শিল্প ও সাহিত্য

ত্রিভূজ প্রেমের আখ্যান চোখের বালি

নৌশিন আহম্মেদ মনিরা

রবীন্দ্রনাথের চতুর্থ উপন্যাস 'চোখের বালি'। এর প্রথম চারটি পরিচ্ছেদ প্রকাশিত হয় বঙ্কিমচন্দ্র সম্পাদিত 'বঙ্গদর্শন' পত্রিকার প্রথম সংখ্যায়। প্রকাশকাল ১৩০৮ বঙ্গাব্দের ১লা জৈষ্ঠ ইংরেজী ১৫মে ১৯০১ এবং ১৯০২ পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। উপন্যাসটির প্রথম নাম ছিলো 'বিনোদিনী'। বঙ্গদর্শনে প্রকাশের সময় এর নাম দেয়া হয় 'চোখের বালি' এবং 'চোখের বালি' নামকরণটিই শেষ পর্যন্ত টিকে যায়।

একাধিক ভাষায় প্রকাশিত হয় 'চোখের বালি' উপন্যাসটি। ১৯৫৯ সালে রুশ ভাষায়, ১৯৬১ সালে চীনা ভাষায়, ১৯৬৮ সালে জার্মান ভাষায়। তাছাড়া ভারতের বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায়েও অনূদিত হয় উপন্যাসটি।
এছাড়া এ উপন্যাস অবলম্বনে দুটি চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে, যা যথাক্রমে ১৯৩৮ ইং এবং ২০০৩ ইং সালে মুক্তি পায়।

সংক্ষিপ্ত পটভূমি:

গল্পের শুরু হয়েছে, গল্পের নায়ক মহেন্দ্র ও তার মা রাজলক্ষীর কথোপকথনের মাধ্যমে। তার মায়ের ছোটবেলার বান্ধবী হরিমতির মেয়ে বিনোদিনীকে পুত্রবধূ হিসেবে ঘরে তুলতে চায় তার মা। কিন্তু মাতৃস্নেহ হারানোর দোহাই দিয়ে সে প্রস্তাব প্রত্যাখান করে। মায়ের প্রতি ছেলের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে এ বিষয়ে বেশিদূর এগুতে পারেনি রাজলক্ষী। অবশেষে অন্যত্র বিয়ে হল বিনোদিনীর এবং অনতিকাল পরেই বিধবা হতে হল।

তিন বছর পর, মা এবার তার ছেলের বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। এবারও মহেন্দ্র পুরনো অজুহাত দেখায়। ওদিকে, মহেন্দ্রের কাকী অন্নপূর্ণা, স্বামী-সন্তানহীনা এ মহিলাটি মহেন্দ্রকে নিজের সন্তানের মত স্নেহ করতো। অন্নপূর্ণার পিতৃমাতৃহীনা এক বোনঝি আশালতা'র সাথে মহেন্দ্রের বিয়ের ইচ্ছা পোষণ করলেও প্রত্যাখিত হওয়ার আশংকায় তা প্রকাশ করতো না, মহেন্দ্র এ ব্যাপারটি ঠিকই অনুধাবন করতো।

অবশেষে মহেন্দ্রের চেষ্টায় তারই বন্ধু বিহারীর সাথে বিয়ে ঠিক করে মেয়ে দেখার জন্য কাকীকে প্রস্তাব করে সে। বিহারী মহেন্দ্রের বন্ধু হলেও মা-কাকীর স্নেহের পাত্র ছিল সবসময়। অতঃপর আশালতাকে দেখতে গিয়ে মহেন্দ্র নিজেই বিয়ের জন্য মনস্থির করে এবং শেষ পর্যন্ত নানা বাধার পরও নিজেই আশালতাকে বিয়ে করে।

শুরু হয় মহেন্দ্র-আশার নতুন জীবন। সমাজ সংসারকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে থাকে দুজনের প্রণয় লীলা। দিন দিন ছেলের উপর কর্তৃত্ব হারাতে থাকে মা। এসব নিয়েই অন্নপূর্ণা ও রাজলক্ষীর মধ্যে মনোমালিন্য শুরু হয়। ফলাফল স্বরূপ, অন্নপূর্ণা বাড়ি ছেড়ে কাশিতে চলে যায় ধর্ম পালনের দোহাই দিয়ে। একপর্যায়ে মায়ের উপর ছেলের ভালোবাসা পরীক্ষা করতে রাজলক্ষীও চলে যায় গ্রামের বাড়ি। ফিরে আসার সময় সঙ্গে নিয়ে আসে সেই বিনোদিনীকে।

অল্পদিনের মধ্যেই বিনোদিনী সংসারের সকলকে আপন করে নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। রাজলক্ষী তার কর্তব্যবুদ্ধি ও সেবায় মুগ্ধ হলেন। আশালতার সাথে আবদ্ধ হয় সখীত্ব স্থাপনের মাধ্যমে এবং মহেন্দ্রের সাথে পরিচিত হয়ে তাকেও আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয় বিনোদিনী।

ঘটনার ক্রমগতিতে মহেন্দ্র গোপন কলঙ্কময় আকর্ষণে বিনোদিনীর প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়ে। এরই মাঝে বিহারী মাঝে মধ্যে উপস্থিত হয়ে কখনো কটাক্ষের বাণে বিদ্ধ করতে চেয়েছে, আবার কখনো মর্ত্যবাসিনী দেবী বলে শ্রদ্ধা ভক্তি দেখিয়েছেন। নারী প্রকৃতির শুভ চেতনায় বিনোদিনী মহেন্দ্রের গোপন আকর্ষণের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে অন্তরের মধ্যে বিহারীর প্রতি ধীরে ধীরে গভীর ভালোবাসা অনুভব করতে থাকে।

কিন্তু মানুষের চাওয়া পাওয়ার সাথে প্রাপ্তির মেলবন্ধন সবসময় হয়ে উঠেনা। ভুল বোঝাবুঝিতে বিনোদিনীর ভালোবাসাকে প্রত্যাখান করে বিহারী। বিহারীর প্রত্যাখান বিনোদিনীকে প্রতিহিংসায় উন্মুক্ত করে তুলল। সম্ভাব্য দুর্যোগ থেকে আশালতাকে বাঁচাবার আপ্রাণ চেষ্টা এবং মহেন্দ্রের মুখে আশার প্রতি বিহারীর দূর্বলতার প্রসঙ্গ শুনে বিনোদিনী সরলা আশালতার সংসার জ্বালিয়ে দেওয়ার জন্য উদ্ধত হয়। উপায় না দেখে মহেন্দ্রের সাথে মিথ্যা ভালোবাসার অভিনয়কে তীব্র করে তুলল সে।

এভাবেই ত্রিভূজ প্রেমের এই সমীকরন ক্রমশই জটিল আকার ধারণ করতে থাকলো। বারবার ঝড়ের কবলে পড়তে থাকে একসময়ের গোছানো, স্নেহ-ভালোবাসায় পূর্ণ পরিবারটি।
শেষ পর্যন্ত কি হয়েছিল?

অভিনয় করতে করতে কি ধর্ম সংস্কার পেছনে ফেলে মহেন্দ্রের প্রতিই অনুরক্ত হয়ে পড়ে বিনোদিনী? নাকি বিহারীর ভুল ভাঙাতে সক্ষম হয়েছিল সে? নাকি ঘটেছিল অন্যকিছু? বাকিটুকু জানতে পড়তে পারেন ‘চোখের বালি’ উপন্যাসটি।

কবির সংক্ষিপ্ত পরিচিতি:
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে নতুন করে কী আর বলব। রবীন্দ্রনাথের কাব্যচর্চা আরম্ভ হয় আট বৎসর বয়স থেকে। তের বছর বয়সে তার লেখা প্রকাশ পেতে থাকে পত্রিকায়। আর শেষ লেখা বলতে তার মৃত্যুর আটদিন আগ পর্যন্ত। তিনি বাহাত্তুর বৎসর সময় পেয়েছিলেন সাহিত্য সাধনার।

এ সময়ে তিনি অভূতপূর্ব অবদান রেখেছিলেন সাহিত্য রচনায়। বলা যায় বিশ্বজগতে তার এই অবদানের বিষয়টি অতুলনীয়। তার জীবনে তিনি ২৫০০ গান, ১১৯টি ছোট গল্প, ১৩টি উপন্যাস, ৫০টি নাটক, ৯টি ভ্রমণ-কাহিনী, অসংখ্য চিঠিপত্র লিখেছিলেন এবং ২ হাজারের মতো ছবিও এঁকেছিলেন।

পুনশ্চ:
উপন্যাসের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য হলো তদানীন্তন সমাজের কুসংস্কার মুক্তির সংগ্রাম। বিনোদিনী বিধবা হয়েও স্বাধীন সংস্কার মুক্ত জীবনবোধ লালন করে। সে সমাজ আরোপিত বিধি-বিধান কিংবা রীতিনীতি আরোপিত কঠোর সংযম মেনে চলতে চায়না।

উপন্যাসটি এক অর্থে পারিবারিক। পরিবারের সদস্যদের নানাবিধ মানসিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, দ্বন্দ্ব-কলহজানিত সমস্যা কিংবা প্রেম-বিরহজনিত ঘটনা-কাহিনি বা মনস্তাত্ত্বিক কাহিনি ছাড়া উপন্যাসটিতে আর কিছুর তাৎপর্য তেমনভাবে পরিস্ফুটিত হয়নি। যদিও পরিবার সমাজেরই অংশবিশেষ, তবুও সেখানে সমাজিক বিষয়টি গভীরভাবে প্রাধান্য বিস্তার করে শ্রেণী দ্বন্দ্ব বাধায়নি বাইরে থেকে।
মূলত, সমস্যার কার্যকারণে মহেন্দ্রের অবাধ যৌবনাবেগ ও মোহকে ক্রিয়াশীল বলে পরিলক্ষিত হয়। এই মোহগ্রস্ততাই মহেন্দ্রকে বোধহীন, দায়িত্বহীন ও মাতৃবিমুখ করেছে। আর বিনোদিনীকে করেছে প্রতিশোধাকাঙ্ক্ষী মনস্তাত্ত্বিক শত্রু। বিনোদিনী মহেন্দ্রের উপেক্ষার প্রতিশোধ নিতে গিয়ে হয়েছে নিপুণ কৌশলী।

উপন্যাসের সার্থকতা:
উপন্যাসে সামাজিক সার্থকতা বিচার করতে হলে কতকগুলো দ্বন্দ্ব, সমাজ বাস্তবতা সমসাময়িক সমাজের নিরিখে পটভূমি নির্বাচন, যুগচিত্ত অংকন, লেখকের উদ্দেশ্যের প্রতিফলন সুদৃঢ় অচ্ছেদ্য কার্যকারণ-শৃঙ্খলা, ভাষাশৈলী নির্মাণ তথা যথার্থ কথোপকথন বা স্বাভাবিক সংলাপ সংযোজন ইত্যাদি। অতএব শ্রেষ্ঠ উপন্যাস বলতে যা বুঝায় তাতে থাকে আখ্যান ভাগ, চরিত্র-চিত্রণ, পরিবেশ-কল্পনা ও বাণীভঙ্গির সুসম্বন্ধ রূপশিল্প। তবে এই শ্রেষ্ঠত্বকে আরো গভীর করে লেখকের জীবনদর্শন, যুগ-মানস-পিপাসা, জীবনজিজ্ঞাসা তথা জীবনের রহস্য উদঘাটনের অকুণ্ঠ প্রচেষ্টা।

পরামর্শ: যারা এই উপন্যাসটা পড়েননি তারা অতিশীঘ্রই এটা পড়ে ফেলুন। নর-নারী, যুবক-যুবতী, বিবাহিত অবিবাহিত, যারা নতুন বিবাহ করেছেন, যাদের বিবাহ পুরাতন হয়েছে, যাদের প্রেমে ভাটা পড়ছে, যারা স্ত্রীকে মনের মতো করতে চান, যারা সুখের দাম্পত্য প্রেম চান, তারা 'চোখের বালি' নিশ্চয়ই পড়বেন।

লেখক : সাংবাদিক

সান নিউজ/এনএএম/এমএম

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

আড়িয়ল ইউপিতে উপ-নির্বাচন

মো. নাজির হোসেন, মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি:

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি দিবস

সান নিউজ ডেস্ক: আজকের ঘটনা কাল অতীত। প্রত্যেকটি অতীত সময়ের স...

ভোলায় ছাত্রলীগের বৃক্ষরোপন কর্মসূচি পালিত 

ভোলা প্রতিনিধি: তীব্র তাপদাহ থেকে...

খাগড়াছড়িতে গৃহকর্মীকে জিম্মির অভিযোগ 

আবু রাসেল সুমন, খাগড়াছড়ি প্রতিনিধিঃ

কার্বণ মিল ও সীসা কারখানা বন্ধের দাবিতে মানববন্ধন

কামরুল সিকদার, বোয়ালমারী প্রতিনিধি:

অনির্দিষ্টকালের জন্য চুয়েট বন্ধ ঘোষণা

নিজস্ব প্রতিবেদক: বাস চাপায় চুয়েট...

রাজধানীতে শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা

নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজধানীর শাঁখা...

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাড়ছে না ছুটি

নিজস্ব প্রতিবেদক : আবহাওয়া অধিদপ্...

আবারও কমলো স্বর্ণের দাম

নিজস্ব প্রতিবেদক : চলতি মাসে তিন...

রংপুরে বৃষ্টির জন্য ইস্তিসকার নামাজ আদায়

রংপুর প্রতিনিধি : সারাদেশের মতো র...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা