মতামত

ড. কুদরত ই খুদা শিক্ষানীতি ও এখনকার কোন শিক্ষকের তৈরী মাল !

এম এম রুহুল আমিন:

বাংলাদেশের অভ্যূদয়ের পরপরই বিজ্ঞানী ও প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ড. কুদরাত ই খুদা শিক্ষা কমিশনের মাধ্যমে অবিভক্ত পাকিস্থানের শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান ২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭২ তারিখে আমাদের নিজস্ব শিক্ষানীতি প্রনয়ণের উদ্যোগ গ্রহন করেন। ড. কুদরাত ই খুদা শিক্ষা কমিশন ১৯৭৪ সালের ৩০ মে ২৯৮ পৃষ্ঠার সুপারিশ সম্বলিত প্রতিবেদন জমা দেন। পরবর্তীততে উক্ত শিক্ষা কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে সরকার ১৯৭৫ সালে কারিক্যূলাম ও সিলেবাস প্রনয়ণের জন্য বিশিষ্ঠ শিক্ষাবিদ অধ্যাপক শামসুল হকের নেতৃত্বে ৫১ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেন। উক্ত কমিটি ১৯৭৬ থেকে ১৯৭৮ সাল পযন্ত কাজ করে ৭ ভল্যুমের একটি বিস্তারিত সুপারিশমালা প্রনয়ণ করেন।

এরপর শিক্ষাবিদ মজিদ খান শিক্ষা কমিশন ১৯৮৩, অধ্যাপক মফিজউদ্দিন আহমদ শিক্ষা কমিশন ১৯৮৭, অধ্যাপক এম শামসুল হক শিক্ষা কমিশন ১৯৯৭, অধ্যাপক এম এ বারী শিক্ষা কমিশন ২০০১, অধ্যাপক এম মনিরুজ্জামান মিঞা শিক্ষা কমিশন ২০০৩ এবং সবশেষে অধ্যাপক কবীর চৌধুরী শিক্ষা কমিশন ২০০৯ বাংলাদেশের শিক্ষানীতি নিয়ে ব্যাপক কাজ করেন। ড. কুদরাত ই খুদা শিক্ষা কমিশনের পর যতগুলো শিক্ষা কমিশন গঠিত হয় তার সবগুলোই ড. কুদরাত ই খুদা শিক্ষা কমিশনের ভিত্তিতেই গঠিত হয় এবং সকলেই উক্ত কমিশনের সুপারিশের আলোকে বাংলাদেশের শিক্ষানীতির পরিমার্জন ও পরিবর্ধন করেন। অবশ্য বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্বে অর্থাৎ ড. কুদরাত ই খুদা শিক্ষা কমিশনের পূর্বে ১৮৫৪ সালের ”উডস্ শিক্ষা ছাড়” থেকে শুরু করে জেনারেল ইয়াহিয়ার সরকারের এয়ার মার্শাল নুর খান শিক্ষা কমিশন ১৯৬৯ পযন্ত মোট ৮টি শিক্ষা কমিশন উপমহাদেশের শিক্ষানীতি নিয়ে কাজ করে। ড. কুদরাত ই খুদা শিক্ষা কমিশনের মূল মন্ত্র ছিল “শিক্ষা হবে জাতির আশা-আকাঙ্খা ও নতুন সমাজ গঠনের অস্ত্র”। শিক্ষকদের সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে কমিশনের সুপারিশ ছিল ” আমাদের জাতীয় জীবনে সমাজ যদি শিক্ষককে তাঁর যথাযথ স্বীকৃতি না দেয় তাহলে কোন শিক্ষা সংস্কার সফল হবেনা”।

ড. কুদরাত ই খুদা শিক্ষা কমিশনের মর্মার্থের ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধু একই সময়ে বিশিষ্ঠ শিক্ষাবিদ অধ্যাপক কবীর চৌধুরীকে শিক্ষা সচিব পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে পিতার দেখানো পথে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এলে, ২০০৯ সালে আবার জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীকে শিক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান নিযুক্ত করেন।

রাষ্ট্রের শিক্ষানীতি, শিক্ষা ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়ণের ক্ষেত্রে বস্তুুত: বঙ্গবন্ধু ও তদীয় কন্যা সবসময় ড. কুদরাত ই খুদা শিক্ষা কমিশনের ভিত্তিতে শিক্ষাবিদদেরকে দায়িত্বে রাখার কৌশল গ্রহন করেন। বঙ্গবন্ধু বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক কবীর চৌধুরীকে শিক্ষা সচিব পদে নিযুক্ত করা ছাড়াও শিক্ষামন্ত্রকের দায়িত্বে নিযুক্ত করেন বিশিষ্ঠ শিক্ষাবিদ অধ্যাপক এম ইউসুফ আলী ও ড. মোজাফফর আহমদ চৌধুরীকে ।

দূর্ভাগ্যজনক ভাবে হলেও সত্য যে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর পর যথাযথ মনিটরিং এর অভাবে শিক্ষা প্রশাসনের পরিচালনা ও আর্থিক ব্যবস্থাপনার সীমাবদ্ধতা সরিয়ে কাযকরী শিক্ষা প্রশাসন প্রবর্তন সম্ভব হয়নাই। বাংলাদেশ সৃষ্টির আগে ও পরে বৃটিশ শাসন ব্যবস্থার মডেল অনুসরণ করে একশ্রেনীর সিভিল সার্ভেন্টরা নিজেদের গোষ্টিস্বার্থে ড. কুদরাত ই খুদা শিক্ষা কমিশনের শিক্ষা প্রশাসন অংশটুকু বাস্তবায়ন হতে দেয়নি। অন্যদিকে শিক্ষকদের মধ্যে থেকে এমন কোন নেতৃত্ব গড়ে ওঠেনি বা গড়ে ওঠার ক্ষেত্র তৈরী হয়নি যার মাধ্যমে সিভিল প্রশাসন থেকে শিক্ষা প্রশাসনকে আলাদা করা যেত। সময়ে সময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ ও বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষক নিযুক্তির বিভাজন শিক্ষা বিভাগকে দূর্বল করে রেখেছে। ফলে শিক্ষা প্রশাসন শিক্ষাবিদদের হাতছাড়া হয়ে গেছে।

ইদানিং মেধাবীরা আর শিক্ষকতায় আসতে চাননা। দেখা গেছে বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারে চাকুরী হবার পরও অনেকে আবার পরের বিসিএস দিয়ে অন্যকোন ক্যাডারে চলে যাচ্ছেন। আন্ত:ক্যাডার বৈষম্য ও সামাজিক সুযোগ সুবিধার তারতম্যের কারণে সমাজে মেধাবী শিক্ষক তৈরী হচ্ছেনা। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় ও বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ রাজনৈতিক সংশ্লিষ্ঠতা ও অবৈধ লেনদেন দুটি বিষয়ের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। মেধা সেখানে গৌণ । অনেক সময় রাজনৈতিক বা আর্থিক বিবেচনায় নিযুক্ত বেসরকারী শিক্ষকেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের সুযোগে বিসিএস এর মাধ্যমে নিযুক্ত শিক্ষকদের সাথে অসম প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বেপরোয়াভাবে লাভজনক পদ-পদবী বাগিয়ে নিয়ে মেধাবী শিক্ষকদেরকে হতাশার মুখে ঠেলে দিচ্ছেন। জাতীয় পযায়ে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে চাকুরী অর্জনের মর্মার্থ অনুধাবন করতে তারা সক্ষম হননা। সেটাও মেধাবীদের শিক্ষকতায় আসার অন্তরায় । অবস্থাটা এমন হয়ে দাড়িয়েছে যে, পাশ করেও মেডেল; ফেল করেও মেডেল। দুধ ও ঘি একই দাম। বাংলাদেশে শিক্ষকের সামাজিক মর্যাদা (Status ড. কুদরাত ই খুদা শিক্ষা কমিশন ) কতটুকু আছে বা মর্যাদা পরিমাপের মানদন্ড আদৌ আছে কিনা তা নিসন্দেহে অজানা। দেখা যায় যে, বাংলাদেশে সরকারী চাকুরীতে প্রবেশের পরীক্ষা ছাড়া একমাত্র শিক্ষকতার ক্ষেত্রে সরকারী হওয়া যায়। প্রশাসন, পুলিশ, বিচার বা অন্য ক্যাডারে এটার সুযোগ নাই।

কিছুদিন আগেও প্রশাসনের কর্মকর্তারা অধ:স্তন কোর্টের বিচার কাজ করতেন যা মাসদার হোসেন মামলার মাধ্যমে বিচার বিভাগ প্রশাসন বা নির্বাহী বিভাগ থেকে কিছুটা আলাদা করতে সক্ষম হয়েছে। অন্যদিকে পুলিশ বিভাগও আন্ত:ক্যাডার সমতা নির্ধারণে সক্ষমতা অর্জন করেছে। আজও কেবল পারেনি শিক্ষা বিভাগ।কারণ শিক্ষকেরাই কেবল বলতে পারেনা যে আমরা তোমদেরকে জ্ঞানের আলো দেব না। আইন মন্ত্রী বা সচিব হতে হলে আইনপেশার লোক হওয়ার রেওয়াজ থাকলেও শিক্ষামন্ত্রী হওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষাবিদ হওয়ার নজীর শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধুর সরকার ছাড়া আর কোন সময়ে দেখা যায়নি।

এখন কোন কোন শিক্ষকের উৎপাদিত ছাত্র/ছাত্রী মাস্টার্স পাশ করে ডিসি / এডিসি ......... হচ্ছে। তাদের ব্যস্ততাও অনেক। তার অধীনে বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, পুলিশ, গণপূর্ত, কৃষি,রাজস্ব, সমবায়, পরিবেশ, মাদক-দ্রব্য বিভাগ,.....। তিনি এতই ব্যস্ত যে, তিনি নিজে বা নির্দেশে বৃদ্ধ কৃষককে জামার কলার ধরে টেনে হিচড়ে আনতে হয়, গভীর রাতে সাংবাদিক আরিফের ঘরের দরজা ভেঙ্গে ক্রস ফায়ারের জন্য আনতে হয়, ডাক্তারের জন্য বরাদ্দ পিপিই পরার কথা আবেগের সাথে বলার অপরাধে জাকিয়াকে চাকুরীচ্যূত করতে হয়, কোন শিক্ষককে প্রকাশ্যে কান ধরে উঠ্-ব্‌স্ করাতে হয়, আরো কত কি ......।

কার্যকরী শিক্ষানীতি বাস্তবায়িত না হবার ফলে কখনো কখনো কোন শিক্ষককে তার সরাসরি ছাত্রের অধীনস্ত হওয়া যেমন সম্ভব; তেমনি কখনো কখনো কোন নব্য প্রশাসক কোন অধ্যাপককে তার অধীনস্ত হিসাবে শোডাউন করে আরামের খায়েশ মিটাতেও দ্বিধান্বিত হননা।

এরাই তো সেই সব শিক্ষকদের ফ্যাক্টরীতে তৈরী মাল; জাতিকে এসব মালের বোঝা আর কতকাল বইতে হবে ?

লেখক: এম এম রুহুল আমিন, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ও সদস্য, জাতীয় প্রেস ক্লাব

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

বিশ্বকাপের টিকিট নিশ্চিত কানাডার

আগামী টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে জায়গা করে নিল কানাডা। আমেরিকা অঞ্চলের বাছাইপর্বে...

নিবন্ধনের আবেদন করলেন এনসিপি

রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন পেতে নির্বাচন কমিশনে আবেদন করেছে জাতীয় নাগরিক পার্...

ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের হামলা

ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্র ‘খুব সফল’ হামলা চালি...

শ্রীলঙ্কা সিরিজের জন্য ওয়ানডে দল ঘোষণা বিসিবির

শ্রীলঙ্কা সিরিজের জন্য ওয়ানডে দল ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)।...

আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা ঢাকা মেডিকেল শিক্ষার্থীদের

ঢাকা মেডিকেলের প্রশাসন থেকে দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস না মেলায় হোস্টেল না ছেড়ে...

৪ দিনের রিমান্ডে সাবেক সিইসি নুরুল হুদা

প্রভাব খাটিয়ে বিতর্কিত ও প্রহসনের নির্বাচন দেওয়ার অভিযোগে রাজধানীর শেরেবাংলা...

শ্রীলঙ্কা সিরিজের জন্য ওয়ানডে দল ঘোষণা বিসিবির

শ্রীলঙ্কা সিরিজের জন্য ওয়ানডে দল ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)।...

মেরিল স্ট্রিপকে কতোটা চেনেন

স্কুলে একটি গানের আয়োজন হতে যাচ্ছে। সেখানে ডাক পড়ে ১২ বছরের এই কিশোরীর। তিনি...

ভূতুড়ে মামলায় বারবার রিমান্ডে নিচ্ছেন কেন : শাজাহান খান

রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানার সাজেদুর রহমান ওমর হত্যা মামলায় সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্র...

সাবেক সিইসি নূরুল হুদার ১০ দিনের রিমান্ড চায় পুলিশ

বিতর্কিত নির্বাচনের অভিযোগে করা মামলায় সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূ...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা