কুদরতে খোদা সবুজ, কুষ্টিয়া : যে বয়সে দুরন্তপনা, খেলা আর দুষ্টুমিতে মত্তো থাকবার কথা ঠিক সে সময় ১০ বছরের শিশু শান্তর জীবনটা এর উল্টো। জীবনের প্রথম তিন বছর তেমন বোঝা যায়নি, তবে ধীরে ধীরে তার অস্বাভাবিক আচরণ দেখে বোঝা যায় সে প্রতিবন্ধী শিশু। আর সব সাধারণ শিশুর থেকে ব্যতিক্রমী এই শিশুকে নিয়ে এখন রাজ্যের উৎকণ্ঠা তার দিনমজুর বাবা-মায়ের।
শিশুটির চিকিৎসাও করাতে পারছেন না তারা। কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার ছাতিয়ান উত্তর পাড়া গ্রামের মো. জসিম উদ্দিনের ছেলে শান্ত হোসেন। হাঁটা-চলা স্বাভাবিক হলেও সে একজন মানসিক প্রতিবন্ধী। সুযোগ পেলেই ময়লা-আবর্জনা, ড্রেনের বর্জ্য, মাটি, সাবান, কলা গাছ, কপির ডাঁটা, জামের আঁটি এমনকি মুরগির বিষ্ঠা পর্যন্ত খেয়ে ফেলে সে। শান্তর এই অস্বাভাবিক আচরণের কারণে জন্মের সাড়ে তিন বছর বয়স থেকেই দিন রাত বেঁধে রাখা হয় তাকে।
সরেজমিন জসিম উদ্দিনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ঘরের একটি সিমেন্টের খুঁটির সঙ্গে পায়ে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে শান্তকে। বাঁধা অবস্থায় বসে ভাত খাচ্ছিল শান্ত। এসময় অস্বাভাবিক আচরণ করতে থাকে সে।
শিশু শান্তর বাবা জসিম উদ্দিন জানান, আগামী মাসে শান্তর বয়স ১০ বছর পূর্ণ হবে। জন্মের পরে আমরা কিছুই বুঝতে পারিনি। তবে সাড়ে তিন বছর বয়সে তার অবস্থা বুঝতে পারি। শান্ত প্রথমে ময়লা-আবর্জনাসহ সামনে যা পায় তাই মুখে ঢুকিয়ে দেয়। বুঝতে পারে না কোনটা খাদ্য আর কোনটা অখাদ্য। এ অবস্থা দেখে ২০১৪ সালে সর্ব প্রথম রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তাকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাই। দুই দফায় এখানে দেখিয়েছি তাকে। এরপর ২০১৮ সালে নিয়ে যাই পাবনা মানসিক হাসপাতালে। সেখানে ডাক্তার প্রেসক্রিপশন লিখে দিয়ে টানা পাঁচ বছর চিকিৎসা চালাতে বলেন। কিন্তু, টাকার অভাবে নিয়মিত আর চিকিৎসা করাতে পারিনি।
জসিম উদ্দিন বলেন, আমি পেশায় একজন দিনমজুর। বর্গা নিয়ে চাষ করি। অন্যের জমিতে শ্রম দিয়ে সংসার চালাই। ছেলের চিকিৎসার টাকা জোগাড় করতে পারিনি। গত বছরের মে-জুন এই দুই মাস কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপারের তত্ত্বাবধানে পাবনা মানসিক হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করানো হয়েছিল। কিন্তু, গত সাত মাস টাকার অভাবে আর চিকিৎসা করাতে পারিনি।’
তিনি আরও বলেন, চিকিৎসকরা বলেছেন তার ছেলে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। সুস্থ হতে সময় লাগবে। ছেলে এই সব কিছু ঠিকমতো বলে; আবার কিছুক্ষণ পরেই সব ভুলে যায়।চিকিৎসকের আগের প্রেসক্রিপশন ধরে ওষুধ কেনার জন্য প্রতিদিন ৩৫ টাকা প্রয়োজন। কিন্তু অনেক সময় টাকার অভাবে ওষুধ কিনতে পারি না। বেঁধে রাখেন কেন এমন প্রশ্নের জবাবে জসিম উদ্দিন বলেন, দিনরাত সব সময় শান্তকে বেঁধে রাখতে হয়। না হলে বের হয়ে নির্জন কোনও জায়গায় চলে যায়। কখনও বাঁশের ঝাঁড়ে, বনে-বাদাড়ে, ক্ষেতের ভেতর ঢুকে বসে থাকে। যেখানে যায় বুদ্ধি কম থাকায় সেখানেই অনিষ্ট করে। নিজের ছোট দুই ভাইবোনকে এই আদর করে তো এই মারে। এজন্য বেঁধে রাখি। তাও ঢিলে গিঁট দিলে খুলে বের হয়ে যায়। সে জন্য টাইট করে পাঁচটা-সাতটা গিঁট দিতে হয়। দিনে পাঁচবার পাঁচ জায়গায় বেঁধে রাখা হয় তাকে। রাতে ঘুমানোর পর খাটে তার পায়ের বাঁধন খুলে দেই। সকালে উঠে আবার বাঁধি। নিজের সন্তানের সাথে পশুর মতো এমন আচরণ আর ভালো লাগে না। কিন্তু, উপায় তো নাই। ছেড়ে দিলে যদি অন্য কারও ক্ষতি করে, বা যদি নিজেরই ক্ষতি করে। ওর তো বুদ্ধি কম। ভয়ে থাকি সারাক্ষণ।
শিশু শান্তর মা সীমা খাতুন বলেন, চিকিৎসা চলাকালীন সময় বেঁধে রাখা লাগে না। চিকিৎসক বলেছেন, একাধারে পাঁচ বছর চিকিৎসা করানো হলে ভালো হতে পারে। তবে এক দুই মাস চিকিৎসা চলার পর টাকার অভাবে বন্ধ থাকে। তখন বেঁধে রাখা লাগে। চিকিৎসার জন্য টাকা দরকার। ওর বাবার কাছে তো নাই। সরকারি ভাতা খুব কম। সে টাকায় ওষুধ কেনাও সম্ভব হয় না। কীভাবে যে ছেলের চিকিৎসা করবো বুঝে পাই না। কেউ কি একটু দয়া করবেন?
স্থানীয় মিরপুর উপজেলার ছাতিয়ান ইউনিয়ন পরিষদের ২নং ওয়ার্ড সদস্য মো. উজ্জল হোসেন বলেন, শান্ত সমাজ সেবা থেকে প্রতিবন্ধী ভাতা পায়। এ ছাড়াও স্থানীয় চেয়ারম্যান আশ্বস্ত করেছেন, শান্তর চিকিৎসা বাবদ সহযোগিতা করবেন।
সমাজের দানশীল মানুষদের কাছে এই শিশুটির জন্য সহায়তা প্রার্থনা করেছেন তার বাবা জসিম উদ্দিন। তার সঙ্গে যোগাযোগ করা যেতে পারে 01923-074707 এই নম্বরে।
সান নিউজ/কেটি