ছবি সংগৃহীত
মতামত

নারীর প্রতি সহিংসতা-অন্ধকারের দিকে যাত্রা

রায়হানা রহমান

সম্প্রতি পর্যটন নগরী কক্সবাজারে কয়েকজন সন্ত্রাসীর হাতে এক নারী ধর্ষিত হন। স্বামী-সন্তানকে জিম্মি করে তাকে ধর্ষণ করা হয়। তার অপরাধ ছিল সেই সন্ত্রাসীদের দাবিকৃত চাঁদার টাকা না দেওয়া। আইনজীবী স্বামীর হাতে আইনের শিক্ষার্থী স্ত্রী খুন। যৌতুক না পেয়েই স্ত্রীকে হত্যা করে আইনজীবী স্বামী। কিছুদিন আগেরই আরেক খবর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃত্যকলা বিভাগের শিক্ষার্থী এলমা চৌধুরী মেঘলা হত্যাকাণ্ডের শিকার হন।

কিংবা যাত্রীহীন বাসে গৃহবধূকে ধর্ষণ। আজকাল পত্রিকা খুললেই বা টিভি খুললেই সদ্যপ্রাপ্ত এসব খবর যেন রোজনামচার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভাবি ডিজিটালে আর অর্থনৈতিকভাবে আলোর রেখা ধরে এগিয়ে যাওয়া দেশ কী তবে মানবিকতা আর নির্মমতায় ক্রমেই অন্ধকারে এগিয়ে চলেছে।

প্রতিনিয়ত নারী নির্যাতন যেন সমাজের এক ক্যান্সারে পরিণত হয়েছে। নারীর প্রতি সহিংসতা নারীকে প্রতি পদে পদে শারীরিক ও মানসিকভাবে পিছিয়ে দিচ্ছে। নারীরা এখন আর সেই আগের মতো করে গৃহকোণে বন্দি নেই। তারা এগিয়ে যাচ্ছে শিক্ষায়, কর্মক্ষেত্রে। এই এগিয়ে যাওয়ার অনেক ক্ষেত্রেই বহু নারীকে প্রচুর মাশুল দিতে হয়।

কক্সবাজারে ঘটে যাওয়া ঘটনায় বা প্রায়শই গণপরিবহনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো প্রমাণ করে নারীর প্রতি সহিংসতা কোনোভাবেই কমছে না, বরং বেড়েই চলছে এক সংক্রামক ব্যাধির মতো। এলমা চৌধুরীর সঙ্গে ঘটে যাওয়া নির্মমতা সেই প্রতিহিংসা ও সহিংসতাকেই সামনে এনে দাঁড় করায়। প্রাচ্যের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে নাট্যকলার মতো বিষয়ে অধ্যয়নরত একজন শিক্ষার্থী ভালোবেসে বিশ্বাস করে বিয়ে করেছিল। কিন্তু তার সেই সামাজিক মূল্যায়ন স্বামীর কাছে মূল্যায়িত না হয়ে হলো সন্দেহে পরিণত। ফলস্বরূপ নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার এলমা। অন্যদিকে বিচার চাইতেও ভয় পায় পরিবার। কারণ হত্যাকারীর পরিবার ক্ষমতাবান। ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিচারের রায় অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিতেই পারে। এদেশে সেটা সম্ভব, তা স্পষ্টতই দৃশ্যমান অতীতের বহু ঘটনায়।

এরকম বহু নারী আমাদের সমাজে প্রতিনিয়ত নির্যাতন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। কয়জন নারী তার বিচার পায়? বরং অনেক পরিবারই লোকলজ্জা বা সামাজিকতার ভয়ে সব কিছু চেপে যায়। বিবাহিত নির্যাতিত নারীকে তার পরিবার থেকেই বলা হয় সব কিছু মেনে নেওয়ার জন্য। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেই নারীটি সব মেনে নেয় সামাজিকতার ভয়ে বা ডিভোর্স হলে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সেই আশঙ্কায়।

বিবাহিত নারীদের মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশ নারী কোনো না কোনো ভাবে নির্যাতনের শিকার হন। বন্ধুর সঙ্গে কথা বলতে না দেওয়া, বাবার বাড়ি যেতে নিষেধাজ্ঞা জারি, সন্দেহ করা, আবেগ, অনুভূতির মূল্যায়ন না করা, বিনা অনুমতিতে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যেতে না দেওয়া, বাইরের মানুষের সামনে হেয় বা অপমান করা, যখন-তখন স্বামীর রেগে যাওয়াসহ স্বামীর নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণ বা মনোভাব ইত্যাদি নানাভাবে নারীরা প্রায়শই নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এক্ষেত্রে আইনি সহায়তা গ্রহণের হারও অনেকাংশে কম। এর একটি বড় কারণ হলো মামলা করার পরিস্থিতি না থাকা বা অভিযোগ করলেও দিনের পর দিন মামলা ঝুলে থাকা।

সেক্ষেত্রে মামলার দীর্ঘসূত্রতায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন অনেকেই। এছাড়া আরেকটি বড় কারণ, মামলায় প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক জোর খাটিয়ে মামলা থেকে নিষ্কৃতি নিয়ে নেয় বা জামিনে বেরিয়ে আবার আগের মতোই আচরণ করতে থাকে।

উল্লেখ্য, নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা সম্পর্কিত মাল্টি সেক্টরাল প্রোগ্রামের তথ্যমতে, ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের মাধ্যমে গত বছরের জুলাই পর্যন্ত নারী নির্যাতনের মামলা করা হয়েছে প্রায় ১১,০০০টি। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত দণ্ডাদেশ হয়েছে মাত্র ১৬০টি মামলার অর্থাৎ বিচারের হার মাত্র ১ শতাংশ। সেক্ষেত্রে বিচারহীনতাও একটি বড় বাধা নারী নির্যাতন প্রতিরোধে।

বাংলাদেশে এখন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা আট কোটিরও বেশি। এর একটি বিরাট অংশই নারী ব্যবহারকারী। অনেক মেয়ে যারা বিভিন্ন কারণে নিজেদের মতামত সামাজিক বা পরিবার কীভাবে হয়তো খোলাখুলি প্রকাশ করতে পারেন না, তাদের অনেকেই মন খুলে লেখেন সামাজিক মাধ্যমে। অনেক নারী এখন সামাজিক মাধ্যমকে মনে করছেন তাদের স্বাধীন বিচরণের একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে। আবার অনলাইনে হয়রানি ও সহিংসতার শিকার ৫৩ শতাংশই নারী। ফেসবুক মেসেঞ্জারে অশ্লীল মেসেজ, ছবি পাঠানোসহ নানাভাবে হয়রানির শিকার হয় নারীরা।

অনেকের ব্যক্তিগত জীবনের একাকিত্ব, একঘেয়েমি কাটাতে ভূমিকা রাখছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। অল্প কিছুদিনের পরিচয়ে অনেক মেয়েই কোনো কিছু ভালোমন্দ চিন্তা না করেই প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলে। সেখান থেকে বিয়ে। এধরনের সম্পর্কে প্রায়ই নারীরা প্রতারিত হচ্ছে।

সম্প্রতি দেশের ১৩টি জাতীয় দৈনিকের তথ্য অনুসারে, এ বছরের প্রথম ১০ মাসে ৩,১২৮ জন নারী ও শিশু ধর্ষণ, হত্যাসহ নানা নির্যাতনে শিকার হয়েছে। এরকম পরিসংখ্যান শুধু দেশেই নয়, বিশ্বের আরও বেশ কয়েকটি দেশেই নারীর প্রতি এ ধরনের সহিংস আচরণ করা হয়। মেক্সিকোতে প্রতিদিন প্রায় ১০ জন নারী হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তথ্য অনুযায়ী, তুরস্কে চলতি বছর এখন পর্যন্ত ৩৪৫ জন নারী হত্যাকাণ্ডের শিকার। জাতিসংঘের আঞ্চলিক কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলে ২০২০ সালে কমপক্ষে ৪ হাজার ৯১ জন নারী জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতার শিকার হয়ে মারা গেছেন। জাতিসংঘের লৈঙ্গিক সমতাবিষয়ক সংস্থা ইউএন উইমেনের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতি তিনজন নারীর মধ্যে একজন শারীরিক কিংবা যৌন সহিংসতার শিকার হন।

নারীর প্রতি নির্যাতন রোধে রাষ্ট্রের কোনো আয়োজনই সহিংসতাকে রোধ করতে পারছে না। এক্ষেত্রে সচেতনতা, আইনের প্রয়োগ এবং প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের ব্যবস্থাই হয়তো কিছুটা কমাতে পারে সহিংসতার মাত্রা। নারীর এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে যতো বাধা আসবে সমাজ ততোই পিছিয়ে পড়বে, এগিয়ে যাবে এক কূপমন্ডুপ অন্ধকারের দিকে।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী।

সাননিউজ/ডেস্ক

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

ব্রাজিলে মাদকচক্রবিরোধী অভিযানে ৪ পুলিশসহ ১১৯ জন নিহত

ব্রাজিলে মাদকচক্রের বিরুদ্ধে এক বড় পুলিশি অভিযানে...

২০৩৪ সালের ট্রিলিয়ন ডলারের লক্ষ্য অর্জনে নারীই চালিকাশক্তি: তারেক রহমান

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, “আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি স...

নির্বাচনের আগে গণভোট অযৌক্তিক ও অপ্রয়োজনীয়

আগামী এয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গণভোট অপ্রয়োজনীয় ও অযৌক্তিক বলে মন্তব্য...

এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের জবাবদিহির আওতায় আনছে সরকার

জবাবদিহির আওতায় আনা হচ্ছে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের, এ কথা জানিয়েছেন শিক্ষা উপদেষ্...

‘হ্যাঁ’ ভোটে বিএনপির জন্ম, ‘না’ ভোটে মৃত্যু

জামায়াত ও বিএনপি কুতর্ক বাদ দিয়ে নির্বাচনী পরিবেশ তৈরিতে এগিয়ে আসার আহ্বান জা...

এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের জবাবদিহির আওতায় আনছে সরকার

জবাবদিহির আওতায় আনা হচ্ছে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের, এ কথা জানিয়েছেন শিক্ষা উপদেষ্...

বোয়ালমারীতে দুর্ধর্ষ ডাকাতি, স্বর্ণালঙ্কারসহ কোটি টাকার মালামাল লুট

ফরিদপুরের বোয়ালমারীতে নারায়ণ চন্দ্র নামে এক ব্যবসায়ীর বাড়িতে দুর্ধর্ষ ডাকাতির...

জনগণের সিদ্ধান্ত নাকি রাজনীতির সাজানো সম্মতি?

গণভোট হলো জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণের একটি পদ্ধতি, যে...

এবার ইসির প্রতীক তালিকায় যুক্ত হলো ‘শাপলা কলি’ 

নির্বাচন বিধিমালা ২০০৮ সংশোধন করে সংরক্ষিত প্রতীকের তালিকায় নির্বাচন কমিশন যু...

সুন্দরবনে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বনদস্যু, তিন শতাধিক জেলে অপহরণ

দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল ও মৎস্যভান্ডার নামে...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা