হাসনাত শাহীন : ‘তোমার প্রকাশ হোক কুহেলিকা করি উদঘাটন/ সূর্যের মতন।/ রিক্ততার বক্ষ ভেদি আপনারে করো উন্মোচন।/ উদয়দিগন্তে ওই শুভ্র শঙ্খ বাজে।/ মোর চিত্তমাঝে/ চির-নূতনেরে দিল ডাক/ পঁচিশে বৈশাখ।’ ..সময়ের পথপরিক্রমায় বছর শেষে আবারো এলো পঁচিশে বৈশাখ।
শনিবার (৮ মে), উদার বিশ্ববোধের কবি, বাঙ্গালির আত্মার মুক্তি ও সার্বিক স্বনির্ভরতার প্রতীক কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন। আজ থেকে ১৫৯ বছর আগে ১২৬৮ বঙ্গাব্দের পঁচিশে বৈশাখ এবং ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের ৬ মে (বাংলা বর্ষপঞ্জি পরিবর্তনে এখন বাংলাদেশে ৮ মে) কলকাতার জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।
বিশ্ববিশ্রুত এক বিস্ময়, বিরল প্রতিভার অধিকারী এই কবি’র ১৬০তম জন্মবার্ষিকী এবং ১৬১তম জন্মদিন। যিনি তাঁর জীবন ধরে কোটি কোটি বাঙালির স্বপ্ন আর হৃদয়ের আবেগ স্পন্দিত করে তুলেছেন তাঁর বিপুল সাহিত্যকর্মে। গল্প, কবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্প ও অসংখ্য গানের মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্যকে যেমন পরিপূর্ণতা দান করেছেন, তেমনই বিশ্বের দরবারে বাঙালিদেরকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতেও শিখিয়েছেন তিনি।
সৃজনের পরতে পরতে তিনি তুলে ধরেছেন প্রেম-বিরহ-প্রকৃতি-সংগ্রাম-মানুষের জীবনের খুঁটিনাটি সববিষয়। আর একারণেই বাঙালির মন-মনন, চিন্তা-অভিব্যক্তিজুড়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ। হয়ে উঠেছেন বাঙালির অস্তিত্ব-প্রাণের মানুষ; জীবনের অপরিহার্য ও অবিচ্ছেদ্য এক অংশ। যে কারণে গল্পে, উপন্যাসে, কবিতায়, সুরে ও বিচিত্র গানের বাণীতে, অসাধারণ সব দার্শনিক চিন্তাসমৃদ্ধ প্রবন্ধে, সমাজ ও রাষ্ট্রনীতিসংলগ্ন গভীর জীবনবাদী চিন্তাজাগানিয়া লেখায় এমনকি চিত্রকলায়ও সর্বত্রই রবীন্দ্রনাথ চির নবীন।
বাংলা সাহিত্যের মহীরুহ এই কবি বাংলা ১২৬৮ সালের ২৫ বৈশাখ (ইংরেজি ১৮৬১ সালের ৮ মে) কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে জন্মগ্রহন করেন। তিনি ‘পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং মাতা সারদা দেবী’র চতুর্দশ সন্তান। ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার জয়ের মধ্য দিয়ে কবিগুরু তাঁর অতুলনীয় সৃজনী প্রতিভায় বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বসাহিত্যের মর্যাদাপূর্ণ আসনে অধিষ্ঠিত করেন। বাংলা সাহিত্যের এই প্রাণপুরুষ সমাজকল্যাণমূলক কাজেও রেখেছেন বিশেষ ভূমিকা। শিক্ষাবিস্তার, কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নসহ তাঁর জনকল্যাণমূলক কাজগুলোও এক অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।
একাধারে কবি, নাট্যকার, কথাশিল্গী, চিত্রশিল্গী, গীতিকার, সুরকার, সংগীত পরিচালক, ছোট গল্পকার ও ভাষাবিদ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনা পরিমাণে বিপুল এবং বিষয়ে বৈচিত্র্যময়। সাহিত্যের প্রতিটি শাখাই সমৃদ্ধ হয়েছে তাঁর মেধা-মনন-সৃজনশীলতায়। প্রায় একক প্রচেষ্টায় তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে আধুনিক করে তুলেছিলেন। তাঁর রচনার কেন্দ্রীয় বিষয় হিসেবে উঠে এসেছে মানব, প্রকৃতি ও দেশপ্রেম। জীবনের শেষ পর্যায়ে চিত্রকলা চর্চায় মনোনিবেশ করে সেখানেও অনন্যতার স্বাক্ষর রেখেছেন; বিশ্বদরবারে অর্জন করেছেন বিশেষ খ্যাতি। তাঁর কাছে থেকেই আমাদের ‘জাতীয় সঙ্গীত’ ও ‘বাংলাদেশ’ নামের বানানটি নেয়া হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান বাঙালি তথা বাংলাদেশীদের যাপিতজীবনের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে। তাঁর রচনাবলি আমাদের প্রেরণার আলোকরশ্মি হয়ে পথ দেখায়। আশি বছরের জীবনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর জন্ম এবং মৃত্যুকে একাকার করে তুলেছেন অজস্র অমরতার শ্বাশত বার্তায়। তাই জন্মদিন নিয়ে তিনি লিখেছিলেন- ‘ওই মহামানব আসে/ দিকে দিকে রোমাঞ্চ/ মর্ত্যধুলির ঘাসে ঘাসে’। সেই তিনিই আবার জীবন সায়াহ্নে লিখলেন- ‘মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক আমি তোমাদেরই লোক।’ প্রথম এশীয় হিসেবে ১৯১৩ সালে ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
সেই সঙ্গে ভৌগলিক সীমা ছাড়িয়ে তার সৃষ্টির আলোয় বাংলাদেশের পাশাপাশি আলোকিত হয়েছে সমগ্র বিশ্ব-জগৎ। জন্মের ১৫৯ বছর পেরিয়ে গেলেও তাই বাঙালির প্রতিটি মুহূর্তের আবেগ, অনুভব-অনুভূতির ঘনিষ্ঠ সঙ্গী তার বৈচিত্র্যময় রচনা। সংগীত, কাব্য, নাটক, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনি, পত্রসাহিত্যসহ সব ধরনের রচনাকর্ম তার প্রতিভার স্পর্শে সোনার মতো দীপ্তিমান হয়ে উঠেছে। তিনি কেবল আমাদের আনন্দ-বেদনা, উৎসব-অভিলাষে প্রতি মুহূর্তের অনুসঙ্গীই নন, তিনি সংকটের সাহস, প্রতিবাদ-প্রতিরোধের প্রেরণাও। এ জন্যই তাঁর জন্মদিনটি শুধু বাংলাদেশেই নয়, এখন সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা বাঙালির কাছেই এক আনন্দঘন উৎসবের দিন। কবির ভাষায় বললে, ‘আকাশভরা সূর্যতারা/বিশ্বভরা প্রাণ...’।
সেই বিশ্বভরা প্রাণের উচ্ছ্বাসে শনিবার গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করা হবে কবিগুরুকে তারই লেখা গানে কবিতা নাটকে। আলোকের ঝরনাধারায় সৃজনশীল এক বিস্ময়কর মনীষীর স্মৃতিতে অবগাহনে মেতে উঠবেন দেশের সকল মানুষ-রবীন্দ্রপ্রেমীরা। বিশ্বের অন্যতম দার্শনিক ও কবির এ জন্মজয়ন্তীতে কবি’র প্রতি বিনম্রচিত্তে নিবেদন করবেন হৃদয় উৎসারিত আবেগ ও শ্রদ্ধা। কিন্তু বৈশ্বিক মহামারি করোনা ভাইরাস সংক্রমন নিরোধে জনসমাগম এড়িয়ে ডিজটাল পদ্ধতি উদ্যাপেনর জন্য সরকারি নির্দেশ থাকায় সংস্কৃতিমন্ত্রাণালয় একটি অনুষ্ঠান তৈরি করেছেন। এই অনুষ্ঠানই দেশের বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রচারিত হবে।
এদিকে, করোনাভাইরাসের মহামারীর এই ক্রান্তিলগ্নে অনলাইনে বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক’সহ অন্যান্য মাধ্যমে ভার্চুয়ালি রবীন্দ্রজয়ন্তী উদ্যাপন করবে দেশের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন। এসব আয়োজনে গান, কথা, নৃত্য ও গীতিনৃত্যনাট্যের মধ্য দিয়ে কবিকে স্মরণ করবে তার সুহৃদ ও শুভাকাঙ্খীরা।
এর মধ্যে দেশের ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট “ধর’ নির্ভয় গান” শীর্ষক আয়োজনে রবীন্দ্রজয়ন্তী উদ্যাপন করবে। আয়োজনটি প্রচারিত হবে ২৫ বৈশাখ (৮ মে) শনিবার, বাংলাদেশ সময় রাত ৯টায়।
এ বিষয়ে ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদক- লাইসা আহমদ লিসা জানান, রবীন্দ্রনাথ বাঙালির চিরকালের সঙ্গী; উৎসবে-সুখে-দুখে, সংগ্রাম-বিপ্লবে। অতিমারির দুর্দিনে, বিশ্বকবির জন্মদিবস উপলক্ষে, বিপন্ন বিশ্ব-সমাজের শুভ কামনায় তারই বাণী সকলকে যোগাক অভয় শক্তি। এবারের রবীন্দ্রজয়ন্তীতে ছায়ানটের নিবেদন “ধর’ নির্ভয় গান” শীর্ষক আয়োজন। আয়োজনটি উপভোগ করা যাবে ছায়ানটের ফেইসবুক গ্রুপ পেজ (facebook.com/groups/chhayanaut) ও ইউটিউব চ্যানেলে (youtube.com/ChhayanautDigitalPlatform)-এ।
এয়াড়াও কবিগুরুর এ ১৬০তম জন্মবার্ষিকীতে রবীন্দ্র সৃজনকলা বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজন করেছে ‘সীমার মাঝে অসীম তুমি...’।
এ অনুষ্ঠনটি প্রচারিত হবে ২৫ শে বৈশাখ শনিবার সকাল সাড়ে ১১টায়। এ আয়োজনটি উপভোগ করা যাবে- চ্যানেল আই অনলাইন www.facebook.com/channelitv এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেসবুক পেইজে www.facebook.com/tuca1861 এই ঠিকানায়। এতে আলোচনায় অংশ নেবেন- সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আসাদুজ্জামান নূর, কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন, ভারতের রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক ড. পবিত্র সরকার, রবীন্দ্র সৃজননকলা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা।
প্রসঙ্গত, বাংলা ১৩৪৮ সালের ২২ শ্রাবন (ইংরেজি ১৯৪১ সালের ৬ আগষ্ট) কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে শ্রাবণের বাদলঝরা দিনে ইহলোকের মায়া ত্যাগ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
সান নিউজ/এইচ এস/আরআই
 
                                     
                                 
                                         
                     
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                        
                         
                                 
                                 
                                 
                                 
                                 
                                 
                     
                             
                             
                     
                         
                                 
                                 
                                 
                                 
             
                     
                             
                             
                     
                            