শিল্প ও সাহিত্য
জাপানের গল্প - ১৮

ঋতির সাথে পরিচয়

পি আর প্ল্যাসিড

মিতুল তার কাজের উদ্দেশে ট্রেনে চড়ে টোকিও স্টেশন যায়। টোকিও স্টেশনে ট্রেন পৌঁছার পর ট্রেন থেকে নেমে প্ল্যাটফরমে কিছু সময় দাঁড়িয়ে যাত্রীদের ভিড় কমার জন্য সে অপেক্ষা করে। এরপর উপর থেকে নিচে নামার সময় মিতুল খেয়াল করে, একটি মেয়ে তার আগে আগে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামছে। আজকাল সালোয়ার কামিজ বা শাড়ি পরা অনেককেই দেখা যায় টোকিওর বিভিন্ন রাস্তায় চলাফেরা করতে। বিশেষ করে আকিহাবারা ইলেক্ট্রোনিক্স মার্কেটে গেলে সবসময় একজন না একজনকে দেখা যায়। ওদের বেশির ভাগ হয় ভারতীয় না হয় শ্রীলংকান বা নেপালি।

তবে বাংলাদেশি মেয়েও আজকাল কম দেখা যায় না। এদের কেউ কেউ কারো না কারো স্ত্রী, জাপানে ডিপেন্ড ভিসায় আছেন কিংবা সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে জাপানের কোনো না কোনো প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন।

তাদের মতোই কেউ হবেন মনে করে মিতুল ততোটা গুরুত্ব না দিয়ে তার মতো করে সে স্টেশনের বাইরে যাবার জন্য উপর থেকে নিচে নেমে বাহির হবার পথের ঠিক সামনে লাইনে দাঁড়ায়। কি মনে করে সে আবার লাইন থেকে সরে এসে কাছেই ইন্ডিকেট করা রাস্তার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা খোঁজার চেষ্টা করছিলো। এসময় মেয়েটি এগিয়ে এসে বলল, এক্সকিউজ মি?
মিতুল চোখ ঘুরিয়ে তার দিকে তাকায়। মেয়েটি এবার তার আরো কাছে গিয়ে প্রশ্ন করে, - আর ইউ ফ্রম ইন্ডিয়া?
- নো সরি। আই এ্যাম ফ্রম বাংলাদেশ।
মেয়েটি বাংলাদেশের কথা শুনেও আবার প্রশ্ন করলো, - ডু ইউ স্পিক ইন বাংলা?
- অফকোর্স। হোয়াই নট। আমি তো বললাম, আমি বাংলাদেশি। বাংলা আমার মাতৃভাষা। বলুন আমি কি উপকার করতে পারি আপনার?
- আমি টোকিওতে নতুন এসেছি। এখানে রাস্তা ঘাট তেমন ভালো চিনি না। আমি আকিহাবারা স্টেশন যাবো। আমাকে একটু দেখিয়ে দিবেন, কি করে এখান থেকে যেতে হবে?

মিতুল আরেকবার মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল, - দেখিয়ে দিতে আমার কোনো আপত্তি নেই। তবে জাপান এমন করে সাজানো হয়েছে যে, চাইলেই যে কেউ নতুন জাপান এসেও কারো কোনো সাহায্য সহযোগিতা ছাড়াই পথ চলতে পারে। যদি তার হাতে কোনো স্মার্ট ফোন থাকে, তাহলে তো আর কোনো সমস্যাই হবার কথা নয়।
মিতুলের কথায় মেয়েটি সামান্য লজ্জা পায়। একবার মনে মনে ভাবে, সরি বলে তার কাছ থেকে বিদায় নিবে। আবার ভাবে, বলেই যেহেতু ফেলেছে তাই একটু কথা বলতে সমস্যা কি? তাই বলল, আমি থাকি ওসাকা। এবার আমি গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করেছি। টোকিও আসলাম জব হান্টিংয়ে।

টোকিও স্টেশন হচ্ছে ব্যস্ততম একটি রেল স্টেশন। এখানে প্রতি নিয়ত হাজার হাজার লোক ট্রেনে উঠা নামা করছে। ওরা যেখানে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল সেখানে বেশি সময় এভাবে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হচ্ছিল না। তাই একটু সাইড করে নিজেদের নিরাপদ জয়গায় নিয়ে কথা বলতে থাকে। অনেক দিন হয় আপনার, এই জাপানে? মেয়েটি মিতুলকে প্রশ্ন করে।
- আমি জাপান আসছি অনেক বছরই হয়ে গেলো। বলেই আবার বলল, আমিও এখানে ল্যাংগুয়েজ কোর্স করেছি একসময়। শেষ করার পর বিভিন্ন জায়গাতে ধন্যা দিয়েছি একটি চাকরির জন্য। এখন পর্যন্ত ভালো কিছু হয়নি। তাই আপাতত একটি ছোট খাটো জব করছি। ভাবছি ভালো জব না পেলে কোনো ইউনিভার্সিটিতে বা সেমমন-এ আবার ভর্তি হয়ে যাবো।
- টোকিওতে তো শুনেছি অনেক জব অপরচ্যুনাইটি আছে। আপনি কি এতো বছরে কোনো জব খুঁজে পাননি?

এখানে নিজেদের ততোটা জব খুঁজে পাওয়া কঠিন। কোনো কাজ খুঁজতে দালাল ছাড়া কিছু করা সম্ভব হয় না দেখছি। দালাল ধরে জব খুঁজলেও কোনো সমস্যা হতো না। এখানে দালালেরা অনেক টাকা ডিমান্ড করে। তার মধ্যে ভিসা করিয়ে দেয় এক প্রতিষ্ঠান থেকে আবার কাজ করতে হয় অন্য প্রতিষ্ঠানে। পরবর্তীতে ভিসা এক্সটেনশন করতে আবার হয় যতো ঝামেলা। এতে ধরা পড়লেও চাট্টি পাট্টি গুটিয়ে দেশে চলে যাবার সম্ভাবনা বেশি, খুব ঝুঁকিপূর্ণ।
- আমি অবশ্য একটা কোম্পানীতে যোগাযোগ করেই আজ এসেছি। আজকে আমার ইন্টারভিউ হবার ডেট। এই জন্যই আসলাম ওসাকা থেকে টোকিও।
- কেনো, ওসাকাতে কি জবের সমস্যা নাকি? আমি তো শুনেছি ওসাকাতে অনেক জব অপরচ্যুনাইটি রয়েছে।
- আমি সার্চ করেছি সব জায়গাতেই। যেখানেই হয়, ভালো জব হলে আমি করতে চাই। এখানে ওরা কল করেছে যেহেতু দেখি আগে ইন্টারভিউ দিয়ে, তারপর না হয় বলা যাবে। জাপানে এখন আপাতত আমার ভিসা টিকানো জরুরী। দেশে ফিরে যেতে চাই না। যে কোনো ভাবে জাপান আমি থেকে যেতে চাচ্ছি।
- আপনার ইন্টারভিউ কয়টার সময়।

নিজের হাত ঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে আবার মিতুলের দিকে তাকায়। - এখনও হাতে অনেক সময় আছে। আপনি কি ব্যস্ত? সময় হবে একটু বসে কথা বলার?

মিতুল সামনেই বাহির হবার পথের উপর বড় চার কোণা সাদা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখে বলল, - বসলে বসা যায়, তবে খুব বেশি হলে এক ঘন্টা সময় দেয়া যাবে আপনাকে।
- বসলে কাজের ক্ষতি হবে না তো আবার আপনার?
- ক্ষতি হলে তো আপনাকে বলতামই, সময় দিতাম না।
এরপর স্টেশনের ভিতরেই একটা কফি শপ খুঁজে তারা বসে। বসেই ঋতি বলল, অনেক বড় স্টেশন মনে হয়।
- আপনি তো উপরেই দেখছেন। মাটির নিচে যা করে রেখেছে ওরা, দেখলে আপনার মাথাই নষ্ট হয়ে যাবে। আমাদের দেশের ত্রিশ বত্রিশ তলা দালানের সমান নিচে পর্যন্ত প্ল্যাটফরম রয়েছে এখানে। সেখান থেকে প্রতিদিন শত শত ট্রেন আসছে আর যাচ্ছে। তারপর বুলেট ট্রেন তো আছেই। টোকিও স্টেশন মানে আমাদের জন্য এক এলাহি কান্ড। এখানে সকাল সন্ধ্যা দাঁড়ালে মনে হবে আমাদের কমলাপুর স্টেশনের বাবারও বাবা যেন এটি। এতো বেশি যাত্রী প্রতিদিন আসা-যাওয়া করে, আপনি ভাবতেই পারবেন না।

মিতুলের কথায় ঋতি হাসে। হেসে বলল, আমি শুনেছি টোকিওর লাইফস্টাইল খুবই ব্যয় বহুল। আর এখানে যারা থাকেন তারাও নাকি খুবই ব্যস্ত থাকে। তাদের কাজের বাইরে কোনো সময় থাকে না নিজের জন্য ব্যয় করার।
- লাইফ স্টাইল কে কেমন করে দেখে জানি না। তবে যেমন আয় তেমন ব্যয়। আর ব্যস্ত তো হবেই। এই জন্যইতো জাপান। জাপানিদের যে বলা হয় কাজ পাগল, এই কাজের কারণেই বলা।
- আমি তো ভাবছি জবটা যদি হয়েই যায় তাহলে সবকিছু নতুন করে সাজাতে হবে এখানে। বিশাল খরচের ব্যপার। আমি শুনেই হিমশিম খাচ্ছি।
- আপনি তো মনে হয় এখনো সিংগেল।
- হুম।
- কারো সাথে কি এফেয়ার্স আছে।
- দেশে ঠিক করা রয়েছে।
- তাহলে তাকে সাথে করে নিয়ে আসলেন না কেনো?
- বললেই কি আর আনা হয়ে যায়? তারপরেও বলেছিলাম। জাপান আসতে চায় না সে। জাপানের প্রতি বিন্দু মাত্র আগ্রহ নেই তার।

আপনি থাকবেন জাপান অথচ সে আসবে না। তা কি করে হয়?
- আমি এখন আর ওসব নিয়ে ভাবি না। আগে আমার ভালো ক্যারিয়ার গঠন করতে হবে, তারপর অন্য কিছু।
- জব হলে তো আপনার সবকিছু কোম্পানিই করে দিবে। আপনার এ নিয়ে এতো ভাববার কি আছে?
- কাউকে এখানে চিনি না জানি না। একা তো, তাই বলছি।
- এইতো আমাকে চিনলেন। এখন থেকে আপনার একজন না হয় পরিচিত মানুষ হলো টোকিওতে। এ নিয়ে আর এতো ভাববার কি আছে? বলেই মিতুল তার মোবাইল নম্বর একটা টিস্যু পেপারে লিখে দিয়ে বলল, - আমার আসলে জব আছে। এখন আমি আপনাকে আর সময় দিতে পারছি না। দরকার হয় আপনি ইন্টারভিউর কাজ শেষ করে তারপর না হয় আমাকে কল দেন। কল দিলে জব থেকে চলে এসে না হয় সময় দেবো?

এর মধ্যে তাদের কফি খাওয়া শেষ। ঋতি মিতুলকে তার সাথে থাকতে বলতে পারছে না আবার চলে যাওয়াটাও যেন মানতে পারছে না। প্রথম পরিচয়ে এতো অল্প সময় বসে কথা বলায় কত যেন আপন হয়ে যায় তারা একে অপরের। মনে মনে ভাবে টোকিওতে আমার কেউ নেই এখন আর এই কথা বলা যাবে না। বলতে পারবো কেউ একজন আছে যার সাথে টোকিও স্টেশনে ট্রেন থেকে নেমেই পরিচয় হয়েছে। নাম তার মিতুল।

মেয়েটি চুপ করে কি যেন ভাবতে থাকে। মিতুল তার নীরবতা ভাঙিয়ে বলে, - কিছু মনে করবেন না, আপনার নামটা কিন্তু এখনও জানা হলো না।

হাসি মাখা মুখে বলল, - আমার নাম ঋতি। আমাকে আপনি তুমি করে বলতে পারেন। তাছাড়া আপনার যেতে যেহেতু হবেই, যান। আর ধরে রাখবো না। আমি না হয় আমার ইন্টারভিউ দিতে নির্ধারিত ঠিকানার দিকে এগোই। বলেই মোবাইল নম্বর লেখা টিস্যু পেপার তার সাথে রাখা নোট খাতার মধ্যে ভরে রেখে বলল, - দোয়া করবেন যেন জবটা আমার হয়। তাহলে আবার দেখা হবে আমাদের এই টোকিওতে। বলে দু'জন দু'জন থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায় যে যার গন্তব্যের উদ্দেশে।

(চলবে)

লেখক, জাপান প্রবাসী সাংবাদিক, লেখক।

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

জায়েদের ফোন পানিতে ছুড়ে ফেললেন সাকিব

বিনোদন ডেস্ক: বাংলাদেশ ক্রিকেটের...

রাজধানীতে তাপমাত্রা বাড়ছে

নিজস্ব প্রতিবেদক: চলতি তাপপ্রবা...

টিভিতে আজকের খেলা

স্পোর্টস ডেস্ক: প্রতিদিনের মতো আজ বুধবার (১লা মে) বেশ কিছু খ...

চীনে সড়ক ধসে নিহত ১৯ 

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: চীনের দক্ষিণাঞ...

বিরক্ত হয়েই শাকিবের পরিবার এই সিদ্ধান্ত 

বিনোদন ডেস্ক: ঢাকাই সিনেমার শীর্ষ নায়ক শাকিব খানকে নতুন করে...

কাঁচা আমের উপকারিতা

লাইফস্টাইল ডেস্ক: গ্রীষ্মকালে সবচ...

আ’লীগ জনগণের কল্যাণে কাজ করে

নিজস্ব প্রতিবেদক: আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও...

১০ জেলেকে মুক্তি দিল আরকান আর্মি

নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশের অভ্যন্তরে...

বজ্রপাতে একদিনেই প্রাণ গেল ১০ জনের

নিজস্ব প্রতিবেদক: বৃষ্টিহীন বৈশাখ...

হাসপাতাল থেকে বাসা ফিরলেন খালেদা জিয়া

নিজস্ব প্রতিবেদক: বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খা...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা