মতামত

শিল্পায়নের মূল নির্ভরশীলতার জায়গা হবে এসএমই খাত

ড. নাজনীন আহমেদ: দেশে গত ১০-১৫ বছরে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের প্রতি যথেষ্ট মনোযোগ তৈরি হয়েছে। এখন সময় এসেছে এটাকে পরবর্তী ধাপে নিয়ে যাওয়ার। এত দিনে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের (এসএমই) সমস্যাগুলো মোটামুটি আমরা জানি। সমস্যাগুলো সমাধান করা হলে এই খাত আরো দ্রুত বিকশিত হবে।

দেশের শিল্প খাতের ৯৯ শতাংশই হচ্ছে কুটির, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (সিএমএসএমই)। এর মধ্যে শুধু ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) প্রায় ১৫ শতাংশ। শিল্প খাতে উদ্যোক্তার বিচারে এসএমই খাতই অন্যতম মূল চালিকাশক্তি। কাজেই এসএমই খাতকে ঘিরেই আমাদের উন্নয়ন হতে হবে। আমরা যদি শিল্পায়নের মাধ্যমে সুষম উন্নয়ন চাই, দেশব্যাপী উন্নয়ন চাই, তাহলে আমাদের মূল নির্ভরশীলতার জায়গা হতে হবে এসএমই খাত। কারণ এসএমই খাত যখন অগ্রসর হয় তখন গ্রাম, শহর—বিভিন্ন দিকে এর সুফল ছড়িয়ে পড়ে। বড় ও মাঝারি শিল্পের পরিকল্পনাগুলো যদি এসএমই খাতকে ঘিরে করতে পারি তাহলে শিল্প উৎপাদন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি তথা অর্থনীতির ভিত্তি মজবুত করতেও এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

বর্তমানে সরকারের শিল্পনীতি, রপ্তানিনীতিসহ প্রায় সব ক্ষেত্রেই বলা আছে, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা প্রাধান্য পাবে। এটা ঠিক আছে। কিন্তু আমি মনে করি, অতিক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদেরও মাঝারি উদ্যোক্তাদের থেকে আলাদা করে আরো বেশি সুবিধা দেওয়া উচিত। কারণ মাঝারি উদ্যোক্তারাও ক্ষেত্রবিশেষে আসলে বড়। অতিক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের আলাদা করে সরকারের নীতিতে না রাখলে তারা ব্যাপকভাবে বঞ্চিত হবে।

বিভিন্ন শিল্পের মধ্যে যারা অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা আছে, তারা বড় উদ্যোক্তাদের মতো কোনো সুযোগ-সুবিধা পায় না। বড় উদ্যোক্তারা অতি সহজেই ব্যাংকঋণ, রপ্তানি সুবিধা ইত্যাদি পায়, কিন্তু বিভিন্ন খাতের অতিক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা বঞ্চিত হয়। অথচ সুযোগ-সুবিধা পেলে তারা হয়তো মাঝারি বা বড় উদ্যোক্তার মতো সাফল্য এনে দিতে পারবে।

দেশের প্রতিটি খাতেই ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা রয়েছে। শিল্পভেদে ক্ষুদ্র উদ্যোগগুলোর সমস্যা ভিন্ন রকম। সব ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার সর্বজনীন সমস্যার মধ্যে অন্যতম ব্যাংকের ঋণপ্রাপ্তি ও ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করতে সমস্যা। অনেক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা কাঁচামালের সমস্যায় ভোগে। বড় উদ্যোক্তাদের মতো তারা একসঙ্গে অনেক বেশি পরিমাণে কাঁচামাল কিনতে পারে না অর্থাভাবে। তাদের উৎপাদন কম, তাই কাঁচামালের চাহিদাও কম। কিন্তু যদি তারা সহজ শর্তে ঋণ পায় তাহলে একসঙ্গে বেশি কাঁচামাল কিনলে উৎপাদন খরচ কম পড়বে, বিক্রয়মূল্যও কমবে। প্রতিযোগিতায় সে টিকে থাকতে পারবে।

বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু নিয়ম করেছে, রি-ফিন্যান্সিং স্কিমের আওতায় ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের নানা রকমভাবে ঋণ সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর আগ্রহ, নজরদারি কম। বাণিজ্যিক ব্যাংক লাভ বা মুনাফার জন্য কাজ করে। ফলে তাদের দিক থেকে এসএমই উদ্যোক্তাদের প্রতি এক ধরনের অমনোযোগ থাকে। অথচ এসএমই উদ্যোক্তাদের পণ্য বিক্রয় ও রপ্তানিতে সহযোগিতা দিলে ব্যাংকগুলোও লাভ পেত।

ব্যাংকগুলো সাধারণত বড় উদ্যোক্তাদের পছন্দ করে। ১০ লাখ টাকার লোন দিতে তাদের যে পরিশ্রম করতে হয়, ১০ কোটি টাকার লোন দিতে প্রায় কাছাকাছি পরিশ্রম করতে হয়। ১০ কোটিতে লাভের পরিমাণ বেশি। এখন বিভিন্ন অনলাইনব্যবস্থার মাধ্যমে যদি ঋণ গ্রহণের প্রক্রিয়া সহজ করা যায় তাহলে কোটি টাকা বিনিয়োগ করে মুনাফা তুলে আনা সম্ভব হবে। কারণ এখানে লোনের পরিমাণ কম হলেও গ্রহীতার সংখ্যা অনেক বেশি।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে এমন করতে হবে, যাতে নির্দিষ্ট শিক্ষার্থীরা আগেই ভাববে যে আমরা শিল্প খাতের কর্মী হব, তারা যেন সেই শিক্ষাটি স্কুল-কলেজের মধ্যেই পেয়ে যায়। যেসব খাত সম্ভাবনাময় সেগুলোর জন্য সরকার বিশেষ প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। যারা বেসরকারিভাবে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে তাদের তথ্যও জানাতে হবে। কারণ একজন দক্ষ কর্মীও খোঁজে আমি কিভাবে কোথায় ভালো চাকরি পাব। তাই সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রশিক্ষণ সেন্টারগুলোও যাতে যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ দেয়, সেটি মনিটর করার বিষয়ে সরকারকে জোর দিতে হবে।

কয়েক বছর ধরে আমরা দেখছি, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে প্রচারণা ও বিপণনের কাজটি করছে। এটি শহরাঞ্চলে করা সহজ, কিন্তু গ্রামাঞ্চল থেকে শহরে বা শহর থেকে মফস্বলে ডেলিভারি দিতে গেলে খরচ বেড়ে যায়। ডেলিভারি সার্ভিসের ক্ষেত্রে খরচটা কম হলে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য ব্যবসার প্রসার ঘটানো অনেক সহজ হবে।

আরেকটি বিষয়, যারা ই-কমার্সের সঙ্গে জড়িত, তাদের মধ্যে অনেক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ব্যবসা বড় করার জন্য ঋণ নিতে পারে না। কারণ ফেসবুকের উদ্যোগ রেজিস্টার্ড বিজনেস হিসেবে গণ্য হয় না। রেজিস্টার্ড বিজনেস করলে ট্যাক্সের প্রশ্ন আসে। অনেকে সেটায়ও যেতে চায় না। তাই প্রথম কয়েক বছর ট্যাক্স ফ্রি সুবিধা দিয়ে যদি সহজ একটি ব্যবস্থা করা যেত তাহলে ক্ষুদ্র উদ্যোগগুলো আরো বড় করা সম্ভব হতো।

মার্কেটিং চ্যানেল বাড়ানোর জন্য ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের অবশ্যই প্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত থাকতে হবে। অনেক ছোট উদ্যোক্তার স্মার্টফোনও নেই। আবার অনেকের ফোন থাকলেও সেটি সঠিকভাবে ব্যবহার করতে জানে না। এ জন্য ফেসবুক পেজ বা স্মার্টফোন চালানোর বিষয়েও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ দরকার আছে বলে মনে করি।

বিপণনে সবচেয়ে বড় জায়গা মার্কেট ইনফরমেশন। কোন জায়গায় কোন পণ্যের চাহিদা আছে, এই তথ্যগুলো জানা থাকা দরকার। তাহলে ব্যবসা বড় হবে। বিভিন্ন জায়গায় দু-একটি জয়িতা করলেই হবে না। আমি মনে করি, জয়িতার ভার্চুয়াল প্ল্যাটফরম করা উচিত। কারণ আমাদের দেশে স্থানের স্বল্পতা আছে, বিভিন্ন জায়গায় সেলস সেন্টার করার জায়গা নেই। অনলাইনে আলিবাবা, অ্যামাজন যেমন মার্কেটপ্লেস, সে রকম ভার্চুয়ালি জয়িতাও করা যায়।

বাংলাদেশ এখন শিল্পনির্ভর ও সেবানির্ভর শিল্পের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বের হয়ে যাচ্ছে দরিদ্র দেশের তালিকা থেকে। ২০২৬ সালে যখন দরিদ্র দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে যাবে তখন বাংলাদেশকে আরো প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকতে হবে। দরিদ্র দেশ হিসেবে পাওয়া সুবিধা আর থাকবে না। তখন শুধু বড় শিল্প ও সেবা খাত দিয়ে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকা মুশকিল হবে। ক্ষুদ্র, অতিক্ষুদ্র যে উদ্যোগগুলো আছে সে জায়গাগুলো নিয়েই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। তাই এখনই ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগগুলোর ভিত্তিগুলো শক্তিশালী করতে হবে।

লেখক: কান্ট্রি ইকোনমিস্ট, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি)

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

ভোলায় ছাত্রলীগের বৃক্ষরোপন কর্মসূচি পালিত 

ভোলা প্রতিনিধি: তীব্র তাপদাহ থেকে...

আড়িয়ল ইউপিতে উপ-নির্বাচন

মো. নাজির হোসেন, মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি:

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি দিবস

সান নিউজ ডেস্ক: আজকের ঘটনা কাল অতীত। প্রত্যেকটি অতীত সময়ের স...

খাগড়াছড়িতে গৃহকর্মীকে জিম্মির অভিযোগ 

আবু রাসেল সুমন, খাগড়াছড়ি প্রতিনিধিঃ

কার্বণ মিল ও সীসা কারখানা বন্ধের দাবিতে মানববন্ধন

কামরুল সিকদার, বোয়ালমারী প্রতিনিধি:

অনির্দিষ্টকালের জন্য চুয়েট বন্ধ ঘোষণা

নিজস্ব প্রতিবেদক: বাস চাপায় চুয়েট...

রাজধানীতে শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা

নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজধানীর শাঁখা...

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাড়ছে না ছুটি

নিজস্ব প্রতিবেদক : আবহাওয়া অধিদপ্...

আবারও কমলো স্বর্ণের দাম

নিজস্ব প্রতিবেদক : চলতি মাসে তিন...

রংপুরে বৃষ্টির জন্য ইস্তিসকার নামাজ আদায়

রংপুর প্রতিনিধি : সারাদেশের মতো র...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা