স্বামীর ছবি বুকে চেপে অঝোরে কাঁদছেন সুমা বেগম। কখনও স্বামীর কবরের পাশে বসে, কখনও ঘরের অন্ধকার কোনায়। চোখের পানি মুছতে মুছতে বলেন—চারটা বাচ্চা নিয়ে আমি এখন কীভাবে বাঁচবো?” স্বামী হারিয়ে যেন পৃথিবীর আলো-হাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে তার জন্য। তবে শুধু শোক নয়, তার অন্তরে জমে আছে আতঙ্কও—কারণ, স্বামীকে হত্যার পর হত্যাকারীরা বাড়িতে চিরকুট পাঠিয়ে জানিয়ে দিয়েছে, এবার টার্গেট সুমা বেগমের ছেলে ও পরিবারের অন্য সদস্যরা।
শনিবার(০৯ আগষ্ট) সকালে ভোলার তজুমদ্দিন উপজেলার সম্ভূপুর ইউনিয়নের লামছি গ্রামের বাংলা বাজার এলাকায় দিনমজুর বাক প্রতিবন্ধী কবির হোসেন এর স্ত্রী সুমা বেগমের এমন বিলাপ দেখা যায়।
পরিবার ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ভোলার তজুমদ্দিন উপজেলার সম্ভূপুর ইউনিয়নের লামছি গ্রামের বাক প্রতিবন্ধী কবির হোসেন (৩৫) ছিলেন শান্ত-শিষ্ট স্বভাবের মানুষ। জমির মালিকানা নিয়ে তারি চাচা ও চাচাতো ভাইদের সঙ্গে তার দীর্ঘদিনের বিরোধ চলছিল।জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে চাচাতো ভাইরা পরিকল্পিতভাবে তাকে হত্যা করে পুকুরে ফেলে দিয়েছে। তবে মৃত্যুর রহস্য উদঘাটনে পুলিশের গড়িমসি এবং আসামিদের গ্রেপ্তার না হওয়ায় এলাকাজুড়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে।
জানা যায়, গত ২৯ জুলাই বিকেলে বাংলাবাজার এলাকা থেকে তিনি হঠাৎ নিখোঁজ হন। পরিবারের সদস্যরা চারপাশে খোঁজাখুঁজি করেও তার কোনো সন্ধান পাননি। ঘটনার তিন দিন পর, ১ আগস্ট, বাড়ির পাশের পুকুরে ভেসে ওঠা ক্ষতবিক্ষত দেহ দেখে গ্রামজুড়ে নেমে আসে শোকের ছায়া। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, মৃতদেহের শরীরে আঘাতের চিহ্ন ছিল স্পষ্ট।
ঘটনার ১১ দিন পার হলেও রহস্যের জট না খোলায় স্থানীয়দের মধ্যে ক্ষোভ তীব্র আকার ধারণ করেছে। এ ঘটনায় গত ৮ আগস্ট বিকেলে সম্ভূপুর বাংলাবাজার এলাকায় হাজারো মানুষের উপস্থিতিতে গ্রামবাসী বিক্ষোভ ও মানববন্ধনে অংশ নেন।গ্রামবাসীর দাবি, যতই প্রভাবশালী হোক না কেন, অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে হবে।
নিহতের ভাই প্রথমে তজুমদ্দিন থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা দায়ের করেন। তবে পরিবারের দাবি—এটি নিছক দুর্ঘটনা নয়, বরং পরিকল্পিত হত্যা। তাদের অভিযোগ, জমির বিরোধের জেরে প্রতিপক্ষের কয়েকজন এই হত্যার সঙ্গে জড়িত।
কথা হয় কবিরের স্ত্রী সুমা বেগমের সাথে, তিনি বলেন, আমার স্বামীকে নির্মমভাবে হত্যা করে পুকুরে ফেলে দেওয়া হয়েছে। তারপরও তারা থামেনি। চিরকুট পাঠিয়ে বলছে’ আমি এবং আমার সন্তানরা আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছি।
তিনি আরও বলেন, আমার স্বামী কোনো রাজনীতি করতো না, কারও সঙ্গে ঝামেলা ছিল না, এলাকায় সবার সাথে হাসিখুশি ভাবে চলাফেরা করতো। শুধু ওই জমির জন্য তারা আমাদের সর্বনাশ করলো।
কবির হোসেনের মৃত্যু শুধু একটি পরিবারের জন্য নয়, পুরো গ্রামের জন্যই এক গভীর ক্ষতির ঘটনা। বাক প্রতিবন্ধী হয়েও তিনি ছিলেন পরিশ্রমী ও সহায়ক মানুষ। প্রতিবেশীদের প্রয়োজনে সবসময় এগিয়ে যেতেন। গ্রামের এক প্রবীণ বাসিন্দা আবু বক্কর মিয়াবলেন, ওর মতো নিরীহ মানুষকে যদি এমনভাবে হত্যা করা হয়, তাহলে আমরা কেউই নিরাপদ নই।
স্থানীয় কয়েকজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, এই হত্যার সঙ্গে জড়িত সন্দেহভাজনরা প্রভাবশালী মহলের ঘনিষ্ঠ। এ কারণেই হয়তো তদন্তে ধীরগতি দেখা দিচ্ছে। অনেকে আশঙ্কা করছেন, যথাসময়ে ব্যবস্থা না নিলে প্রমাণ নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
তজুমউদ্দিন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি মোঃ মোহাব্বত খান জানান,ঘটনাটি গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করা হচ্ছে। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পেলে তদন্ত সাপেক্ষে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এবং সব প্রমাণ সংগ্রহ করে হত্যার রহস্য উন্মোচন করা হবে।
কবির হোসেনের মৃত্যুরহস্য দ্রুত উদঘাটন করে অপরাধীদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছেন গ্রামবাসী, মানবাধিকার কর্মী ও নিহতের পরিবার। ন্যায়বিচার না হলে এই ক্ষোভ আরও বিস্তৃত আকার নিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সান নিউজ/আরএ