সুলতানা আজীম:
(দ্বিতীয় কিস্তি)
আমাকে নিয়ে বাইরে যেতে চাইলেন এক বন্ধু। বৃষ্টি ক্লান্ত দিন শেষের সন্ধেটি ছিলো বৃষ্টি বিহীন। স্পনটিনিয়াস সিন্ধান্ত নেবো, সে চরিত্র আমার নয়। তবুও গেলাম। আমার কোন কোন বন্ধুর সন্ধের শুরু এবং শেষ হয় ওখানে। ওখানেই, যেখানে ওই তরুণ অথবা যুবকের সাথে দেখা হয়েছিলো আমার। এই বন্ধুটি, যার নাম অনুপম। দুটো বই নিয়ে আলোচনা করতে চায়। যে দুটো পড়েছে সে ওই সপ্তাহে। যে কোন বই এবং সাহিত্যের সাথে আমার সর্ম্পক নর্থ পোল আর সাউথ পোলের। ওর এবং আরো কজন বন্ধুর,সাহিত্য নিয়ে আমার সাথে আলোচনা করার আগ্রহ মরুভ‚মিতে এসে, সমুদ্র¯স্নান করতে চাওয়ার মতো।
বৃষ্টি ধোয়া গাছের পাতারা এতো সুন্দর আর উজ্বল এতো! ছোট্ট বাগানটির ভেতর বসতে ইচ্ছে করলো আমার। ‘তোর যে রকম কোল্ড এর্লাজী, ঠান্ডা লাগবে ওখানে বসলে’ বললো অনুপম। ফিরে যা”িছ অন্য জায়গায় বসবো বলে। ‘আমাদের সাথে বসেন কিছুক্ষণ’। তরুণ অথবা যুবকের আহবান। হ্যাঁ সে। খাচ্ছিলো আর কথা বলছিলো দুজনের সাথে। হতে পারে তারা ওর বন্ধু। চারটি চেয়ার রয়েছে একটি টেবিলে। খালি ছিলো যেটি, বসলাম সেটিতে। অভদ্রতা হয় যে না বসলে। শুরু করতে যাচ্ছে, এমন একটি পরিকল্পনার কথা জানালো সে। হলো আরো কিছু কথা। বিরক্ত হতে পারে অনুপম, তাই ফিরলাম ওর কাছে। কানডিড এবং ভলতেয়ারের অন্য কিছু গল্প অনুবাদ করতে চায় সে। আমার সহযোগীতা দরকার। উচ্ছসিত আবেগে অধীর অনুপম। কোন পর্যায়ে আমার অসহায়ত্ব তখন, বল? বৃষ্টি স্নিগ্ধ সন্ধ্যেটি শেষ হলো সে দিনের, আমার অসহায়ত্বকে সমীহ না করে। ভালো যে, হলো তবুও।
আবারো দেখা হলো ওর সাথে। ওখানেই। অন্য একদিন। খাবার অর্ডার করার দায়িত্ব নিজে থেকেই নিলো সে। অন্য তিন বারের মতো। সেদিনই প্রথম আলোচনা হলো, বেশী সময়, বিভিন্ন বিষয়ে। ‘আপনাকে এগিয়ে দেই সামনের দিকে, গাড়ি আসার অপেক্ষায় এতো রাতে একা এখানে দাড়িয়ে থাকা ঠিক নয়।’ বললো সে। কথা হয় যেতে যেতে। যে সব বিষয়ে, মতপার্থক্য নয়, মতবিরোধ হয় বেশী। রাগ হয়। ইচ্ছে করে ওয়ানট্র্যাক্ড মানসিকতা ভেঙে দিতে ওর। বলতে ইচ্ছে করে- সীমাবদ্ধতা সংর্কীণ করে মানুষকে, আত্মকেন্দ্রীক করে। এতো রাগ হয়। এতো বেশী রাগ হয়, বলা হয় না কিছু। কোন কিছুই। অভদ্রতা হবে ভেবে। শেষ হলো সেদিন, যুবকের সাথে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা। শেষ হলো না, ওর কাছ থেকে পাওয়া অভিজ্ঞতা। সে তর্ক করে। তর্ক করতে পছন্দ করে। নিজের ধারণা এবং মতকে চুড়ান্ত মনে করে অধিকাংশ সময়। বলেও সেভাবে। বেশী আত্মবিশ্বাসী। এবং এবং এবং। আধুনিক ভাবে নিজেকে। অহঙ্কারীও অনেক। ফিরে এলাম অভিজ্ঞতার অস্বস্তি নিয়ে।’’
হারিয়ে যাচ্ছে পরিশ্রান্ত সূর্যমনি কোন এক অজানায়। রহস্যময়ী সন্ধ্যামেয়েটি বিলিয়ে দেয় নিজেকে চারপাশের বাগান আর বনানীতে, সবটুকু উদারতায়। দেখি, কী ভাবে পালিয়ে যায় মৃদূ পায়ে মধুর বিকেল। দেখি, ডানার পালকের নীচে সবকিছু ঢেকে, কী র্নিভয়ে নেমে আসে কোকিল রংয়ের রাত। দেখি, কী ভাবে হারিয়ে যাচ্ছে প্রিয় বিকেলটি আমাদের। দেখতে দেখতেই বলে বর্ণালী।
‘‘আমার পোষ্টিং হয় অন্যদেশে। চলে যাই দুওে, অনেক দূরে। অচেনা পৃথিবী। অন্য জীবন। পেরিয়েছে চার মাস। যে কাজটি শুরু করার পরিকল্পনা করেছিলো যুবক, শুরু করেছে। পাঠিয়েছে আমাকে তা মেইলে। জবাব লেখা যতো দ্রুত সম্ভব,খুব জরুরী ভদ্রতা। ব্যস্ততা এতো, চাইলেও পারছি না লিখতে। অভদ্রতা হচ্ছে না? ফোন করি একদিন, হঠাৎ কিছু না ভেবে। অবাক কী হলো সে? শুনছে আমার কথা। বলছে কম। শেষ হলো এক সময় আমার কথা। শেষ হলো একসময়, তার শোনা। পেরিয়েছে এরপর আরো তিন মাস।
তুই তো জানিস, গ্রহন এবং বর্জন এ দুটো ব্যাপারে সচেতন আমি। নিজের জীবনের জন্যে যা জরুরী মনে হয় না, তা যতো আকর্ষনীয় হোক গ্রহণ করি না। সবার মতো হইনি। হতে চেষ্টাও করি নি কখনো। ফেইসবুকিং নির্দিষ্ট ছিলো আমার প্রফেশনাল কাজের বৃত্তে। কলিগ ফোরামে। র্স্মাট ফোনে মেইলের জবাব লিখছিলাম একদিন। তা শেষ না করেই একাউন্ট খুললাম দেশের ফেইসবুকে হঠাৎ। না ভেবে যে কটি কাজ করেছি জীবনে, এটি তার একটি। পরিচিতদের এ্যাড করলাম বন্ধুর লিষ্টে।
‘ভালো হলো আপনাকে ফেইসবুকে পেয়ে।’ ম্যাসেজটি এলো যুবকের কাছ থেকে।
চ্যাট করছি এই প্রথম। করছি তার সাথে ভীষণ রকম ইগোয়িষ্ট যে। করছি তার সাথে, খুব রাগ হয় যার ওপরে আমার। তার সাথেই চ্যাট করছি, বুঝতে পারছি না যাকে।
দুটো দিক রয়েছে ইগোর। পজেটিভ হলে ইগো থাকা জরুরী। নেগেটিভ হলে ইগো ক্ষতিকর। সীমাবদ্ধতা, সঠিক অভিজ্ঞতার অভাব এবং আরও কিছু কারণ রয়েছে এর পেছনে। সেটা বুঝতে পারছে না। মনে করছে সে যা জানে এবং বোঝে, সেটাই এ্যবসলিউট। এও আধিপত্যবাদীতা। বেশী বোঝে, বেশী জানে, বেশী পড়েছে। অনেক বেশী। আরো একটি কারণ রয়েছে, নারী। নারী তো বেশী বুঝতে, বেশী জানতে, বেশী পড়তে পারে না পুরুষের চেয়ে। কোন কারণেই না। হ্যাঁ, নারী-ই আমি তার কাছে। সে কী জানে না, নারীই তো তাকে এনেছে পৃথিবীতে। দায়িত্বটি নারীর একার নয়। চাপিয়ে দেয়া হয়েছে তাদের ওপর। সন্তানকে গড়ে তোলার। যতœ করার। মেনে নিয়েছে নারী, যথেষ্ট কঠিন এই কাজটি। সেই মানুষদের আন্ডারষ্টেটিমেইট করবে কেনো? করছে, সচেতন ভাবে নয়। স্বভাবের অভ্যস্ততায়। বুঝতে পারছি।
চ্যাট করতে থাকি তবুও, প্রায় প্রতিদিন। অস্থিরতা তৈরী হচ্ছে অনুভ‚তিতে আমার। নতুন ধরণের অস্থিরতা। অন্যরকম অস্থিরতা। বাড়ছে এটা। বেড়েই যাচ্ছে প্রতি মিনিটে। প্রতি ঘন্টায়। প্রতিদিন। এসব মানায় না আমার স্বভাবের সাথে। নিজের পছন্দে গড়ে তোলা জীবন আমার। চলা? তাও নিজের মতো করেই। কে কী বললো, কে কী ভাবলো, কেয়ার করিনি কখনোই। অন্য অথবা অন্যদের ই”ছার জীবন, কেনো যাপন করবো আমি? জীবনটা যদি হয়ে থাকে আমার, কীভাবে তা যাপন করবো, সে সিন্ধান্তও আমার। জানি এটা। মানিও এটাই।
কী হলো আমার? নেশা হচ্ছে। চ্যাট করার নেশা। কাজের ফাঁকে। বিশ্রামের মাঝে। দিনে রাতে। যখন তখন। কাজের ক্ষতি হচ্ছে খুব। সময় হারাচ্ছি অনেক। ঘুমোচ্ছি কম। কী খাচ্ছি তাও ভাবছি না। তবুও। তবুও। নিজের ক্ষতি, ধারাবাহিক ক্ষতি করে কোন মানুষ? করছি আমি। কিনতু আমি-ই তো বলতাম, নেশা সে-ই করে, নিয়ন্ত্রণহীন যে। নিয়ন্ত্রণহীনতা মানে ব্যাক্তিত্ব হীনতা। নেশা, তা যে কোন কিছুরই। ব্যাক্তিত্বহীনতা, সেই নির্দিষ্ট নেশার যায়গায়। নেশা? হ্যাঁ, নেশা-ই তো। চ্যাট করার নেশা। নিয়ন্ত্রণ করছি না নিজেকে। করছি না কেনো?
---------- (চলবে)