শিল্প ও সাহিত্য

শহীদুল্লা কায়সারের অমর কীর্তিগাথা ‘সংশপ্তক’ 

নৌশিন আহমেদ মনিরা: বাংলা সাহিত্যে ‘সংশপ্তক’ উপন্যাসটি শহীদুল্লা কায়সারের এক অমর কীর্তিগাথা। তিনি পেশায় ছিলেন সাংবাদিক । বামপন্থী রাজনীতিতেও ছিলেন সক্রিয়। তবে, তার সাহিত্যিক খ্যাতি সবকিছুকে ছাড়িয়ে তাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে বোধি পাঠকের হৃদয়-মনিকোঠায়।

‘সংশপ্তক’ এর মতো কালজয়ী উপন্যাসের স্রষ্টা শহীদুল্লা কায়সারের জন্ম ১৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯২৬ সালে ফেনী জেলার মজুপুর গ্রামে। পুরো নাম আবু নঈম মোহাম্মদ শহীদুল্লা।

তিনি ছিলেন ভাষা আন্দোলনের একজন নেপথ্য নায়ক এবং শ্রমিক-জনতার নিপুন চিত্রকর। বাঙালী জীবনের দুঃখ ও সংগ্রামের চিত্র তার উপন্যাসের উপজীব্য বিষয়। তাই তিনি তার লেখনীতে এই মেহনতি মানুষগুলোর পক্ষে কলম ধরেছিলেন কারান্তরীণ থাকাকালেই এবং লিখে গেছেন ১৯৭১ সালের বিজয়ের সূর্য উদিত হওয়ার কিছু সময় আগে আলবদর বাহিনীর হাতে নিখোঁজ হওয়ার আগ মুহুর্ত পর্যন্ত।

রাজনৈতিক পটভূমিতে রচিত এদেশের হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলিত জীবন নিয়ে এবং অসাম্প্রদায়িক জীবনবোধে অনুপ্রাণিত সার্থক সৃষ্টি ‘সংশপ্তক’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট নির্মাণে শহীদ সাহিত্যিক যে নৈপুন্য প্রদর্শন করেছেন তা আমাদের দেশে একান্তই দুর্লভ।

গ্রন্থখানিতে আছে মহাকাব্যিক ব্যপ্তি, আছে প্রসারতা। ‘সংশপ্তক’ উপন্যাসের দীর্ঘ আয়তনে ধরা পড়েছে বহু চরিত্র- সকলের উপর জেগে আছে পুরুষ-শাসিত মুসলিম সমাজে নারীর বিদ্রোহ।

সংক্ষিপ্ত পটভূমি:
উপন্যাসের সূচনা হয়েছে মূলত তিনটি অশ্লীল গালি দিয়ে যেখানে হুরমতি নামের এক নারীকে লাঞ্ছনা করা হয়। ব্যাভিচারিণী হুরমতির কপালে আগুনে তাঁতানো পয়সাটা দিয়ে ছেঁকা দেবার যে বর্বর নিষ্ঠুর দৃশ্যটি দিয়ে উপন্যাসের শুরু, সেখানেই নারীর বিদ্রোহের ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

উপন্যাসের নায়ক জাহেদ একজন বিপ্লবী। আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষাপ্রাপ্ত টগবগে যুবক। মানুষ মাত্রই তার ভালবাসার পাত্র। মূলত জহেদ চরিত্রটি লেখকেরই প্রতিচ্ছায়া। স্কুল মাস্টার সেকান্দার, পতিতা হুরমতি, চাষী লেকু- সবাই তার স্নেহ ও ভালবাসা পায়। জাহেদ মানষের প্রতি আশাবাদী এবং আশাবাদী তার জীবনের প্রতিও। চরম বিপদের সময়েও তার বিপ্লবী সত্তার প্রকাশ ঘটেছে। তাই তাকে গ্রেপ্তার করার সময়ও বলতে শোনা যায়- 'চিন্তা করিস নে রা’বু আমি ফিরে আসব, আমি আসব'।

এই উপন্যাসের একটি উল্লেখযোগ্য চরিত্র হচ্ছে রাবু। সে বিবাহিতা, অতীতকে অস্বীকার করে বিপ্লবী জাহেদের সঙ্গে সমাজ সেবায় ব্রতী হয়। জাহেদকে সে ভালবাসে। রাজনৈতিক মুক্তি পথের পথিক রাবু। সেকান্দার মাস্টারও দেশের স্বাধীনতা-সংগ্রামের একজন নিবেদিত কর্মী।

সমগ্র উপন্যাসের কেন্দ্রে আছে দুটি গ্রাম- বাকুলিয়া ও তালতলি। এখান থেকে ঘটনা কলকাতা, ঢাকা পরিক্রম করেছে। জাহেদ, রাবু, ফেলু, মালু, রমজান, সেকান্দার মাস্টার, হুরমতি, লেকু- এদের চরিত্র চিত্রণে লেখকের বাস্তব অভিজ্ঞতার প্রতিফলন ঘটেছে। এই চরিত্রগুলোর গল্পের শেষ নেই।

তালতলির গল্প, বাকুলিয়ার গল্প, যুদ্ধের গল্প, দুর্ভিক্ষের গল্প, দাঙ্গার গল্প, ইংরেজ চলে যাবার গল্প, রমজানের মতো যারা এই দেশটাকে ভোজভাজি দেখাল তাদের গল্প, ভিটেহারাদের গল্প, সব মিলিয়ে ওদের নিজেদের গল্প। ওদের এক একটি জীবন অসংখ্য কাহিনী।

আসলে ‘সংশপ্তক’ বাংলাদেশের ক্ষয়িষ্ণু গ্রামীণ জীবনের সামন্ত প্রভূদের অত্যাচার আর তার মধ্য থেকে সাধারণ মানুষের বাঁচার লড়াইয়ের এক মনোজ্ঞ পাঁচালি।

পুনশ্চ:
‘সংশপ্তক’ বিগত যুগের কাহিনী, এ যুগের দর্পন, ভাবীকালের কল্লোল। সংঘাতে বেদনায় ক্ষুব্ধ যে কাল সে কালের মানুষ দরবেশ, ফেলু মিঞা, জাহেদ, সেকান্দার মাস্টার, রামদয়াল, অশোক, রমজান আর মোজাদ্দী সাহেব। জীবনসংগ্রামে যারা আজও হাল ছাড়েনি তাদেরই প্রতিভূ লেকু-কসির-হুরমতি। আর যারা ধরা পড়েছে যুগের দর্পণে, হার মেনেছে জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে অথবা ভাস্কর অগ্নিঝলকে, সেই রাবু, আরিফা, রানু, রিহানা কিংবা মালু, এরা সবাই মুখর ক্রান্তিলগ্নের উত্তান-পতনে, জীবনে জিজ্ঞাসার যন্ত্রণায়।

যুগধারার ত্রিবেণী সঙ্গমে এই নায়ক-নায়িকারা কেউ অসাধারণত্বের দাবিদার নয় কিন্তু এরা সবাই অনন্যসাধারণ। এরা ইতিহাস। সারেং বৌ এবং রাজবন্দীর রোজনামচা ইতিমধ্যেই শহীদুল্লা কায়সারকে সাহিত্য জগতে খ্যাতির আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে। লেখকের নবতম উপন্যাস ‘সংশপ্তক’ বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল কীর্তিরূপে পরিগণিত হবে, এতে কোন সন্দেহ নেই।

আমার বক্তব্য:
কোন বই পড়ে সে বইয়ের সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া আসলে খুবই আনন্দের ব্যাপার। ৪০০ পৃষ্ঠার এই বইটিতে লুকায়িত রয়েছে হিন্দু-মুসলিমের সম্মিলিত জীবন এবং অসাম্প্রদায়িক জীবনবোধে অনুপ্রাণিত সার্থকতা।

তবে কিছু কিছু শব্দগঠন, বাক্যজালে আমি আটকে গিয়েছি, আবার সেগুলো লিখেও রেখেছি। এক কথায়, অসাধারণ এ লেখার মহিমায় নিজেকে হারিয়েছি বহুবার। ২-৩ দিন সময় লেগেছে শেষ করতে। সবমিলিয়ে বইটা ভালোই লেগেছে আমার কাছে। চাইলে যে কেউ পড়তে পারেন।

লেখক: সাংবাদিক

সান নিউজ/এনএএম/এমকেএইচ

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

৪৮৪ রানে ২য় দিন শেষ করলো বাংলাদেশ

মুশফিকুর রহিম আউটের পরপরই একের পর এক উইকেট হারাতে থাকলো টাইগাররা। শেষ বিকেলে...

মুশফিক-শান্তর সেঞ্চুরি; গলে বাংলাদেশের দিন

গলে অনেক সুখস্মৃতির পাশাপাশি হতাশার রেকর্ডও আছে বাংলাদেশের। গল টেস্টের প্রথম...

এনসিপির কর্মসূচি ঘোষণা; দেশব্যাপী পালনের নির্দেশ

দেশব্যাপী পালনের জন্য এনসিপির কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। জুলাই গণহত্যার বিচার,...

রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা সখিনা বেগম আর নেই

রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা সখিনা বেগম (৯৩) আর বেঁচে নাই। মঙ্গলবার(১৭ জুন) ভোর...

বাংলাদেশের আলিফ এশিয়ান আরচ্যারির ফাইনালে

সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত এশিয়ান কাপ আরচ্যারি স্টেজ-২ টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের আলিফ...

৪৮৪ রানে ২য় দিন শেষ করলো বাংলাদেশ

মুশফিকুর রহিম আউটের পরপরই একের পর এক উইকেট হারাতে থাকলো টাইগাররা। শেষ বিকেলে...

জিআই পণ্য হাড়িভাঙ্গা আম সংগ্রহ উৎসব ২০২৫- এর উদ্বোধন

জিআই পণ্য হাড়িভাঙ্গা আম সংগ্রহ উৎসব ২০২৫ এর উদ্বোধন ও আম চাষীদের সাথে মতবিনিম...

সামরিক হস্তক্ষেপ করলে ‘অপূরণীয় ক্ষতি’ হবে যুক্তরাষ্ট্রের: খামেনি

ইরান-ইসরাইল সংঘাতে যদি যুক্তরাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করে তবে তাদের ‘অপূরণীয় ক্...

ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ আর কতদিন চলতে পারে

ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ আর কতদিন চলতে পারে। তেল আবিবের আকাশে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ঠ...

মেটার নতুন সিদ্ধান্ত; ফেসবুকে থাকছে না ভিডিও!

মেটার নতুন সিদ্ধান্ত; ফেসবুকে থাকছে না ভিডিও! ভিডিও কনটেন্টে পরিবর্তন আনছে সা...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা