ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ
করোনার প্রকোপ ও প্রভাব এতদিন শহর, নগর ও বন্দরে সীমিত থাকায় এবং সেখানে উচ্চ বাজেটের লোকদের ভয়ের কারণ ছিল বলে প্রতিরোধ ও প্রতিষেধকে ছোট ও মাঝারি পর্যায়ের অপারগতা সত্ত্বেও মাথা ঘামানোর ঘটনা ঘটেনি।
এতদিন পুরো পল্লী অঞ্চল করোনামুক্ত থাকায় তাদের জীবন ও জীবিকা নিয়েও স্বস্তিবোধ বিদ্যমান ছিল। শহর, নগর ও বন্দরে ছোট বাজেটের লোকরা এতদিন আক্রান্ত না হওয়ায় তাদের মধ্যে নতুন দরিদ্র বা জীবন-জীবিকার প্রশ্নটি নীতিনির্ধারকদের ‘বোধগম্যতার’ পর্যায়ে পৌঁছায়নি বা ‘দৃশ্যগোচর’ হওয়ার মতো মনে হয়নি। কিন্তু পল্লী অঞ্চলের পরিসংখ্যান এখন যেভাবে ভয়াবহ রূপ পরিগ্রহ করছে তাতে এই ‘নব্য’ ধাক্কা কি শিক্ষা নিয়ে আসবে তা বলা মুশকিল।
এই প্রেক্ষাপটেই বলা যায়, এবারের বাজেটটি অন্যবারের তুলনায় ভিন্ন হওয়ার যৌক্তিকতার দিকেই যাচ্ছে। একই নিরীখে বলা চলে, প্রস্তাবিত বাজেটটি যতটা ভিন্ন, যতটা তাৎক্ষণিক, যতটা প্রয়োজন, যতটা জীবন-জীবিকার ততটা হয়নি।
তবে চটজলদি এটা করাও সম্ভব নয়। কিছু দূর এগোনো, কিছু দূর পেছানো এই অবস্থায় আছে। সুতরাং আমি বলতে পারি করোনাকালের যে বাজেট হয়েছে সেটা যা তাই। এটাকে আকিকায় আর নতুন করে নামকরণের বা শ্রেণিকরণের অবকাশ নেই। কেননা বাজেট যেভাবে পেশ হয়েছে সেটাই ‘হ্যাঁ জয়যুক্ত’ হয়ে যাবে।
আসল কথা হলো, স্বাস্থ্য খাতে আগেও, গত বছরেও যে বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল তার আগের বছরের চেয়ে নিশ্চয়ই বেশি ছিল। কিন্তু বছরের শেষে এই স্বাস্থ্য খাতের ব্যয়-বরাদ্দ নিয়ে নানা প্রশ্ন-সংশয় দেখা গেছে। অর্থাৎ যত টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল ততটা যথাযথভাবে মনে হয় ব্যয় হয়নি। মনে হয় তারা সেটা করতে পারেনি।
এবার অবশ্যই এ খাতে প্রয়োজন বেশি ছিল বা প্রয়োজন এখনো বেশি আছে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে অবকাঠামো নির্মাণ এবং টু দ্য পয়েন্টে টাকা খরচ করার মতো সক্ষমতা ও দায়িত্বশীলতা যদি না থাকে তাহলে তো হবে না। পত্রপত্রিকায় দেখেছি, ২৫ টাকার সুঁই ২ হাজার ৫০০ টাকায় কেনা হয়েছে। অর্থাৎ একশ গুণ দাম দেখানো হয়েছে। এই কথাগুলো যদি শোনা কথা হয় তাহলে ঠিক আছে কিন্তু এটা যদি সত্যি হয় তাহলে তো বাজেট কম দেয়া হলো না বেশি দেয়া হলো, সে প্রশ্ন খুব বেশি আসছে না।
অনেকে মনে করেন থাকেন সুশাসনের কথা সমালোচনাকারীরা কর্তৃপক্ষের প্রতিপক্ষ হিসেবেই শুধু বলেন। বা কাউকে সুশাসনের কথা বললে তারা মনে করেন এই বলাটা বোধহয় তাদের বিরুদ্ধে যাচ্ছে, আসলে কিন্তু তা না। সুশাসনটা প্রত্যেকের নিজের জন্য ভালো। সুশাসন না হলে যতই ভালো কাজ করা হোক, যত কিছু করা হোক সেটা নিয়ে আপনি আটকা পড়বেন বা সমস্যায় পড়বেন। সমালোচনায় পড়বেন। সুতরাং সমালোচনা থেকে বাঁচানোর জন্য বা উন্নয়নের যথার্থতা ফিরে পাওয়ার জন্য, আস্থা সৃষ্টির জন্য, নাগরিক সেবাকে অর্থবহ ও প্রতিষ্ঠিত বা টেকসই করার জন্য সুশাসন দরকার। এটা কোনো অবস্থাতেই সুশাসন অন্যের জন্য নয় নিজের জন্য।
কেননা আমরা উন্নয়নের পথে আছি, আমাদের অপার সম্ভাবনা আছে, ইতোমধ্যে অর্থনীতির ক্ষেত্রে আমাদের অনেক সাফল্য আছে। সেগুলোকে যদি টেকসই করতে হয়, স্থিতিশীল করতে হয়, যে অর্জন আমরা করেছি সেটাকে স্থিতিশীল করতে হয় তাহলে অবশ্যই যে মুহূর্ত থেকে কথা বলছি সেই মুহূর্ত থেকে সুশাসনের দিকে নজর দিতে হবে। কারণ সুশাসনে নজর না দিলে উন্নয়ন, সম্ভাবনা কোনোটাই অর্থবহ হবে না এবং পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগ, আস্থাহীনতা, সন্দেহ-সংশয়, সংকটের ভেতরে এটা হারিয়ে যাবে।
রাজস্ব আহরণ উচ্চাভিলাষী হওয়ার বিষয় নয়। এটা সাধারণ অঙ্কের হিসাব। গত বেশ কয়েক বছর আগে এ রকম কখনো হয়নি। এর আগে এনবিআরকে যে লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হতো তারা তার কাছাকাছি যেত। ২০০৭ সালে তারা মূল লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে ১০ হাজার কোটি টাকা বেশি আদায় করেছিল।
সেটা অবশ্য একটা ভিন্ন পরিস্থিতি ছিল। তারপরও পরবর্তী বছরগুলোতেও মোটামুটি যে লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হতো তার কাছাকাছি যাওয়া যেত। কিন্তু ২০১৪-১৫ সালের পর থেকে দেখা যাচ্ছে যে টার্গেটের থেকে এনবিআর পিছিয়ে অনেক দূরে থেকে যাচ্ছে। কারণটা হচ্ছে যেহেতু ব্যয়ের বাজেটে খুব উল্লম্ফন হয়েছে। ২০১৫-১৬ সালের পর থেকে বাজেটে ব্যয় বৃদ্ধির ফিগারগুলো যদি আমার দেখি, ২ লাখ থেকে আড়াই লাখ তারপর তিন, সাড়ে চার, পাঁচ। এবার তো ৬ লাখ।
এই যে ব্যয়ের বাজেটটা যে হারে বেড়েছে কিন্তু তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে অর্থনীতি থেকে রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি পায়নি। পাওয়া সম্ভবও না। অর্থনীতি তো একটা সীমিত অগ্রসরের মধ্যে থাকে। করের নেট বাড়ে না। বেশি বেশি পরিমাণে ছাড় ও রেয়াত দেয়াসহ এ খাতে নানা ধরনের সমস্যা তো আছেই। সে কারণেই ব্যয় বৃদ্ধির প্রবৃদ্ধির হার তার সঙ্গে রাজস্বের প্রবৃদ্ধির হার এক করে দেখা ঠিক হবে না। বৈষম্য বৃদ্ধির পরিবেশে কর রাজস্ব আয়ের প্রবৃদ্ধি তো ব্যয়ের প্রবৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারবে না। সেই কারণে গত কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে ব্যয়ের বাজেট বড় হচ্ছে সেই সঙ্গে ঘাটতি যোগ-বিয়োগ করে বড় টার্গেটের বাজেট এনবিআরের হাতে ধরিয়ে দেয়া হচ্ছে। বাস্তবতা হচ্ছে, এনবিআরের প্রবৃদ্ধির যে সক্ষমতা তার সঙ্গে খাপ খাচ্ছে না। এ বছর অবশ্য প্রথম ব্যয়ের বাজেট যেভাবে বেড়েছে আয়ের বাজেট প্রাথমিকভাবে সেভাবে বাড়ানো হয়নি।
যার জন্য গত বছর ছিল ৩ লাখ ৩০ হাজার, এবারো ৩ লাখ ৩০ হাজার রাখা হয়েছে। এই প্রথম এটা নতুন। কিন্তু তারপরও কথা থাকছে। যদি স্বাভাবিক অবস্থাও থাকত তাহলে এই ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকাও অর্জন করা সম্ভব হতো না। গত বছরের ৯ মাস ভালো সময় ছিল; তিন মাস খারাপ সময় ছিল। তাতেও দেখা যাচ্ছে চলতি অর্থবছরে সর্বোচ্চ ২ লাখ ৩০-৪০ বা ৫০ হাজার কোটি টাকা হতে পারে। এর বিপরীতে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা তো অনেক বেশি। এনবিআরের যে সাফল্য তাতে কর রাজস্ব আয় সর্বোচ্চ ২০ থেকে ২১ শতাংশের বেশি হয় না। আর যেটা বাড়ানো হয়েছে সেটা তো ৩০-৪০ শতাংশ। সে জন্য এবারো যেহেতু করোনা যায়নি, করোনা চলে গেলে এটা রিবাউন্ড হওয়া সুযোগ ছিল বা আছে। যদি করোনা যায় তাহলে হয়তো কিছুটা উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তা না হলে আয় আরো কমে যাবে। আগের বছর তো তবুও ৯ মাস ভালো ছিল। তিন মাস করোনা ছিল। এবার তো পুরো বছরই করোনা ছিল। আগের বছর আয় কমবে।
করোনকালীন সময়ে সরকারের কাছে প্রত্যাশা হচ্ছে জীবন ও জীবিকা। প্রথম হচ্ছে জীবন বাঁচাবেন। আবার জীবিকা দিলেই জীবন বাঁচবে। এ দুটি বিষয় খেয়াল রেখে বেঁচে থাকার ব্যবস্থা করা। করোনা প্রতিরোধ করা। টিকার ব্যবস্থা করা। তারপর আস্থা ফিরিয়ে আনা। বিভিন্ন মানুষ বেকার হয়ে গেছে। যেমন কিছু মানুষ বিদেশ থেকে ফিরে এসেছে। এদের জন্য যদি সম্ভব হয় সারাদেশে অস্থায়ী ট্রেনিং সেন্টার খোলা। প্রত্যেককে একটা ভাতা দিয়ে ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা। তাহলে সে একটা কাজ পেল। একই সঙ্গে তারা দক্ষ হয়ে উঠল। করোনার পরে তারা বিদেশ থেকে আরো বেশি আয় পাঠাতে পারবে। বিনিয়োগটা এখানে করতে হবে।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় কিন্তু প্রবাসীদের কাছ থেকে একটা টাকা নেয় ওয়েলফেয়ার ফান্ডে। প্রচুর ফান্ড জমা আছে। এ ফান্ড থেকে টাকা খরচ করার এখনই তো উপযুক্ত সময়। এই বিষয়গুলো কিন্তু বাজেটে আসেনি। শ্রমিকদের দক্ষ করতে সৃজনশীল পদক্ষেপ নিতে হবে। দুস্থ বা বয়স্কদের মাঝে আড়াই হাজার, তিন হাজার টাকার নগদ টাকা বা খাদ্য পৌঁছিয়ে বেকার বা চাকরিহারাদের জন্য তেমন কোনো সুফল পাওয়া যাবে না। যে কর্মক্ষম অথচ বসে আছে কাজ নেই তাকে কাজ দেয়ার জন্য পথ বের করতে হবে। ন্যায্যমূল্যে খাদ্যশস্য পৌঁছানোর জন্য পুরো দেশকে রেশনিংয়ের আওতায় আনা যেতে পারে। সেটা শ্রেণি ভাগ করে দিতে হবে। রেশনিংয়ে শ্রেণি অনুযায়ী পণ্যের দাম নির্ধারণ করতে হবে। এখন তো ডিজিটালের যুগ। সব ডাটাবেজ আছে। সবার আইডি কার্ড আছে। সেখান থেকে শ্রেণি বিভাগ করতে হবে।
যারা বড়লোক তাদের রেশনের দরকার নেই, বিনামূূল্যে বই দেয়ার যৌক্তিকতা নেই। প্রয়োজন মধ্যবিত্তের, নিম্নবিত্তের। এভাবে কর্মসৃজনমূলক কর্মসূচি আনতে হবে। জীবন ও জীবিকা বাঁচানোর। জীবন-জীবিকা বাঁচালেই অর্থনীতি সচল হবে। রাষ্ট্রীয় কাজ হলো অর্থনীতিকে সচল করা। এটা সচল করতে ব্যবসায়ীদের সুবিধা প্রণোদনা যেমন দিতে তেমনি ক্রেতা তথা আমজনতার ক্রয়ক্ষমতাও বাড়াতে হবে। ব্যবসায়ীদের কিছু সুবিধা দেয়া হয়েছে। সেগুলোর বাস্তবায়ন শর্ত ও সময়সাপেক্ষ। কর অবকাশ সুবিধা দিয়ে অনেক বড় কিছু করার প্রতিশ্রুতি দেয়া হলো কিন্তু ১০ বছর পর কিন্তু সেটা জীবন-জীবিকার কাজে আসবে না। এই মুহূর্তে প্রয়োজন এখনই ব্যবস্থা নিয়ে জীবন ও জীবিকা রক্ষা করতে হবে।
ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ : কলাম লেখক, সাবেক সচিব ও সাবেক চেয়ারম্যান- এনবিআর।