দূর থেকে মনে হবে,পরিত্যক্ত কোনো কুঁড়েঘর। কিন্তু কাছে গেলে বোঝা যায়- এখানে মানুষের বসবাস। অসুস্থ বৃদ্ধ মা ও তিন সন্তান নিয়ে এ ঘরেই কাটছে ফেরদৌসী বেগমদের জীবন-সংসার। ভাঙা টিন, ছেঁড়া বেড়া, কাঁধামাটির মেঝে। বাইরে থেকে দেখলে মনে হয় এ ঘরে থাকার মতো কিছু নেই। অথচ এটাই আশ্রয়হীন ফেরদৌসী বেগমের পরিবারের থাকার ঘর।
দিনের বেলায় একটু স্বস্তি পেলেও সন্তানদের নিয়ে ঘর ভেঙে পড়ার ভয়ে রাত কাটে তাদের। ঝড়-বৃষ্টিতে বারবার ঘর উড়ে যায়। খড়কুটো দিয়ে আবারো মেরামত করেই বসবাস করছেন তারা। কতটা অসহায় হলে- একটি পরিবার এইভাবে বসবাস করতে পারে- তা এই পরিবারকে দেখলে বুঝা যায়।
নোয়াখালী সদর উপজেলার ১১নং নেয়াজপুর ইউনিয়নের ৯নম্বর ওয়ার্ড়ের নেয়ামতপুর গ্রামের সর্দার বাড়ি (জেলে বাড়ির সেতু) সংলগ্ন খালপাড়ের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে ভাঙাচোরা ফেরদৌসী বেগমের ঝুপড়িঘর।
সোমবার (২২ সেপ্টেম্বর) সরেজমিনে দেখা যায়, ঝুপড়ি ঘরে যাওয়ার কোন রাস্তা নেই, হাটু –কোমর সমান পানি মাড়িয়ে যেতে হয়। এক কক্ষ বিশিষ্ট ঘরের ভিতরে পানি, ভাঙা টিন ও বাঁশ দিয়ে তৈরী তাদের ঝুপড়িঘর।
এই পরিবারের নেই কোন জমি, নেই পাকা ঘর-যা আছে, তা হলো চটের বেড়া আর ভাঙা টিনের ভাঙা ছাউনি দিয়ে তৈরি একটি আশ্রয়।
বর্ষায় টিনের ছিদ্র দিয়ে পানি পড়ে, শীতে কুয়াশা ও ঠান্ডা বাতাস ঢুকে, আর গ্রীষ্মে ঘরটা আগুনের মতো গরম হয়ে ওঠে। নেই কোন বিদুৎ সংযোগ। তবুও এই ঝুপড়ি ঘরেই তাদের বসবাস, তাঁদের বেঁচে থাকার ঠিকানা। বৃদ্বামা ও তিন সন্তানকে নিয়ে এখানে দিন কাটছে তাদের, এই ভাঙা ঘরের ভেতরেই চলছে ফেরদৌসীদের জীবন যাপন।
ভোর হলেই ফেরদৌসী বেরিয়ে পড়েন কাজের সন্ধানে। কখনো অন্যের বাড়িতে ঝি-এর কাজ, কখনো দিনমজুরি। যে টাকা হাতে আসে, তা দিয়েই চলে সংসার। কিন্তু সবদিন খাবার জোটে না। অনেক রাত কেটে যায় সন্তানদের খালি পেট নিয়ে। সরকারের পক্ষ থেকেও কোন সহযোগিতা পায়নি এই পরিবারটি।
ফেরদৌসী বেগম বলেন, আমরা গরীব মানুষ- আমাগো থাকার মত কোন ঘর নাই, জমিও নাই। তাই খাল পাড়ের এই খাসজমিতে আশ্রয় নিয়েছি। এর আগে প্রায় ১৫ বছর যাবত অশ্বদিয়া ইউনিয়নের খাল পাড়ে এইভাবেই বসবাস করেছি। কিন্তু খাল কাটার পরে সেখানে আর থাকতে পারিনি। প্রায় ৬ বছর যাবত এখানে বসবাস করছি।
চোখের পানি মুছতে মুছতে ফেরদৌসী আরো বলেন, “দিনমজুরি করে বাচ্চাদের মুখে খাবার তুলে দেয়ার চেষ্টা করি, কিন্তু সব সময় পারি না। তবুও আল্লার কাছে শুধু প্রার্থনা করি, আমার অসুস্থ সন্তানরা যেন ভালো থাকে-সুস্থ থাকে। ঝুপড়ি ঘরে আমরা ছেলে-মেয়ে নিয়ে রাতে নিরাপত্তাহীনতায় থাকি। সব সময় থাকে সাপের ভয়। বর্ষার সময় ঘরে টপ-টপ করে পানি পড়ে। তখন সন্তানদের নিয়ে বসে থেকেই রাত কাটাতে হয়। মানুষের কাছে শুনি সরকার নাকি গরিব মানুষকে ঘর দেয়। আমাদের একটা ঘর দিলে উপকৃত হতাম।
তিনি বলেন, কয়েকমাস আগে খাল পাড়ের গাছ ভেঙে তার এই ঝুপড়ি ঘরের উপরে পড়ে !এতে ঘর ভেঙে আরো বেশী দূর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। ঘরের ভেতরের জীবন কাটানো অনেক কষ্টকর। টিনের ছিদ্র দিয়ে পানি পড়ে ঘাটে ও মাটির মেঝেতে, শীতে কুয়াশা ও হাড় কাঁপানো ঠান্ডা ঢুকে ঘরে, আর গ্রীষ্মে ঘরের টিনের তাপ দম বন্ধ করে দেয়। এতে তার সন্তানরা সবাই অসুস্থ, তিনিও অসুস্থ। আমার স্বামী থেকেও নেই, কোন খোঁজ-খবরও নেয়না।
তিনি আরো বলেন, অভাবের কারনে সন্তানদেরও ঠিকমত লেখা-পড়া করাতে পারছিনা। “মানুষের সাহায্য-সহযোগীতা পেলে আমরা হয়তো বাঁচতে পারবো।" সবার সাহায্য সহযোগিতায় হয়তো একদিন আমরা একটু শান্তিতে থাকতে পারবো। দেশে-বিদেশে অবস্থানরত সবার কাছে সাহায্য সহযোগিতা কামনা করছেন তিনি।
ফেরদৌসী বেগম এর বৃদ্বা মা বলেন, বয়স্ক ভাতায় নাম আছে। কিন্তু এখন ভাতা পাচ্ছিনা। আমার অত্যাধিক অ্যাজমা রোগের কারণে শ্বাসকষ্ট। ওষুধ কিনতে পারছিনা। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া জাহানারা বেগম বলেন, সরকার নাকি অসহায় ভূমিহীনদের বসতবাড়ি করে দেয় আমরা তো পাইনি।
স্থানীয় বাসিন্দা মতিন বলেন, একটি ঝুপড়ি ঘরে বসবাস করে করছেন ফেরদৌসী আপা ও তার পরিবার। তাদের জীবন যাত্রা খুব কঠিন। ঝুপড়ি ঘরে যাওয়ার কোন রাস্তা নেই, হাটু –কোমর সমান পানির ভিতর দিয়ে যেতে হয়। তার তিন ছেলে এক মেয়ে সন্তানকে নিয়ে ভগ্নদশা ঝুপড়ি ঘরে বসবাস করছেন। এ ছাড়াতো তাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। এই ঘরে বসবাসের কারনে তারা সবাই রোগাক্রান্ত। ২০২৪ সালের বন্যায় তারা বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন। কোন সাহায্য-সহযোগীতা পায়নি তারা।
আরেক স্থানীয় বাসিন্দা তাজুল ইসলাম স্বপন বলেন, ফেরদৌসী বেগমের পরিবারকে সহায়তা দেওয়া প্রয়োজন। প্রশাসন ও বৃত্তবানদের উচিৎ তাদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া। স্থানীয় প্রশাসন ও দেশ-বিদেশের বৃত্তবানদের সহযোগিতায় ফেরদৌসীর পবিরবারের সদস্যদের জীবন পরিবর্তন হতে পারে। সবার সাহায্য সহযোগীতায় তার কুড়েঘর মেরামত হতে পারে। অথবা তার পরিবারের জন্যে একটি স্থায়ী বসবাসের ব্যবস্থা হতে পারে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বলেন, ওনারা ভূমিহীন এটা আপনার থেকে মাত্র জানলাম, ওনারা যদি ভূমিহীন হন তাহলে তারা আবেদন করলে- আমরা যাচাই করে টিন অথবা ঘর দেয়ার চেষ্টা করবো।
সান নিউজ/আরএ