মতামত

‘রাজনীতির দিন’ হারিয়ে যাওয়া মানে জনগণের দিনও হারিয়ে যাওয়া

রিনভী তুষার : গত ২৮ জুন সংসদে দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, ‘ওয়ারেন্ট অব প্রেসিডেন্স অনুযায়ী সাংসদেরা সচিবদের ওপরে। এটা খেয়াল রাখতে হবে।’ একজন রাজনীতিবিদের মুখে এ মন্তব্য কিছুটা আর্তনাদের মতোই শুনিয়েছে। তিনি আরও বলেছেন, ‘১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হন। তখন মন্ত্রীরা জেলার দায়িত্ব পালন করতেন। সেখানে গেলে কর্মীরা আসত। মন্ত্রীরা গ্রামেগঞ্জে যেতেন। কোথায় যেন সেই দিনগুলো হারিয়ে গেছে।’

এখানে তোফায়েল আহমেদ ঠিক কথাটাই বলেছেন যে ‘দিনগুলো হারিয়ে গেছে।’ তাহলে এখন প্রশ্ন করতে হয়, বাংলাদেশ থেকে কি রাজনীতির দিন হারিয়ে গেছে বা যাচ্ছে? একাডেমিক বিবেচনায় এটা কিছুটা জটিল আলোচনা। তবু এর সহজ একটা উত্তর খোঁজার চেষ্টা করে যেতে পারে। রাজনীতিকীকরণ একটি প্রক্রিয়া। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ করার দায়িত্ব সংসদের। সংসদ গঠিত হয় সংসদ সদস্য দিয়ে। সংসদে আসা সদস্যরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত। এটাই গণতন্ত্রের মূল ব্যাকরণ।

পাঠক হিসেবে এমন অতি সাধারণ জ্ঞানে আপনার বিরক্ত হওয়ারই কথা। বিরক্তি নিয়ে চেষ্টা করেও কি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গে আপনি গণতন্ত্রের ব্যাকরণের কোনো মিল খুঁজে বের করতে পারেন? উত্তর মনে মনে গোপন রাখাই আপাতত নিরাপদ। লেখক হিসেবে কিছুটা ঝুঁকি আমার প্রাপ্য। তাই শিরোনামে করা প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমাকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ব্যাকরণের ব্যবচ্ছেদ করতেই হচ্ছে।

ফরাসি দার্শনিক জাঁক রেনসিয়ের তাঁর ‘অন দ্য শোর অব পলিটিকস’ বইয়ে বলেছেন, ‘রাজনীতির প্রাচীনতম অংশ হচ্ছে বিরাজনৈতিকীকরণ।’ ২০০০ সালে প্রকাশিত এক রিপোর্টে বিশ্বব্যাংক ‘ডিপলিটিসাইজেশন বা বিরাজনৈতিকীকরণ’কে রাষ্ট্রের সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং বাজারব্যবস্থার আস্থা অর্জনের অন্যতম মূল উপায় হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এমনকি ২০০৩ সালে জাতিসংঘ তো ‘ডিপলিটিসাইজিং সিভিল সার্ভিস’ নামে সেমিনার ও কনফারেন্সের আয়োজনও করেছিল।

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ করার দায়িত্ব সংসদের। সংসদ গঠিত হয় সংসদ সদস্য দিয়ে। সংসদে আসা সদস্যরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত। এটাই গণতন্ত্রের মূল ব্যাকরণ। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গে আপনি গণতন্ত্রের ব্যাকরণের কোনো মিল খুঁজে বের করতে পারেন?

বিরাজনৈতিকীকরণের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে পিটার বার্নহ্যাম বলেছেন ‘সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া থেকে রাজনৈতিক চরিত্রের অপসারণ’-এর কথা। তার মানে হলো এ প্রক্রিয়ায় রাজনীতিবিদেরা ‘ইনডাইরেক্ট গভর্নিং’ বা পরোক্ষ শাসনব্যবস্থার পেছনে নিজেদের আড়াল করেন। সুতরাং কোনো সিদ্ধান্ত বা নীতিনির্ধারণী বিষয়ে তাঁদের সরাসরি কোনো দায় থাকে না। রূঢ় বাস্তবতা হলো রাজনীতিবিদেরাই সিদ্ধান্ত নেন কোন কোন বিষয়ের রাজনৈতিকীকরণ করা হবে।

যেকোনো রাষ্ট্রীয় ইস্যুর বিরাজনৈতিকীকরণ রাজনীতিবিদদের সাধারণত একটা ‘বাফার জোন’ তৈরি করার সুযোগ দেয়। ক্রিস্টোফার হুড তাঁর ‘দ্য রিস্ক গেম অ্যান্ড দ্য ব্লেইম গেম’-এ বিরাজনৈতিকীকরণকে ‘ডিফেন্সেভি রিস্ক ম্যানেজমেন্ট টেকনিক’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তবে ক্ষমতার ভারসাম্যের পরিবর্তনের কথা বললে বিরাজনৈতিকীকরণ প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন বড়জোর গুহা থেকে পর্বতের চূড়ায় স্থানান্তর পর্যন্ত; সমতল থেকে পর্বতের চূড়া অবধি নয়।

এবার আলোচনা করব রকমফের নিয়ে। প্রাতিষ্ঠানিক, নিয়মনির্ভর এবং প্রেফারেন্স শেইপিং বা অগ্রাধিকার নিরূপণ—এ তিন ভাগে বিরাজনৈতিকীকরণকে ভাগ বা ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।

প্রাতিষ্ঠানিক বিরাজনৈতিকীকরণ খুবই জনপ্রিয় এবং বহুল ব্যবহৃত ট্যাকটিস। এ প্রক্রিয়ায় স্বল্পমেয়াদে যেকোনো ‘গণমনে’ চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী ইস্যুতে ক্ষমতাবানেরা সরাসরি নিজের দলের কর্মী নন, কিন্তু দলের সমর্থক, এমন কাউকে দিয়ে কোনো কমিশন গঠন করেন অথবা কোনো প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব প্রদান করেন। এসব করা হয় মূলত ভোট বাড়াতে কিংবা জনগণের চাপ প্রশমিত করতে। যেমন পুলিশ বা র‍্যাবের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পাবলিক কমিশন গঠন কিংবা মানবাধিকার কমিশনের কাছে অভিযোগ পাঠানো। অথবা দুর্নীতি দমন কমিশনকে অন্তর্ভুক্ত করা।

রুল বেইজড বা নিয়মনির্ভর প্রক্রিয়ায় আইনের প্রাধান্য কিংবা আইন, নিয়মনীতিকেই মুখ্য হিসেবে জনগণের সামনে রাজনৈতিকভাবে তুলে ধরা হয়। যেমন: বৈদেশিক বিনিয়োগ, জ্বালানি নীতি। বাংলাদেশে এসব বিষয়-আশয় দেখভাল করা হয় প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাদের নেতৃত্বে।

‘প্রেফারেন্স শেইপিং বা অগ্রাধিকার নিরূপণ’ বিরাজনৈতিকীকরণের এ ধরনকে মেরি ডগলাস ব্যাখ্যা করেছেন খুবই চমকপ্রদ এক প্রক্রিয়া হিসেবে। এ প্রক্রিয়ায় একটি ‘কর্তৃত্ববাদী যুক্তি’ বা ‘ডমিনেন্ট র‌্যাশেনালিটি’র দ্বারা সাধারণ মানুষের চিন্তা, বিচার বা মতামত খুব গোপনে হাওয়া হয়ে যায়। যেমন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ মুদ্রানীতি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিছুদিন আগে ঘোষণা দিল তারা বাজার থেকে টাকা তুলে নেবে। এ রকম সিদ্ধান্তের ভালো-মন্দ নিয়ে সাধারণত কোনো পাবলিক ডিসকোর্স তৈরি হয় না। মার্টিন মারকুসেন তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, সাধারণ জনগণ তো দূরে থাক, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন করার অধিকার রাজনীতিবিদেরাও রাখেন না। কারণ, ‘কর্তৃত্ববাদী যুক্তি’ বা ‘ডমিনেন্ট র‌্যাশেনালিটি’। এর কাছে সবকিছুই অযৌক্তিক।

সুবিধার কথা বললে বিরাজনৈতিকীকরণ প্রক্রিয়ার প্রধান তিন সুবিধার কথা বলা যায়। এক, জননীতির ওপর থেকে রাজনীতিবিদদের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ কমে আসে। দুই, পরোক্ষ শাসন সম্পর্ক প্রশাসনের ওপর থেকে রাজনৈতিক ভার কমায়। তিন, কোনো পলিসি বা নীতি কাজ না করলে তার রাজনৈতিক দায়ভার থেকে রাজনীতিবিদেরা এ প্রক্রিয়ায় মুক্তি পেতে পারেন।

তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিরাজনৈতিকীকরণ প্রক্রিয়ার চেহারা খুবই স্থূল। বর্তমান সরকারব্যবস্থায় এ পরিবর্তন সাগর থেকে পর্বতগামী। উপাদানের কথা চিন্তা করলে বাংলাদেশের গণতন্ত্রে সুরম্য সংসদ ভবন আছে। সংসদ সদস্য আছে। বিরোধী দল আছে। সরকারি দল আছে। কিন্তু এসবের ভেতরে মূল যে উপাদান, মানে যা না থাকলে গণতন্ত্রই থাকে না বা থাকতে পারে না, সেই ‘গণ’রাই নেই। আসলে রাষ্ট্রের বর্তমান ক্ষমতাকাঠামোয় জনগণের ভূমিকা খুব একটা নেই। মানে বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রমাণ করেছে, ক্ষমতায় থাকতে হলে জনগণকে তাদের খুব একটা দরকার নেই।

রাজনৈতিক দল ও জনগণের মধ্যে সেতু গড়ার কাজটুকু করেন রাজনৈতিক কর্মীরা। যেহেতু ক্ষমতায় থাকতে জনগণের কাছে যেতে হচ্ছে না, তাই রাজনৈতিক কর্মীদের প্রয়োজনও সামান্য। তার ওপর আবার রাজনৈতিক কর্মীদের নিয়ন্ত্রণ করা খুবই কঠিন। এর চেয়ে বরং কর্মী ও জনগণকে একই কাতারে নামিয়ে আনা গেলে নিয়ন্ত্র্রণের কাজটি সহজ হয়। তাই ‘রাজনীতির দিন’ হারিয়ে যাওয়াটা জনগণের হারিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়ারই অংশ। এই হারিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া পুরোপুরি জোর করেও নয়। গোটা প্রক্রিয়ায় ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক কর্মীরা ধীরে ধীরে ‘তিমির পা’-এর পরিণতি বরণ করতে বাধ্য হবেন। ডারউইন যাকে বলেছেন ‘ভেসটিজিয়াল লিম্ব’। মানে ব্যবহার না করতে করতে অকার্যকর হয়ে যাওয়া অঙ্গ।

বাংলাদেশের গণতন্ত্রে সুরম্য সংসদ ভবন আছে। সংসদ সদস্য আছে। বিরোধী দল আছে। সরকারি দল আছে। কিন্তু যা না থাকলে গণতন্ত্রই থাকে না বা থাকতে পারে না, সেই ‘গণ’রাই নেই। আসলে রাষ্ট্রের বর্তমান ক্ষমতাকাঠামোয় জনগণের ভূমিকা খুব একটা নেই। মানে বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রমাণ করেছে, ক্ষমতায় থাকতে হলে জনগণকে তাদের খুব একটা দরকার নেই।

আস্থার কিছু ধাপ থাকে। জনগণের ওপর রাজনীতিবিদদের আস্থা আর নেই। কারণ, তাঁরা জনগণের মতামতকে ভয় করেন। ভাবেন যে জনগণ চাইলেই তাঁদের আসন উল্টে দেবেন। এই ভয় থেকেই বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও অবাধ কোনো নির্বাচন আমরা দেখছি না। আস্থাহীনতার অবস্থা এমন যে জনগণ পারস্পরিক আস্থাহীনতায় ভুগছে। নজরদারির আতঙ্ক ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। জনগণ ভাবছে তাকে নজরে রাখা হচ্ছে। মিশেল ফুকো এ অবস্থাকে বলেছেন ‘দ্য আই অব পাওয়ার’ বা ক্ষমতার চোখ।

আমরা কমবেশি সবাই প্রশাসনের ক্ষমতার ব্যবহার এবং অপব্যবহারের সঙ্গে পরিচিত। যদি খেয়াল করি, তবে দেখব, এখানে দায়িত্ব শব্দটি সেভাবে ব্যবহৃত হয় না। তবে কি রাষ্ট্রের প্রতিনিধি কেউ রাষ্ট্রের দায়িত্বে থাকেন না? রাষ্ট্র শুধু তাদের ক্ষমতাই প্রদান করে? রাজনৈতিক দায়িত্ব এড়াতে প্রশাসনের ওপর এই রাজনৈতিক নির্ভরতা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীকেও রাজনৈতিক ক্ষমতার স্বাদ দেয়, যা প্রশাসনিক ক্ষমতার চেয়ে বেশি কিছু। সেই ক্ষমতায় অন্ধ কৃপাণ যখন চলে, তখন দড়ি হাতে মানুষ আর দড়ির আরেক প্রান্তে বাঁধা চতুষ্পদীর মধ্যে তারা ফারাক করতে পারে না।

আদতে রাজনৈতিক কর্মীদের শূন্যস্থান পূরণ করা হচ্ছে প্রশাসনিক উপায়ে। অনেকটা র‍্যাপিড এবং ম্যাস ডিপলিটিসাইজেশন। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা প্রশাসনিকভাবেই একটা বিশেষ ‘পলিটিক্যাল ডকট্রিন’-এর চর্চা করছেন। কাজ করে যাচ্ছেন রাজনৈতিক ক্ষমতার চোখ হিসেবে। প্রশাসনিক কাজকর্মে রাজনৈতিক ভাষা এবং অভিধা ব্যবহার করছেন। তাঁরা নিজেদের প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে আর ভাবতে পারছেন না।

লেখক : রিনভী তুষার, রাজনীতি গবেষক এবং যুক্তরাজ্যে কর্মরত অভিবাসন উন্নয়নকর্মী। [email protected]

সান নিউজ/এনএম

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী পান্নার গণসংযোগ

রাজীব চৌধুরী, কেশবপুর : আসন্ন কেশবপুর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে...

বোয়ালমারীতে স্বর্ণের কারিগরকে কুপিয়ে জখম

কামরুল সিকদার, বোয়ালমারী (ফরিদপুর) : ফরিদপুরের বোয়ালমারীতে...

বজ্রপাতের সময় করণীয়

লাইফস্টাইল ডেস্ক: চলমান তাপপ্রবাহ...

নিজ্জর হত্যায় সন্দেহভাজন ৩ জন গ্রেফতার 

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: কানাডায় বসবাসর...

ভালুকায় পানি ও স্যালাইন বিতরণ

ভালুকা (ময়মনসিংহ) প্রতিনিধি : ময়মনসিংহের ভালুকায় প্রচন্ড...

কেমব্রিজ পরীক্ষায় ডিপিএস শিক্ষার্থীদের সাফল্য

নিজস্ব প্রতিবেদক: সম্প্রতি প্রকাশ...

ফরিদপুরে স্টপেজের দাবিতে মানববন্ধন 

বিভাষ দত্ত, ফরিদপুর: ফরিদপুরে রেল...

পাবনায় আন্তর্জাতিক মিডওয়াইফ দিবস পালিত

পাবনা প্রতিনিধি: ‘জলবায়ু স...

অস্ট্রেলিয়া গেলেন বিমানবাহিনী প্রধান

নিজস্ব প্রতিবেদক: সরকারি সফরে অস্...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা