সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা, প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।
মতামত

আবরার হত্যা ও ছাত্র রাজনীতির দুরবস্থা

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা

বাংলাদেশের মানুষের রাজনৈতিক সচেতনতা বিষয়ে বেশ শক্তপোক্ত আত্মশ্লাঘা আছে। এবং এমন এক অতিরিক্ত রাজনীতিসচেতন বলেই হয়তো আমরা বিরুদ্ধবাদী বা প্রতিপক্ষের ঘরে আগুন দেই, লুটপাট চালাই এবং পিটিয়ে বা ধারালো অস্ত্রাঘাতে তাদের খুন করি। আমরা এও বুঝতে পারি যে, এমন রাজনৈতিক সচেতনতা যত বাড়বে, ততই জ্যামিতিক প্রগতির হারে রাজনৈতিক খুনোখুনি ও সহিংসতার মতো ঘটনা বাড়বে। তাতে লিপ্ত যারা থাকে তাদের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ হলেও হতে পারে, গ্রেফতার হতেও পারে বা নাও হতে পারে এবং বিচারও হতে পারে।

রাজনৈতিক খুনে আমাদের ছাত্ররাজনীতি বরাবরই শীর্ষে অবস্থান করছে। তবে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েটে সচেতন রাজনীতি থাকলেও নৃশংসতা সেভাবে ছিল না। এমন একটি ঘটনা সেখানে ঘটেছিল দুই বছর আগে। ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর বুয়েটের শেরেবাংলা হল থেকে তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবরার ফাহাদকে পৈশাচিক কায়দায় নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। সেই মামলার রায় সম্প্রতি ঘোষিত হয়েছে নিম্ন আদালতে। এ হত্যা মামলায় ২০ জনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। পাঁজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এরা সবাই ছাত্রলীগের বিভিন্ন স্তরের নেতা। শিবির সন্দেহে বুয়েটের শেরেবাংলা হলের একটি কক্ষে তাকে আটকে রেখে জিজ্ঞাসাবাদের নামে দফায় দফায় ক্রিকেট স্টাম্প ও স্কিপিং রোপ দিয়ে আঘাত করে আসামিরা তাকে হত্যা করে।

স্বাধীনতার স্বপ্ন, সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন, কৃষিবিপ্লবের স্বপ্ন, দেশে গণতান্ত্রিক কাঠামো রক্ষার স্বপ্ন তাদের উদ্বুদ্ধ করেছে। আবরার খুনের ঘটনা প্রমাণ করে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কী ঘটছে। আজকের ছাত্র রাজনীতির দুরবস্থার আসল কারণ নিহিত রয়েছে এখানেই। ছাত্রদের সামনে সম্ভাবনাময় নতুন মতাদর্শ বা স্বপ্ন নেই। ক্যাম্পাসে গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যমে সেই স্বপ্নের নতুন নির্মাণের প্রচেষ্টা কেউ কী নিবে?

ফেসবুকে আবরারের পোস্টগুলো দেখে তাকে শিবির বলে সন্দেহ করা শুরু করে ছাত্রলীগের কতিপয় নেতা এবং সেখান থেকেই এই নৃশংসতা। বাকস্বাধীনতার প্রশ্নে বুয়েটের মতো প্রতিষ্ঠানে নৃশংস হত্যার ঘটনায় পুরো জাতি স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। অবাক বিস্ময়ের সাথে জাতি জানতে পারে এমন একটি মেধা বিকাশের প্রতিষ্ঠানে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ রাজনীতির নামে কর্তৃত্ব করে, নিপীড়ন করে এবং তাদের টর্চার সেল আছে। মনুষ্যত্ব ও মানবিকতার লেশমাত্র থাকলে কেউ এভাবে একজন সহপাঠীকে হত্যা করতে পারেন না। অথচ এই ছাত্ররাজনীতি তাদের এমনই নিষ্ঠুর বানিয়েছে।

ধর্মের নামে জঙ্গিগোষ্ঠীর লোকজন একসময় দেশে ভিন্নমত প্রকাশকারীদের একের পর এক হত্যা করা শুরু করেছিল। এই বুয়েটেই আট বছর আগে ধর্মান্ধ জঙ্গিগোষ্ঠী হত্যা করেছিল যন্ত্রকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী আরিফ রায়হান দীপকে। ২০১৩ সালের ৯ এপ্রিল বুয়েটের নজরুল ইসলাম হলে আরিফ রায়হান দীপকে বর্বর ভাবে মাথায় ও পিঠে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর আহত করে ধর্মান্ধ জঙ্গিগোষ্ঠী। পরবর্তীতে ২০১৩ সালের ২ জুলাই চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাসপাতালে তিনি মারা যান। এর আগে ২০০২ সালের ৮ জুন, টেন্ডারবাজিকে কেন্দ্র করে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের দুই গ্রুপের গোলাগুলির মধ্যে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান কেমিকৌশল বিভাগের মেধাবী ছাত্রী সাবেকুন নাহার সনি। তার মৃত্যুতে সেদিন জ্বলে উঠেছিল গোটা দেশ। শোকে, বেদনায় স্তব্ধ হয়ে যায় সবাই। দ্বীপ ও সনি হত্যার বিচার হয়নি আজও।

বাংলাদেশের ক্যাম্পাসগুলোতে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের সহিংস কান্ড ও চাঁদাবাজি টেন্ডারবাজি দেখে আজ ভীত ও সন্ত্রস্ত অভিভাবকরা। ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবি উঠেছে জোরালোভাবে। এখন কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোর ছাত্র রাজনীতি নেই, আছে ক্ষমতাসীন দলের সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগের একচ্ছত্র আধিপত্য। তারা রাজনীতি করেনা, করে ক্ষমতার চর্চা। এবং সে কারণেই ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা সহপাঠীদের খুন করতে পারে যেমন পারে মৌলবাদী জঙ্গি গোষ্ঠী।

দেশের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা অশান্তি এবং হিংসাত্মক ঘটনার সূত্রে একটা তর্ক উঠেছে, ছাত্রদের দলীয় রাজনীতি করার আদৌ কোন দরকার আছে কি না। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন মানেই তাদের রাজনৈতিক কোন কাজ নেই। সংগঠন মানেই পান্ডাদের এবং তাদের পিছনে থাকা নেতাদের রসদ জোগাড় করা। এরা শিক্ষার্থীদের সত্যিকারের কোন উপকারে লাগে না। ছাত্রছাত্রীদের একটা খুব ছোট অংশই এখন ছাত্র রাজনীতি করে। এদের উৎপাতে রাজনীতিকে ঘৃণা করার প্রজন্মটাই বড় হয়ে যাচ্ছে। শিক্ষকরাও এদের সমঝে চলেন। বুয়েটে ঘটেছে তাই। আবরার হত্যার সময় তৎকালীন উপাচার্য সাইফুল ইসলাম এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন ছাত্রলীগকে নিয়ন্ত্রণ তিনি করতে পারেন নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু বকরের মৃত্যুর সময়ও ক্যাম্পাসে শিক্ষক ও প্রশাসকদের অসহায়তার কথা আমরা জেনেছিলাম।

এ দেশে এক সময় ছাত্র আন্দোলন ছিল ছাত্রদেরই আন্দোলন। এখন ছাত্র আন্দোলনে ছাত্রদের ভূমিকা প্রান্তিক। দখলের রাজনীতির দাপটে মূল দলের অনেক নেতার মদদে সেই জায়গা দখল করেছে গুণ্ডা-মস্তানরা। সামগ্রিক ছাত্র আন্দোলনের অবস্থা নিতান্ত করুণ। আগে গুন্ডারা ছাত্রদের সমঝে চলত, এখন ছাত্ররা গুণ্ডাদের সমঝে চলে।

ছাত্রদের রয়েছে তীব্র আবেগ, তীব্র ন্যায়-অন্যায়বোধ এবং আদর্শনিষ্ঠ চারিত্রিক সততা। সেই সততা আর আবেগ এখন নেই শাসক দলের ছাত্রসংগঠনের কর্মকাণ্ডে। দেশের স্বাধীনতার আগে এবং পরে সব গণআন্দোলনে এই অপরিণামদর্শী ছাত্ররা ব্যতিক্রমহীন ভাবে সব সময়ে সংগ্রামের সামনের সারিতে থেকেছে। এখনও অনেক সংগঠন ন্যায্য সংগ্রাম করছে। কিন্তু তারা দুর্বল। দলীয় রাজনীতিকরণে ছাত্ররা দলের ক্রীড়নক হয়ে পড়ছে। ছাত্ররা স্বভাবতই হবে প্রতিষ্ঠান-বিরোধী, কর্তৃত্ব-বিরোধী, স্তাবকতা-বিরোধী। কিন্তু এখন তা চোখে পড়ে না।

এখন আমরা জানতে পাই, ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে গরহাজির থাকা কিংবা বড় ভাইদের সালাম না দেওয়ার মতো কারণেও সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রায় নিয়মিতই নিগ্রহের শিকার হতে হয়। ক্যাম্পাসে সহিংস র্যাগিং ক্রমেই ব্যাপকতা পাচ্ছে। ক্ষমতার আশ্রয় থাকার কারণেই ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা এ রকম ঔদ্ধত্য দেখানোর সাহস পাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় বা হল প্রশাসনের কাছে নালিশ করেও কোনো লাভ হয় না। এমনকি আবরার হত্যার পরও প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রাধ্যক্ষ, উপাচার্য বা অন্য কোনো পদাধিকারী দ্রুত ঘটনাস্থলে আসার প্রয়োজন বোধ করেননি।

আগেকার ছাত্র আন্দোলনের শক্তি ছিল তিনটি: এক - একটা আদর্শ, স্বপ্ন। দুই – অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ ছাত্রশক্তি; তিন – ছিল নাগরিক সমর্থন। নাগরিকরা ছাত্রদের চোখে সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখত। এবং এসবের বড় কারণ ছিল ক্যাম্পাস গণতন্ত্র যা আজ বিরল। মতাদর্শই হল ছাত্র আন্দোলন ও ছাত্র রাজনীতির জিয়নকাঠি। ঘটনা হল, যখনই মতাদর্শ নতুন স্বপ্ন দেখিয়েছে, ছাত্রসমাজ উদ্বেল হয়েছে। স্বাধীনতার স্বপ্ন, সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন, কৃষিবিপ্লবের স্বপ্ন, দেশে গণতান্ত্রিক কাঠামো রক্ষার স্বপ্ন তাদের উদ্বুদ্ধ করেছে। আবরার খুনের ঘটনা প্রমাণ করে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কী ঘটছে। আজকের ছাত্র রাজনীতির দুরবস্থার আসল কারণ নিহিত রয়েছে এখানেই। ছাত্রদের সামনে সম্ভাবনাময় নতুন মতাদর্শ বা স্বপ্ন নেই। ক্যাম্পাসে গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যমে সেই স্বপ্নের নতুন নির্মাণের প্রচেষ্টা কেউ কী নিবে?

লেখক: প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।

সান নিউজ/এফএইচপি

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

কোচিং সেন্টারে মিলল বিপুল অস্ত্র-বিস্ফোরক

রাজশাহী নগরীর কাদিরগঞ্জ এলাকায় একটি বাড়ি থেকে অস্ত্র ও বিস্ফোরক তৈরি সরঞ্জাম...

কোনো চাঁদাবাজকে বাংলাদেশে থাকতে দেওয়া হবে না : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

কোনো চাঁদাবাজকে বাংলাদেশে থাকতে দেওয়া হবে না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র...

আলাস্কায় ট্রাম্প-পুতিন বৈঠক শেষ, যুদ্ধ স্থগিতের ঘোষণা নেই

যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কায় রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট...

‘গোপন রাজনীতি’, ছাত্রশিবির ও ডাকসু নির্বাচন নিয়ে উত্তপ্ত ঢাবি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গেস্টরুম সংস্কৃতি এবং এই কেন্দ্রিক নির্যাতন গত ১৫ বছরে ছি...

রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মালয়েশিয়ার প্রভাব কাজে লাগাতে চায় বাংলাদেশ

দীর্ঘদিনের রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা জোরদার করা...

ফের ৯৮ বাংলাদেশিকে বিমানবন্দর থেকে ফেরত পাঠাল মালয়েশিয়া

ফের কুয়ালালামপুর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আটকে দেওয়া হয়েছে ৯৮ বাংলাদেশিকে। বিম...

‘গোপন রাজনীতি’, ছাত্রশিবির ও ডাকসু নির্বাচন নিয়ে উত্তপ্ত ঢাবি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গেস্টরুম সংস্কৃতি এবং এই কেন্দ্রিক নির্যাতন গত ১৫ বছরে ছি...

রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মালয়েশিয়ার প্রভাব কাজে লাগাতে চায় বাংলাদেশ

দীর্ঘদিনের রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা জোরদার করা...

কোনো চাঁদাবাজকে বাংলাদেশে থাকতে দেওয়া হবে না : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

কোনো চাঁদাবাজকে বাংলাদেশে থাকতে দেওয়া হবে না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র...

আলাস্কায় ট্রাম্প-পুতিন বৈঠক শেষ, যুদ্ধ স্থগিতের ঘোষণা নেই

যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কায় রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা