ছবি: সংগৃহীত
মতামত

বৈশাখে বাঙালির পাতে ইলিশ যেন সোনার হরিণ!

সৈয়দ জাফরান হোসেন নূর: পহেলা বৈশাখ, বাঙালি ঐতিহ্যের প্রাণের উৎসব ‘বাংলা নববর্ষ’। কালের পরিক্রমায় বাংলা বর্ষপঞ্জিতে যুক্ত হলো নতুন বর্ষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ।

আরও পড়ুন: নির্বিঘ্ন ঈদযাত্রায় জনসচেতনতা জরুরি

বহু সম্প্রদায়ের সম্প্রীতির বাংলাদেশে প্রতিবছর দিনটি ১৪ এপ্রিল পালন করা হলেও প্রতিবেশী দেশ ভারতে ১৫ এপ্রিল পালিত হয়। উৎসবমুখর এ দিনটি ঘিরে দেশজুড়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও ঐতিহ্যবাহী খাবারের আয়োজন করা হয়ে থাকে।

মুঘল সম্রাট আকবরের শাসনামল থেকে পহেলা বৈশাখ পালনের প্রচলন শুরু হয়। মূলত এ দিনে হালখাতা অনুষ্ঠান উৎযাপন করা হয়। তাই সকল পেশার মানুষ তাদের মহাজনের পাওনা পরিশোধ করে ও মহাজন তাদের মিষ্টি মুখ করিয়ে নতুন বছর শুরু করেন।

এছাড়াও বছরের প্রথম দিনে বাড়িতে বাড়িতে মাছ-মাংসসহ সামর্থ অনুযায়ী ভালো খাবারের আয়োজনের পাশাপাশি আত্মীয়-স্বজনদের দাওয়াত খাওয়ানোর রীতিও প্রচলিত রয়েছে।

আরও পড়ুন: ৮ই ফাল্গুনের চেতনা ও আমাদের বাস্তবতা

বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনটিকে ঘিরে দেশের শহর-নগর, গ্রাম-গঞ্জের বিভিন্ন স্থানে মেলা অনুষ্ঠিত হয়। মেলাগুলোতে পুতুল নাচ, সার্কাস, নাগরদোলা স্থান পায়।

এছাড়াও মেলায় স্থান দখল করে নেয় মৃৎশিল্প ও হস্তশিল্পের বিভিন্ন জিনিসপত্র। মেলার অন্যতম প্রধান আকর্ষণ বাউল শিল্পীদের গান। পহেলা বৈশাখ উপলক্ষ্যে কোথাও কোথাও নৌকা বাইচ অনুষ্ঠিত হয়।

দরিদ্র, উদারচিত্ত ও সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ মাছে ভাতে বাঙালির বৈচিত্রময় জীবন প্রবাহে দিনের শুরুটা হতো ভোরের আলো ফোটার আগেই পান্তা ভাত (রাতে হাড়িতে পানি দিয়ে ভিজিয়ে রাখা ভাত) খেয়ে কাজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়া। দুপুরে বাড়ি ফেরার পথে বিল/নদী থেকে মাছ ধরে নিয়ে আসা। বাড়ির মহিলারা সেই মাছ রান্না করে সবার জন্য খাবার পরিবেশন করে দিত। বাঙালির সুখটা ছিলো খুবই প্রকৃতি নির্ভর এবং হাতে সৃষ্টি।

আরও পড়ুন: মাতৃভাষা বাংলা চাই: আমরা কোন পথে

বাংলা নববর্ষের ঐতিহ্য বলতে সাধারণত: দেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর বৈশাখী মেলাকেই বোঝানো হয়। বর্তমানে বাঙালির অতীত ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ধারণ, লালন এবং দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে দেয়ার প্রক্রিয়াটা সম্পূর্ণ চলে গেছে একশ্রেণির পুঁজিবাদী গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে।

পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে বাংলা নববর্ষকে এতোটাই বাণিজ্যিকীকরণ করা হয়েছে- বাঙালি জাতির উৎসব যেনো ধনী শ্রেনীর বাঙলোর সম্পত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। একশ্রেণির পুঁজিবাদী গোষ্ঠী নববর্ষ উৎসব উদযাপনে পান্তা-ইলিশকেই প্রধান অনুষঙ্গ করেছে। পান্তা-ইলিশ ছাড়া যেনো নববর্ষই বৃথা।

এদিকে পহেলা বৈশাখের নববর্ষকে ঘিরে দেশে-বিদেশে চলে ইলিশ মাছের রমরমা বাণিজ্য। অথচ খোদ বাঙালির পাতে জোটে না ইলিশ।

বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতে পান্তা ইলিশের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। পান্তা-ইলিশের সাথে বাঙালি সংস্কৃতির কোনো সম্পর্ক নেই বা কবি, সাহিত্যিকদের লেখায়ও পান্তা-ইলিশের অস্তিত্ব নেই। এটা আজকের আলোচনার বিষয় না। তবে এটা সত্যি পহেলা বৈশাখে পান্তা ইলিশ খাওয়ার প্রচলন খুব বেশি দিন আগের নয়।

আরও পড়ুন: স্বাধীনতা মানে যা ইচ্ছে তা নয়, নিয়ম মেনে চলা

পান্তা-ইলিশের সাথে বাঙালি সংস্কৃতির সম্পর্ক থাকুক বা নাই থাকুক; পহেলা বৈশাখকে ঘিরে উৎসবকেন্দ্রিক ইলিশের একটা গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। নববর্ষের এ দিনে ইলিশ খাওয়ার আবেগী প্রতিযোগিতার পরিপূর্ণ ফায়দা তুলছে পুঁজিবাদী গোষ্ঠীর সিন্ডিকেট সিস্টেম। এ সময় পূর্ব পরিকল্পনার আলোকে দেশের বাজারে ইলিশের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। ফলে, ইলিশের ক্রয়ক্ষমতা দেশের সাধারণ জনগণের হাতের নাগালের বাইরে চলে যায়।

ইলিশের দাম বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কয়েকটি কারণের মধ্যে রয়েছে- এক. বিদেশে রফতানি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইলিশ রফতানি হলেও সবচেয়ে বেশি ইলিশ রফতানি হয় ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। কারণ, পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় ইলিশের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।

দ্বিজেন বর্মণ নামে কলকাতার একজন গবেষক মাছ বিষয়ে বলেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা ছাড়াও নদীয়া ও চব্বিশ পরগনার মানুষ ইলিশ খেতে খুব ভালোবাসে। এমনকি ভারতের উত্তর প্রদেশের অযোধ্যা, ফরিদাবাদ, দিল্লিতেও প্রচুর ইলিশ খাওয়ার মানুষ আছে।যেখানেই বাঙালি আছে সেখানেই এই মাছের কদর।

ইলিশের এ জনপ্রিয়তা শুধু স্বাদের জন্য নয় এক্ষেত্রে ব্রান্ড ভ্যালুর মতো একটি বিষয়ও কাজ করে বলেও জানান তিনি।

আরও পড়ুন: বহুমুখি মধ্যস্থতায় কাতারের অর্জন

তবে ইলিশের দাম এসব স্থানে অনেক বেশি উল্লেখ করে দ্বিজেন বর্মণ বলেন, দাম বেশি হলেও সেখানকার মানুষজন কিনছেন আর বড়াই করেও তা বলে বেড়ান।

অপরদিকে পশ্চিমবঙ্গে সংস্কৃতির সাথেও ইলিশ মাছের একটা সম্পর্ক রয়েছে। যেমন- সরস্বতী পূজার দিন, রথের দিন আর দুর্গা পূজার দশমীর দিন ইলিশ খাওয়ার একটা প্রথা আছে। রথের দিন জোড়া ইলিশ কিনে ধুপ দিয়ে, মাছের গায়ে হলুদ লাগিয়ে তাকে ঘরে তোলা হয়।

এছাড়াও পশ্চিমবঙ্গে এভাবে বরন করার গানও রয়েছে। এতে সহজেই অনুমেয় ভারতের বাজারে বাংলাদেশী ইলিশের চাহিদা কেমন ও কতোটা গুরুত্বপূর্ণ।

আরও পড়ুন: নতুন প্রতারণার নাম ই-ভিসা

অপরদিকে, ইলিশ অর্থনৈতিক ভাবে খুব গুরুত্বপূর্ণ গ্রীষ্মমণ্ডলীয় মাছ। বঙ্গোপসাগরের ব-দ্বীপাঞ্চল, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা নদীর মোহনার হাওর থেকে প্রতি বছর প্রচুর পরিমাণে ইলিশ মাছ আহরণ করা হয়। এটি সামুদ্রিক মাছ কিন্তু বড় নদীতে ডিম দেয় এই মাছ। ডিম ফুটে গেলে ও বাচ্চা বড় হলে ইলিশ মাছ সাগরে ফিরে যায়। ভৌগলিকভাবেই পশ্চিমবঙ্গের জনগণ ইলিশের জন্য বাংলাদেশের উপর নির্ভরশীল।

ফলে, ভারত প্রায় শতভাগ ইলিশ বাংলাদেশ থেকেই আমদানি করে থাকে। এদিকে আমাদের সরকার অধিক মুনাফার আশায় দেশের চাহিদার থেকে রফতানিতেই বেশি মনোযোগ দিয়ে থাকে। যা দেশের বাজারে ইলিশের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে।

দুই. ডিম ফুটে বাচ্চা বের হওয়া থেকে ছোট ইলিশ মাছকে বেড়ে ওঠার সুযোগ দিতে পদ্ম, মেঘনা, যমুনা, কালাবদর, তেঁতুলিয়া নদীসহ বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে ৩৯২ কিলোমিটার জলসীমায় মাছের পাঁচ অভয়াশ্রমে সারাবছর বিভিন্ন মেয়াদে মাছ ধরায় ও বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়ে থাকে। ফলে, নিষেধাজ্ঞা আরোপিত সময়ে স্বাভাবিক মাছ আহরণ বন্ধ থাকায় বাজারে ইলিশের দাম বৃদ্ধি পায়।

আরও পড়ুন: সবজি খাওয়াটাও বিলাসিতা!

উল্লেখ্য, নদীতে মাছ বেড়ে ওঠার জন্য যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়; তা দেশের সাধারণ জনগণের চাহিদা মেটানোর থেকে বিদেশে ইলিশ রফতানিকেই বেশি উৎসাহিত করে।

তিন. পহেলা বৈশাখসহ দেশের বিভিন্ন উৎসবকে ঘিরে এবং মাছ আহরণ-বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা চলাকালীন সময়ে পুঁজিবাদী গোষ্ঠী সিন্ডিকেট করে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরী করে। এতে দেশের বাজারে অস্বাভাবিক দাম বেড়ে যায়। ফলে ইলিশ পাতে তোলা তো দূরের কথা এ মাছ সাধারণ জনগণের হাতের নাগালের বাইরেই থেকে যায়।

মানুষ সামাজিক জীব সে একা চলতে পারেনা। মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত প্রাণের প্রকাশ হচ্ছে ‘উৎসব’। যা কখনো একা একা হয় না বা করা যায় না। উৎসব একটা সম্মিলিত অংশগ্রহণের মাধ্যমেই ঘটে থাকে। যারা উৎসব করে তারা একই ধরনের বিষয়ে আনন্দিত হয়, সাধারণ কিছু আচরণ, রীতি তৈরি করে।

পহেলা বৈশাখ বাংলাদেশে গ্রামেগঞ্জে মেলা আর হালখাতার উৎসব হিসেবে বহুকাল থেকেই পালিত হয়ে আসছে। পাহাড়ে এর নাম বৈসাবি। বাংলাদেশ হওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় বর্ষবরণের শোভাযাত্রা একে নতুন রূপ দিয়েছে।

আরও পড়ুন: তরুণ সমাজের কাছে অজানা ২১ ফেব্রুয়ারি

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো, গ্রাম হচ্ছে এই উৎসবের সূতিকাগার অথচ এই উৎসব ক্রমশ ক্ষীণ হতে-হতে হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। নিশ্চয়ই-এর একটি বড় কারণ গ্রামীণ অর্থনীতির রক্তশূন্যতা।

অর্থাৎ যে জাতীয় বিকাশ আমাদের হচ্ছে সেখানে বাদ পড়ে যাচ্ছে এই সংস্কৃতির উৎস গ্রামীণসমাজ। মনে রাখতে হবে, জাতীয় সংস্কৃতি গড়তে জাতীয় উৎসবের গুরুত্ব অপরীসীম। কিন্তু তাই বলে সংস্কৃতির উৎস গ্রামীণসমাজ কোনোভাবেই যেনো বাদ না পড়ে। সেই উৎসবে গ্রাম থেকে শহর সর্বত্রই সমসত্বা না হোক সামঞ্জস্যতা প্রয়োজন। বৈষম্য নয়, এ ক্ষেত্রে গ্রামের ওপর শুধু দায় চাপিয়ে দিলে হবে না; শাসক দেবালয় শহরকেই তার দায় নিতেই হবে। সর্বজনীন, অসাম্প্রদায়িক উৎসব হিসেবে পহেলা বৈশাখের চেয়ে ভালো বিকল্প নেই।

আরও পড়ুন: অমর একুশের চেতনা ও আজকের বাস্তবতা

বিভেদ-বৈষম্য মানুষের মধ্যের সৃজনশীলতাকে বাধাগ্রস্থ করে। লোভ-ক্ষোভ-অভিমান মানুষের চিন্তা- চেতনাকে পঙ্গু করে দেয়। তাই শুধু পান্তা ইলিশ নয়, বাঙালি জাতির প্রকৃত ইতিহাস-ঐতিহ্য সংস্কৃতিকে শহর-নগর গ্রামে-গঞ্জে সমভাবে ধারণ করতে হবে। আগে ব্যক্তি, পরিবার দেশ ও জাতিকে গুরুত্ব দিতে হবে।

পহেলা বৈশাখে ইলিশ মাছ বাঙালির পাতে সোনার হরিণ না হয়ে অধিকারের পাতায় সুষমভাবে বন্টিত হোক। পরিশেষে ১৪৩১ বঙ্গাব্দ নব চেতনায় উদীপ্ত হয়ে মানব প্রাণ করে তুলুক আলোকিত, করে তুলুক ভালোবাসাময়-সেটাই প্রত্যাশা।

লেখক:

স্টাফ রিপোর্টার, দৈনিক আমার বাঙলা

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

রাজধানীতে স্বস্তির বৃষ্টি

নিজস্ব প্রতিবেদক: টানা একমাস দাবদ...

মিল্টন সমাদ্দার রিমান্ডে

নিজস্ব প্রতিবেদক: মৃত্যুর জাল সনদ তৈরির অভিযোগে প্রতারণা ও জ...

আমিরাতে প্রবল বৃষ্টিপাত, সতর্কতা জারি

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: প্রবল বৃষ্টিপা...

লিওনার্দো দা ভিঞ্চি’র প্রয়াণ

সান নিউজ ডেস্ক: আজকের ঘটনা কাল অতীত। প্রত্যেকটি অতীত সময়ের স...

ভরিতে ১৮৭৮ টাকা কমলো স্বর্ণের দাম 

নিজস্ব প্রতিবেদক: টানা অষ্টমবারের...

পানিতে ডুবে প্রাণ গেল ভাই-বোনের

জেলা প্রতিনিধি : মুন্সীগঞ্জের সদরে পুকুরের পানিতে ডুবে দুই ভ...

তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকার আভাস

নিজস্ব প্রতিবেদক : ঢাকাসহ বিভিন্ন বিভাগের ওপর দিয়ে যে তাপপ্র...

বৃষ্টিতে বন্ধ খেলা

স্পোর্টস ডেস্ক : বাংলাদেশ ও জিম্বাবুয়ের মধ্যকার প্রথম টি-টোয়...

রাজধানীতে বাসের ধাক্কায় নিহত ১

নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজধানীর বকশিবাজারে বাসের ধাক্কায় আনোয়ার...

বাস-ট্রাক সংঘর্ষে আহত ৮

জেলা প্রতিনিধি : রাজবাড়ীর পাংশায় বাস ও ট্রাকের সংঘর্ষে ৮ যাত...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা