প্রতীকী ছবি
মতামত

উকিল নোটিশের কবলে মঙ্গল শোভাযাত্রা

অজয় দাশগুপ্ত: আমাদের দেশে চমকের অভাব নাই! সংবাদেরও অভাব নাই! বলা উচিত দুঃসংবাদ বা অবাক করে দেয়ার মতো খবরের অভাব নাই! সুসংবাদ ও দুঃসংবাদের ভেতর তফাৎ সেই পুরনো গল্পের মতো। দুধ শরীরের জন্য উপকারী কিন্তু আমাদের সমাজে এককালে তা বাড়ি বয়ে এনে দিয়ে যেতে হতো। আর মদ বা সুরা? সে যত দুষ্প্রাপ্য কিংবা ব্যয়বহুল হোক না কেন তা কেনার জন্য খদ্দেরের যেমন অভাব হয় না, তেমনি যেখানে মিলবে সেখানেই ছুটবে মানুষ।

আরও পড়ুন: প্রথম আলো গণতন্ত্রের শত্রু

নিষিদ্ধ বা মন্দ নামে পরিচিত যে কোনো কিছুর জন্য এমন তাড়না মানুষের সহজাত। আজ সকালে দেখি সামাজিক মিডিয়া আর প্রচারে এগিয়ে আছে এক উকিল ভদ্রলোক। এই আইনজীবীর নাম মাহমুদুল হাসান। হঠাৎ করে তার মনে হয়েছে বৈশাখ ঠিক থাকলেও বৈশাখী শোভাযাত্রা বা মঙ্গল শোভাযাত্রা ঠিক না। কেন ঠিক না? সেটা তার পাঠানো উকিল নোটিশ পড়লেই বোঝা সম্ভব।

রবিবার রেজিস্ট্রি ডাকযোগে পাঠানো ওই নোটিশে বলা হয়েছে যে, পহেলা বৈশাখ বাঙালি সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। হাজার বছর ধরে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীর বাঙালি জনগণ পরস্পরের ধর্ম সম্মান করে এই পহেলা বৈশাখ উদযাপন করে আসছে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এই যে, মঙ্গল শোভাযাত্রার নামে একটি কৃত্রিম কার্যকলাপ বাঙালি সংস্কৃতির পহেলা বৈশাখের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। মূলত এই কৃত্রিম উদ্ভাবিত মঙ্গল শোভাযাত্রার সঙ্গে পহেলা বৈশাখের কোনো সম্পর্ক নেই।

আরও পড়ুন: সিগারেট বা মশার কয়েল থেকে আগুন

১৯৮৯ সালে পহেলা বৈশাখে ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’ নামে এক ধরনের পদযাত্রা শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে এই আনন্দ শোভাযাত্রাকে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ হিসেবে নামকরণ করা হয়। নোটিশে আরো বলা হয়, ‘মঙ্গল’ শব্দটি একটি ধর্মীয়সংশ্লিষ্ট শব্দ। সব ধর্মের লোকজন তাদের সৃষ্টিকর্তার কাছে ‘মঙ্গল’ প্রার্থনা করেন। এখন এই মঙ্গল শোভাযাত্রার সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের দৈত্য আকৃতির পাখি, মাছ ও বিভিন্ন প্রাণীর ভাস্কর্য প্রদর্শনের মাধ্যমে মুসলিম জনগণের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা হচ্ছে যা বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২(ক) এর সরাসরি লঙ্ঘন।

আজকাল আমাদের সমাজ রাষ্ট্র এমনকি বিদেশের বাংলাদেশিদের ভেতরও দেখি প্রবীণ মানুষদের চেয়ে নবীনদের মনে শঙ্কা ভয় আর উগ্রতার প্রকোপ। এক সময় আমাদের দেশ ও সমাজকে যারা পথ দেখাতেন তারা সবাই ছিলেন নবীন। তারুণ্যের স্বভাবধর্মই হচ্ছে টগবগে রক্তে আধুনিক থাকা। কিন্তু এখন আর তা নেই। মগজ ধোলাই বলি আর সমাজের ধারা বলি- তারুণ্যই এখন বেশি বদলে গেছে। তাদের আচার আচরণ বিশ্বাসে ঢুকে গেছে বহু জঞ্জাল। অনেকে বলেন, এর কারণ ডিজিটাল দুনিয়া। তারা নিমিষে দেশ-বিদেশের উগ্রতা বা বদলে যাওয়া দেখতে পায় বলেই না কি লুফে নেয়। আমি দ্বিমত পোষণ করি। একই ডিজিটাল দুনিয়ার একদিকে তো খোলা দুনিয়া আর সভ্যতাও আছে। কই সে দিকটা তো পপুলার হলো না? বলা ভালো সেটা গোপনে এনজয় করলেও বাহ্যিকভাবে তারুণ্য এখন পাপ পুণ্য আর জায়েজ না-জায়েজ বিচারে সময় ব্যয় করতে ব্যস্ত।

আরও পড়ুন: বাড়ল ঈদের ছুটি

সামাজিক মিডিয়াসহ নানা মিডিয়ায় এর বিচার বিশ্লেষণ শুরু হয়ে গেছে। যে যাই বলুক বা লিখুক আমি মনে করি, উকিলের এই নোটিশ মূলত আমাদের পচে যাওয়া সমাজের বহিঃপ্রকাশ। যার কারণ রাজনীতি আর কথিত ধর্মীয় উন্মাদনা। ধর্ম বিষয়ে কিছু বলতে যাওয়া মানে বিপদ টেনে আনা। তারচেয়ে বলবো এই অন্ধ প্রক্রিয়া মদদ দিতে গিয়ে রাজনীতি আজ নিঃস্ব। একের পর এক ভুল দাবি, অযৌক্তিক চাওয়া-পাওয়া মেনে নিতে সরকার প্রশাসন সবাই যখন ক্লান্ত এবং নিরুপায় তখন এমন চাওয়ার জন্ম হবেই। ক’দিন আগেই মামুনুর রশীদ বনাম হিরো আলম অসম বিতর্ক দেখেছি আমরা। কী শিখলাম? মামুনুর রশীদের জন্য এখন পৈতে দরকার। তাঁকে চেনাতে হচ্ছে। আর হিরো আলমের মতো একজন হয়ে উঠেছে সমাজের তথাকথিত নয়নমণি। এমন সমাজে মঙ্গল শোভাযাত্রার বিরুদ্ধে কথা উঠবে এটাই তো স্বাভাবিক।

অথচ উকিল হাসানের হয়তো অজানা নয় যে, এই মঙ্গল শোভাযাত্রা এখন ইউনেসকো স্বীকৃত। তারা কী বলছেন? ইউনেসকোর ওয়েবসাইটে মঙ্গল শোভাযাত্রার ইতিহাস তুলে ধরতে গিয়ে বলেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে এই শোভাযাত্রা বের হয়। ১৯৮৯ সালে সামরিক স্বৈরশাসনের হতাশার দিনগুলোতে তরুণেরা এটা শুরু করেছিল। শিক্ষার্থীরা অমঙ্গলকে দূর করার জন্য বাঙালির নানা ধরনের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক, প্রাণীর প্রতিকৃতি ও মুখোশ নিয়ে শোভাযাত্রা করে। মঙ্গল শোভাযাত্রা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার আরও যে কয়েকটি কারণ ইউনেসকো উল্লেখ করেছে তা হচ্ছে, এই শোভাযাত্রা অশুভকে দূর করা, সত্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির প্রতীক। এই শোভাযাত্রার মাধ্যমে বাঙালির ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, জাতিগত সব ধরনের বৈশিষ্ট্য এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের কাছে হস্তান্তরিত হয়।

আরও পড়ুন: অবৈধ মজুতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড

যে কোন দেশ বা জাতির জন্য গর্বের এমন একটা কাজ বন্ধ করার মতো আইনি নোটিশ পাঠানো কি অপরাধ নয়? সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি এমন চ্যালেঞ্জ জানানো এই উকিল সাহেব কি আসলে একাই এই কাজটি করছেন? না কি তার পেছনে আছে সেই শক্তি যারা মুক্তিযুদ্ধ বিরোধিতা থেকে এখনো আমাদের স্বাধীনতা আর মূল্যবোধের দুশমন?

বলাবাহুল্য একা এমন একটা কাজ করতে যাবেন না কোনো সুস্থ মন মানসিকতার মানুষ। নোটিশ পড়ে বোঝা যায় মঙ্গল শোভাযাত্রা বর্জন বা নিষিদ্ধ করার কারণ হিসেবে ধর্মকে টেনে আনা হয়েছে। যার নতুন নাম ‘স্পর্শকাতর বিষয়’। এমনই স্পর্শকাতর যে ধরা যাবে না, ছোঁয়া যাবে না, বা বলা যাবে না এমন কিছু।

তাই দেখার বিষয় এই উকিল নোটিশ নিয়ে সরকার কী বলে? কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানানো হয়? সামাজিক মিডিয়া বা লেখালেখি কিংবা বলার ভেতর প্রতিবাদ সীমিত হলে এই ধরনের নোটিশ ভবিষ্যতেও শোভাযাত্রাকে আক্রমণ করতে ছাড়বে না। এবারের মতো এমন নোটিশ উপেক্ষা করার ভেতর যারা মুক্তি খুঁজবেন বা চোখ বন্ধ করে সমস্যা এড়াতে চাইবেন তারা সুবিধাবাদী। তারা ধরি মাছ না ছুঁই গোছের। সবচেয়ে জরুরি প্রতিবিধান । কেবল আইন করে বা শাস্তি দিয়ে এর সমাধান মিলবে না। আইন শাসন করবে বটে; থামাবেও। কিন্তু সবচেয়ে বেশি দরকার সমাজ আর মানুষের বিবেক জাগিয়ে তোলা। কাজটা এখন অনেক কঠিন। অনুশাসনের নামে প্রায় ধোলাই হয়ে যাওয়া সমাজকে আবার পুরনো জায়গায় নিয়ে আসতে হলে সমাজের জাগরণ জরুরি।

আজ মঙ্গল শোভাযাত্রা, কাল হয়তো নববর্ষ উদযাপনের ওপরও এমন নোটিশ আসতে পারে। সাবধানতা আর প্রতিবিধানের পথ দেখাবেন কারা? তাঁরা কি জেগে আছেন?

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

লক্ষ্মীপুরে অসহায় মানুষের মাঝে ইফতার বিতরণ 

সোলাইমান ইসলাম নিশান, লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি...

স্বাধীনতা দিবস ছাত্রলীগের ইফতার বিতরণ 

সোলাইমান ইসলাম নিশান, লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি...

পঞ্চগড়ে মোটরসাইকেল আরোহীর মৃত্যু 

মো. রাশেদুজ্জামান রাশেদ, পঞ্চগড় প্রতিনিধি:...

ফেনসিডিলসহ ২ মাদক ব্যবসায়ী গ্রেফতার

মো. নাজির হোসেন, মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি: মুন্সীগঞ্জ পৌরসভার বৈ...

পানিতে ডুবে প্রাণ গেল শিশুর

নোয়াখালী প্রতিনিধি : নোয়াখালীর সেনবাগে পানিতে ডুবে এক শিশুর...

ভারতের পণ্য বর্জনে সরকার এত বিচলিত কেন?

নিজস্ব প্রতিবেদক: প্রধানমন্ত্রী শ...

দেশে বছরে অকাল মৃত্যু পৌনে ৩ লাখ 

নিজস্ব প্রতিবেদক: দূষণের কারণে বা...

বাগদান সারলেন অদিতি-সিদ্ধার্থ

বিনোদন ডেস্ক: ভারতের জনপ্রিয় তারকা অভিনেত্রী অদিতি রাও হায়দা...

আলুর দাম বাড়ার আশঙ্কা

নিজস্ব প্রতিবেদক: গত বছরের চেয়ে এ...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা