যা

সামাজিক অস্থিরতার এক ভয়ঙ্কর প্রতিচ্ছবি

নিজস্ব প্রতিবেদক:

সম্প্রতি রাজধানীর কুর্মিটোলায় ধর্ষণের শিকার হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী। বান্ধবীর বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাস থেকে নামার পর তাকে মুখ চেপে ধরে রাস্তার পাশে ঝোপে নিয়ে মারধর ও ধর্ষণ করা হয়। তখন অজ্ঞান হয়ে যান ওই ছাত্রী। ভাগ্য তার সহায় ছিল বলে জানে বেঁচে যান তিনি। তাই কষ্ট সহ্য করেও বলতে পেরেছিলেন তার বক্তব্য অনুযায়ী আইন শৃঙ্খলা বাহিনী আটক করে ধর্ষণকারীকে।

ধর্ষণের এমন ঘটনা দেশের যত্রতত্র, যার অনেকটাই থেকে যায় সবার অজানা। ধর্ষণের পর হত্যার মতো ভয়ানক প্রবনতা এখন ধর্ষকের মানসিকতায়। ধর্ষণ ও ধর্ষণ পরবর্তী হত্যার মতো ঘটনাগুলো ভাবনার বিষয় হয়ে উঠেছে সমাজের সব স্তরে। বিশেষ করে নারী আর শিশুদের জন্য মানসিক বিকারগ্রস্ততার রূপ নিচ্ছে।

১৯৯৫ সালে দিনাজপুরে বাংলাদেশ পুলিশের কয়েক সদস্য মিলে ইয়াসমিন নামের ১৪ বছর এক নারীকে গণধর্ষণের পর তাকে হত্যার পর লাশ ফেলে রাখা হয় রাস্তার পাশে। তখন এই ঘটনা দেশব্যাপি তোলপাড়ের সৃষ্টি করলেও থেমে নেই এই বর্বরতা।

বছরের শুরুতে ১১ জানুয়ারি শনিবার ঢাকার ধামরাইয়ে চলন্ত বাসে এক নারী শ্রমিককে (১৯) ধর্ষণের পর তাকে হত্যা করে নির্জন স্থানে লাশ ফেলে যায় ধর্ষক।

গত বছর ৭ জুলাই পুরনো ঢাকার ওয়ারিতে এক শিশুকে ধর্ষণের পর গলায় রশি পেঁচিয়ে তাকে হত্যা করে এক পাষণ্ড।
এরকম অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনার। গত বছরের ২ ফেব্রুয়ারি রাঙ্গামাটির কাপ্তাই উপজেলার রাইখালী পূর্বকোদালা বড়খোলা পাড়ায় তৃতীয় শ্রেণির এক শিশু ছাত্রীকে ধর্ষণের সময় চিৎকার করলে তাকে শ্বাসরোধে হত্যা করে শিক্ষক। এমন ভয়ঙ্কর সব ঘটনা লিখে বা বলে শেষ করা যাবে না।

এ পরিস্থিতি গোটা সমাজ ব্যবস্থায় এক ভয়ঙ্কর পরিবেশের সৃষ্টি করেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। সরকারও বিব্রত। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর থাকলেও আইনের মারপ্যাচে পার পেয়ে যাচ্ছেন প্রভাবশালী অপরাধীরা। সংসদে আলোচনার অন্যতম এজেন্ডাও হয় ধর্ষণের বিষয়গুলো। কিন্তু এখন পর্যন্ত এর কোনো সুরাহা হচ্ছে না। বিশেষজ্ঞদের অনেকে বলছেন ধর্ষণকারীর চলমান শাস্তি ব্যবস্থা যথাযথ নয়।

শিশু থেকে শুরু করে ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধাও হচ্ছেন ধর্ষণের শিকার। শিক্ষা প্রিতিষ্ঠানের শিক্ষকদের হাতেও নিরাপদ নয় শিক্ষার্থীরা। বলাৎকারের শিকার হচ্ছে ছেলে সন্তানেরা। বিকৃত মানসিকতার কাছে রেহাই পাচ্ছে না প্রতিবন্ধী নারী-শিশুরাও। ধর্ষ ক যখন বুঝতে পারে তার কৃতকর্মের জন্য সমস্যা তৈরি হতে পারে তখন ভিকটিমকে হত্যা করতেও পিছপা হয় না।

গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ি গত ১০/১২ দিনের ব্যাবধানে শুধুমাত্র ঢাকাতেই ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৩ শিশুসহ ৯ জন।।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যমতে বিদায়ী বছরেই সারা দেশে ১৪১৩ টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। ২০১৫ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সারা দেশে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ২৪৬ জনকে। এটি বিগত কয়েক বছরের মধ্যে ধর্ষণ অপরাধের সর্বোচ্চ রেকর্ড।

সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের অভাব, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রিতা ও অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় এ ধরণেরর ঘটনা দিন দিন বাড়ছে। এছাড়া নারীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনা করে মামলার গুরুত্ব দেয়া আর সংশ্লিষ্টদের সমন্বয়হীনভাবে কাজের জন্য এ ধরণের ঘটনা বাড়ছে।

আর বরাবরের মত আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, শুধু ধর্ষণ নয় সব ধরণের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কাজ করছেন তারা।

ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা:

আইন ও সালিশ কেন্দ্র বলছে, ২০১৫ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সারা দেশে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ২৪৬ জনকে।

ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যা করেছেন আরও ৪৮জন। এরমধ্যে ২০১৫ সালে হত্যা করা হয়েছে ৬০ জন ও আত্মহত্যা করেছেন ২ জন। ২০১৬ সালে হত্যা করা হয়েছে ৩৭ জনকে আর আত্মহত্যা করেছেন ৮ জন। ২০১৭ সালে হত্যার শিকার হয়েছেন ৪৭ জন আর আত্মহত্যা করেছেন ১১ জন। ২০১৮ সালে ধর্ষণ পরবর্তী হত্যা করা হয়েছে ৬৩ জনকে আর আত্মহত্যা করেছেন ৭ জন। ২০১৯ সালে ৭৬ জনকে হত্যা আর আত্মহত্যা করেছেন ২০ জন।

এদিকে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্য অনুযায়ী গত আট বছরে সারা দেশে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৮ হাজার ৭৮টি। এবং ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৬২৬ জনকে। ২০১৯ সালেই সারা দেশে ধর্ষণ ও গণধর্ষণের ১ হাজার ৬০৭টি। আর ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৭৭ জনকে।

এছাড়া নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে করা মামলায় সাজার হারও কম। পরিসংখ্যান বলছে মাত্র ১১ দশমিক ২৬ শতাংশ মামলায় সাজা হয়েছে।

বিশ্লেষকরা যা বলছেন:
এ বিষয়ে অপরাধ ও সমাজ বিশ্লেষকরা বলছেন এ সমস্যা সমাধানেরও পথ রয়েছে। আইনের সঠিক প্রয়োগের সঙ্গে সমাজের সর্বোস্তরের মানুষকেও একই সঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে, সচেতন হয়ে এক সঙ্গে এর বিরুদ্ধে কাজ করতে হবে। অপরাধ ও সমাজ বিশ্লেষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক তৌহিদুল হক বলেন, “সামাজিক অস্থিরতার একটি সময় চলছে আর সেটি ২০১৭ সাল থেকে শুরু হয়েছে। ২০১৮ সাল থেকে নারী নির্যাতন নীপিড়ন দ্বিগুন হয়েছে। চলতি বছরে অবস্থা আরও ভয়াবহ হবে। সামাজিক অস্থিরতার মূল কারণ হলো, অন্যান্য মামলাগুলোর মত সমান গুরুত্ব পায় না। সামাজিক ঐতিহ্য বা সামাজিক শিষ্ঠাচার তৈরি করতে গেলে রাষ্ট্র বা সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো মানুষের সম্পর্ক, ব্যক্তিত্ব ও অবস্থানকে যেভাবে গুরুত্ব দেয়া দরকার সেভাবে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না। বিচারের ক্ষেত্রে রয়েছে বৈষম্য”।

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ধর্ষণের ঘটনায় প্রশাসন এটিকে যত গুরুত্ব দিয়ে দেখেছে তার কয়েকদিন পরে একটি বাসে এক নারীকে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়েছে সে বিষয়টি এত বেশি আলোচিত হয়নি। কারণ ধর্ষণের শিকার ব্যক্তির বেলাতেও তার সামাজিক মর্যাদা অনুসারে ঘটনাকে গুরুত্ব দেয়া হয় এই সমাজে। আমাদের সমাজের নারীকে তার সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার আলোকে মূল্যায়ন করার কারণে ধর্ষকও এই সংকটের সুযোগটা নিচ্ছে। এর সঙ্গে রয়েছে বিচারহীনতার সংস্কৃতি। যে ঘটনা প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে সেটির বিচােই কেবল দ্রত হতে দেখা যায়। অন্যগুলো হারিয়ে যায় একটির পেছনে আরেকটি।

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নুর মোহাম্মদ বলেন, “আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, আইনজীবী, সমাজতথ্যবিদরা একসঙ্গে বসা উচিত। সবাই বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করছেন। মামলা হলে বছরের পর বছর ঘুরতে থাকে। সেটি নিষ্পত্তি হতে অনেক লম্বা সময় লাগে। এই বিষয়গুলো দেখার বিষয় আছে। এছাড়া মামলা তদন্তের পর যখন কোর্টে যাবে তখন তদন্ত কর্মকর্তা, চিকিৎসক ডেকে পাওয়া যায় না। সাক্ষী পাওয়া গেলেও আদালতে তাদের উপস্থিত করা যায় না”।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও অপরাধ বিজ্ঞানের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জনের মতে, নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে বাংলাদেশে শক্ত আইন আছে৷ কিন্তু শাস্তি দিয়ে খুব বেশি অপরাধ কমানো যায় না৷ আর এটা ধর্ষণ এবং ধর্ষণের পর হত্যার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য৷ আমাদের এখানে সমাজের ভিতরে অসংখ্য উপাদান আছে যা ধর্ষণ বা নারীর প্রতি সহিংসতাকে উসকে দেয়৷ আমাদের সমাজে এখানো নারীকে ভোগের সামগ্রী মনে করা হয়৷ তাকে সেভাবে উপস্থাপনও করা হয় বিভিন্ন মাধ্যমে৷
তাঁর মতে, ফৌজদারী বিচার ব্যবস্থা এবং সাক্ষ্য আইনে নানা সমস্যা রয়েছে৷ আছে ধর্ষণের শিকার একজন নারীর চরিত্র হননের সুযোগ৷ কিন্তু একজন যৌনকর্মীর সঙ্গেওতো তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করা যাবে না৷ করা হলে সেটা ধর্ষণ হবে৷ এখানে অভিযোগ থানায় জানাতে গিয়েও ধর্ষণের শিকার হয়।

সান নিউজ/সালি

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

ঝালকাঠি নার্সিং কলেজে অচল অবস্থা!

ঝালকাঠি প্রতিনিধি: ঝালকাঠি নার্সি...

লক্ষ্মীপুরে স্বাস্থ্য নিরাপত্তা স্কিম চালু

লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি: লক্ষ্মীপুরে...

অবৈধ ইটভাটায় হুমকির মুখে জীববৈচিত্র্য

রংপুর ব্যুরো: রংপুর জেলাসহ বিভাগে...

ভোলায় বঙ্গবন্ধু সেজেছে ক্ষুদে শিক্ষার্থীরা

ভোলা প্রতিনিধি: শ্রদ্ধা ও ভালোবাস...

মোস্তফা হত্যার বিচারের দাবিতে মানববন্ধন

মো. নাজির হোসেন, মুন্সীগঞ্জ: মুন্...

ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিলেন কলেজছাত্রী

জেলা প্রতিনিধি: ব্রাহ্মণবাড়িয়া জে...

ছাত্রলীগ নেতাকে কুপিয়ে হত্যা

জেলা প্রতিনিধি : টাঙ্গাইলের নাগরপুরে ছাত্রলীগ নেতা জাহিদ হাস...

ট্রাক্টর উল্টে চালক নিহত

জেলা প্রতিনিধি: চাঁপাইনবাবগঞ্জ জে...

সিকান্দার আবু জাফর’র জন্মদিন

সান নিউজ ডেস্ক: আজকের ঘটনা কাল অত...

চার অঞ্চলে বৃষ্টির আভাস

নিজস্ব প্রতিবেদক : দেশের চার অঞ্চলের ওপর দিয়ে অস্থায়ীভাবে দ...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা