শিল্প ও সাহিত্য
নির্ঝরের গল্প  

ইচ্ছাপুরণের সরল ফর্দ

এনামুল করিম নির্ঝর

ফিস্ ফাস্ আলোচনার মধ্যে তুলকালাম কিছুটা গোম্বা এবং ক্ষোভের নমুনা পরিবেশন করে ইছাক। এটা সে বরাবরই করে, অভ্যাস। হঠাৎ বৃষ্টির একখান ফোটা গাছের পাতার উপর পড়লে যেমন দুলুনি দিয়ে কাঁপতে থাকে, তেমনি ঘরের বাতাসও যেন ব্যস্ত, দরজার সন্ধানে। নাজমা বেগমের নগ্ন ঠ্যাংখানা ইছাকের শরীরের উপর এতোক্ষণ মহাদাপটে লম্বা হয়ে আয়েশ করছিল, সেটা সরিসৃপের মতো নেমে গিয়ে বস্ত্রাবৃত হয়। আচমকা ধমকের শব্দে চার বছরের দুলালের অর্থহীন কান্না আছড়ে পড়ে রাত্রির নিস্তব্ধতায়।

বিষয়টা কি? মনোয়ার এসেছিল সাঁঝরাতে সস্ত্রীক। মনোয়ারের স্ত্রী মনোয়ারা! এরকম একটা অদ্ভুত যোগাযোগের জন্য মিস্টার মনোয়ার দশ দশটা বছর দীর্ঘ সাধনায় রত ছিলেন। তার চাই মনোয়ারা নামক কনে। চাইতো চাইই-তাও আবার পিতৃপ্রদত্ত আসল নাম, নড়বড়ে চলবেনা। ৯ বছরের মাথায় এসে ব্লাডব্যাংকের অজুহাতে কনে প্রাপ্তির চমকপ্রদ ঘটনাটি ঘটে। অতঃপর শুভমিলন। সেই মনোয়ার+মনোয়ারা, জোছনা ফুটতেই চঞ্চল হয়ে ওঠা দম্পতি এসে দাঁড়ায় ইছাক সাহেবের এ্যাপার্টমেন্টের দরজায়। আচমকা সফর।

ইছাক ইদানীং অনবরত পারিবারিক পুলক অনুভব করলেও বিশাল বাণিজ্যের বহরে ভাসমান থাকে মাঝরাত অব্দি। তার কোটিপতি শরীরের প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সচল এবং সক্রিয় কমপক্ষে ২০ ঘণ্টা। অর্থ আসছে। বাড়ছে ব্যাংক ব্যালেন্স। জমি, বাড়ি, ফ্ল্যাট সবই হয়েছে। বাকী আছে শুধু ! এ জাতীয় ভাবনায় ইছাক মাঝেমাঝে আনমনা হয়ে যায়। আজ দুপুরে অফিসে বসে টাটকা বিরানি খেয়ে দু'টো লম্বা ঢেকুর তুলতেই সে সিদ্ধান্ত নেয়, স্ত্রী-পুত্রের জন্য আজ দেবে সারপ্রাইজ। সন্ধ্যায় কোনো এক রেস্তোরায় ডিনারটা সেরে নেবে। পরিকল্পনার ফলাফলঃ প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়-পরিপাটি পোশাকে।

ইছাক-ধুসর প্যান্ট, ফুলহাতা মেরুন চকচকে সার্ট।
নাজমা-জাম রঙ এর শাড়ী, হলুদ স্লীভলেস ব্লাউজ।
দুলাল-প্যান্থার জাতীয় কিছু একটা লেখা টি-শার্ট আর কালো প্যান্ট।

দরজায় হাজির মনোয়ার দম্পতি ছ’টা পঞ্চাশ মিনিটে কলিংবেল টিপে আলাপে আলাপে সুসজ্জিত লিভিংরুমে গিয়ে ঢোকে। ইছাক তখন কেবল চিরুনিটা একবার মাত্র পিছন দিকে চালিয়েছে। হঠাৎ অতিথি আগমনের খবরে তার কপালে বিরক্তির রেখা ফুটে ওঠে। রাগটা চটাশ করে একলাফে কাঁধ থেকে মাথার ডগায় গিয়ে বসে। সারপ্রাইজ ভন্ডুল!

মনোয়ার, নাজমাকে সালাম দিয়ে আড়চোখে ইছাকের বেশভুশা লক্ষ্য করে এবং কয়েকটি তীক্ষ্ণ বাক্য ছুড়ে দেয়।

-কিরে ব্যাডা, হেভী মান্জা মারছিস্! বিষয়টা কি? তোর বায়ার তো মাল রাইখ্যা তোরেই কিইন্যা লইব মনে হয়-হ খ হ খ হ খ -----। মনোয়ার হাসলে শব্দটা হয় হ এবং খ এর মাঝামাঝি, যুক্তাক্ষরের মতোন। অন্যদিন সয়ে যায় ইছাকের। কিন্তু আজ, তার ষ্টকে যতটুকু রাগ ছিল, সেখানে যেন কেউ গরম ছাই ছড়িয়ে দিল। সেই ছাইয়ে তাপ ছিল প্রচন্ড। হাতটা মুষ্টিবদ্ধ হয়ে পকেটের বাতাসটুকু শ্বাসরুদ্ধ করে। এবার বোমাটা বোধহয় ফাটলো।

না ফাটেনি। কারণ ঠিক তখনই হঠাৎ মনোয়ারার মুখের বাক্যগুলো সঙ্গীত হয়ে বেজে উঠতে শুরু করে-
-ভাই, ভাবি কাল রাতেই আমরা চলে যাচ্ছি। কানাডায়। তাই বিদায় নিতে এলাম। ফ্লাইট রাত দুটায়। মাফটাফ করে দিয়েন ভাই। মনোয়ারা হয়ত গান গায়, হয়ত গায়না কিন্তু তার গলার স্বর এতটাই মিঠা-হয়তো বত্তৃতা শুনলে মনে হতো সঙ্গীতের মজলিস চলছে।

ইছাক বুঝতে পারে তার আজকের ইচছাপুরণ আপাতত স্থগিত হয়ে গেল। সারপ্রাইজের প্রাইজ অশ্বডিম্ব! রাস্তার ট্রাফিক জ্যামের মতো তার চিন্তাশক্তিও যেন নিস্তব্ধ হয়ে যায়। স্থির গাড়ির মধ্যে বসে থাকা গাড়ির চালক অন্যমনস্ক হয়ে জাবর কাটতে কাটতে যেমন পেছনের গাড়ির অবাধ্য হর্ণ শোনে, ঠিক তেমনি স্ত্রী নাজমা বেগম চিঁ চিঁ আওয়াজটি কানে আসে।

- মুনোয়ার বাই বলেন কি! এমন একটা কাম করলেন, আমাগো ফালায় চলে যাবেন! হায় হায় কি কথা! ক্যানাডায় কি কামের মানুষ আছে? না লইয়া যাবেন বাবী? দেশে আসলে কিন্তু এই আপনার নিজের বাড়ি -

এজাতীয় এলোমেলো জিজ্ঞাসা ও মন্তব্য কিলবিল করে সম্প্রসারিত হয়। কিন্তু মনোয়ারের চোখ তখনো ইছাকের দিকে
- কিরে শালা মুখটা সেলাই করলি নাকি? তুমিতো আবার গার্মেন্টসের লোক। বায়ারের কথা ছাড়া চলবানা। বায়ার কি চুপ থাকতে বলসে নাকি? হ খ হ খ হ খ -------

ঘাপটি মেরে বসে থাকা ইছাকের সোফায় চিম্টি কাটা বাক্য ছুঁড়ে মনোয়ার পাশে এসে বসে।

- দোস্ত, মনডা খারাপ নাকি? নতুন গাড়ি কিনসো আমারে বলো নাই, অফিসে নতুন পিএ বসাইসো তাও বলো নাই। ঐরকম সুন্দরি মাল অফিসে রাইখা বাসায় আসবা ক্যামনে হ খ হ খ হ খ -----। তোরে ফোন করি, বলে বায়ারের সঙ্গে মিটিং এ আছে। মোবাইলও বন্ধ। নাকি প্রেমে পড়েছিস? হ খ হ খ হ খ ------। হইছেটা কি তোর ?
- এ্যাই ধ্যাৎ তুমি ভাইজানের পিছে লেগেছ কেন বলোতো?
আবারো মনোয়ারা হকের সুন্দর টুংটাং পরিবেশিত হয় এবং ইছাক কিছুটা স্বাভাবিক আচরনের ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন করে।
- তোরা ক্যানাডা যাবি যা, ইমিগ্রেশন নিবি এটা আমাদের বলতে পারতি। একলগে যাইতাম।
- হয় কি না হয়, টেনশনতো ছিলই। মনুই (মনোয়ারার আদুরে নাম) সব করেছে। গত বছর পাশের বাসায় ডাকাতি হইল, তখন থিক্যা সে জিদ ধরসে। ক্যানাডা চলো, ক্যানাডা চলো।
- আমাদের বাসার পাশে ডাকাত পড়েছিল নাকি?
চমকে প্রশ্ন করে মনোয়ারা।

- আরে নানা হঠাৎ সবকিছু ক্যামনে এত তাড়াতাড়ি হইল নিজেও জানিনা। দেশে য্যামন খুনাখুনি, মারামারি বাড়তেছে, পোলা মাইয়ারে নিয়া কেমনে থাকি বল, তারা পড়ে ইংলিশ মিডিয়ামে। রেষ্টুরেন্টে খাই সপ্তাহে ৫ দিন। দেশে থাইক্যা লাভ কি? ভাবছি তোরে বলবো, তারপর ভাবছি সব ঠিকঠাক হইলে তোকে একবারেই কমু।
- আসলে ভাই ভেবেছি সারপ্রাইজ দেব আপনাদের।
এবার স্বামীর ধারা বর্ণনার সাথে মনোয়ারা তার হাসিমাখা কথামালা যোগ করে, যা শ্রবণ করে ইছাকের যে গোস্বাটুকু গোত্তা খেয়ে প্রকট বিস্ফোরণে পরিণত হচ্ছিল-সেটা লঘু হয়ে যায়।

অতঃপর বিদেশ যাবার সুফল ও কুফল বিষয়ে ব্যবচ্ছেদ চলতে থাকে। যে যার অবস্থানে থেকে ছক্কা এবং চার মারতে থাকে। উঁচু নীচু লয়ের নানান উক্তি একটি ঘরোয়া আড্ডার পরিবেশ তৈরি করে দেয়। বিরতি হিসেবে মনোয়ার দম্পতির বিদায়ী সফরের মাঝামাঝি সময়ে নাজমা বেগম বাটিপূর্ণ কুমিল্লার রসমালাই পরিবেশন করে।

- মুনোয়ার বাই কানাডা গিয়া রসমালাই পাইবেন কই? নাজমা বেগমের কান্না মেশানো প্রশ্ন।
- আরে ভাবী আপনারে তো বলিনাই, মনু এখন বাড়ীতে মিষ্টি বানানো শিখছে। ভাবতেছি ঐখানে গিয়া একটা মিষ্টির দোকান দিবো- মনোয়ার সুইটমিট। হ খ হ খ হ খ।

- মিষ্টি না হয় খাইলেন কিন্তু দেশের জন্য মন পুড়বোনা? নাজমার পাল্টা প্রশ্ন।
- আরে রাখেন আপনাদের দেশ, দেশের মানুষ বিদেশে একলগে থাকলেই দেশ হইয়া যায়, দেশ বানানো যায়। মনের ইচ্ছাটাই হইতেছে আসল, বুঝলেন। অনেক দিনতো দ্যাখলাম, কিছুই হবেনা এখানে। দ্যাখেন-আমাদের লীডার, বিজনেসম্যান এদের কারোর গুষ্ঠি আছে কিনা দেশে, চলেন, চলেন আপনেরাও চলেন।

নাজমা-নারে ভাই, তিন দিন বিদেশে থাকলে, ভাতের খিদায় আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।

মনোয়ারা-কেন ভাবী, বিদেশে কি ভাত রান্না করা যায় না?

কথাপোকথন আরো বিস্তৃত হয়। প্রশ্ন পাল্টা প্রশ্ন, সিদ্ধান্তহীন একটা সময় গুমোট হয়ে থাকে। একপাশে ঘাপটি মেরে বসে থাকা ইছাক মাঝেমধ্যে গলা পরিষ্কার করে সকলের মনোযোগ কাড়ে। তারপর রাত বাড়লে মনোয়ার দম্পতি গর্বিত হাসি হাসতে হাসতে একসময় প্রস্থান করে।

অতিথিশুন্য ড্রইংরুমে ইছাক ও নাজমা কিছুটা হতভম্ব, নির্বাক বসে থাকে বেশ কিছুটা সময়। দুলাল আসে। হাতে নেয় টিভির রিমোটটা। এবং একটা হিন্দি গানের সাথে নাচ ছেড়ে দেয়। ইছাকের মাথার বোমাটা ঠিক তখনই দুম করে ফাটে।

ইছাক-কদ্দিন বলছি পোলাপানের হাতে রিমোট দিবানা, বলছি কিনা? সারাদিন এইসব নাচগান দ্যাখতে থাকলে-বড় হইয়াতো নিজেও জামাকাপড় পরবোনা, অন্যদেরকেও পরতে দিবোনা।

নাজমা-রিমোট না হয় দিলামনা, কিন্তু ঐরকম জমানা আসলে ওরে তুমি ঠেকাইতে পারবা? টিভির এমন কোন চ্যানেল আছে, যেইখানে মাইয়াগো নাচায়না? আচছা বলোতো, মনোয়ার বাইয়ের পোলাপানগুলির কি হবে? শুনছি বিদেশে ছেলেমেয়েরা অল্প বয়সেই...

- আরে থামো, অন্যেরডা নিয়া তোমার এত চিন্তা কিসের, নিজেরডা নিয়া ভাবো।

ইছাকের গলায় ধমকের সুর বাজে। এরকম চাপা উত্তেজনা মাখা সময়ের মধ্যদিয়ে এই অধিবেশনটি সমাপ্ত হয়। রাত তখন ১১ টা ৪৫। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে জনাব ইছাক রাগে আরেকবার অস্থির হয়ে পায়চারী শুরু করে।

- শালা, তুই বিদেশ যাবি যা। আমার সন্ধাটা মাটি করলি ক্যান? শালা সারপ্রাইজ দিবা, তুমি সবসময় চাও টেক্কা মারতে?
ভাবছে আমি কিছু বুঝিনা। ক্যানাডা যাবি যা, এত ভণিতা কিসের?
মনুই সবকিছু করসে আমি জানিনা। তুমি না জাইন্যা এক কদম ফেলতে শালা তিনমাস লাগাও। সেই তুমি বিদেশ যাইতেছ বউয়ের লেজ ধইরা অন্ধের মতো। মনেকরো কিচ্ছু বুঝিনা?
হাজারো ক্রোধ মিশ্রিত জিজ্ঞাসায় ডুবে গিয়ে বিহ্বল ইছাক টানটান বিছানায় শুয়ে পড়ে।

- তোমার কি শরীর খারাপ লাগতেছে নাকি? এসি ছাড়বো, জুতাডা খুইল্যা দিব? নাজমা কাছে আসতেই ইছাক আবার খ্যাক্ করে ওঠে।
- নিজের চরকায় তেল দাও। আমার কিছু হয় নাই।

রাত ক্রমশ গভীর হয়। এক অজানা হতাশায় এই দম্পতি পাশাপাশি শুয়ে থাকে আলো আধারির ঘরের ছাদে দৃষ্টি দিয়ে। একসময় নাজমার বাহুখানা ইছাকের বুকে আছড়ে পড়ে। দুজনের ভেতরেই অতৃপ্তির নিঃশ্বাস। যেন তারা নিঃশ্ব হয়েছে। নাজমা মুখ খোলে-
- আচ্ছা বলোতো, তুমিও কি বিদেশ যাইতে চাও? দ্যাশেতো আমরা ভালোই আছি।
ইছাক সিগারেটে লম্বা টান দেয়। নিশ্চুপ।
- আর যদি যাইতে চাও তো চলো, আমরাও যাই।
- কেন যাবো?
- মনোয়ার ভাইরা যে কারণে যাইতেছে।

ইছাক আবার ক্ষেপে ওঠে।
- মনোয়ার যে কারণে যাইতেসে, আমি সে কারণে যাব কেন? আমার কি কম আছে নাকি দেশে-গাড়ী আছে, বাড়ী আছে, ব্যবসা আছে। কম কি, কম কি?
- তাইলে তুমি দুঃখ করতাছো ক্যান?
- জানিনা, মনে হইতেছে, কিছুই পারলামনা জীবনে। সব শেষ। সবকিছু ফাঁকা ফাঁকা।
- আচ্ছা নাজমা ধরো, আমরা সকলেই ক্যানাডা চইল্যা গেলাম, যুক্তিডা কি? আমাদের দুলালের ভবিষ্যৎ? না সবার জন্যই। বাপে ছিল গ্রামে। আমারে পাঠাইল ঢাকায়। আমি যাব ক্যানাডায়। ছেলে কি আমার নাতিকে চাঁন্দে পাঠাইব?
- তুমি এতা মাথা ঘামাইওনাতো, যা হবার হইব। এখন ঘুমাও। সকালে দুলালের স্কুল আছে।
- না না নাজমা, তুমি যুক্তিডা বলো। ধরো আমরা ক্যানাডা গেলাম, কেনো যাবো?
- যাবোনা কেন? মনেকরো এইদ্যাশের জনসংখ্যার চাপ কমাইতে আমরা ক্যানাডা যাবো...
- স্ত্রীর এরকম একটি উত্তর শুনে ইছাক এতটাই পুলকিত হয় যে, গভীর রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে তার হ খ হ খ হ খ হ খ হাসির শব্দ ক্রমশঃ প্রতিধ্বনিত হয়। ঐ মুহুর্তে নিজের স্ত্রীকে পৃথিবীর সবচেয়ে বুদ্ধিমতি মহিলা মনে হয় তার। হাসতে হাসতে সে প্রচন্ড আবেগে স্ত্রীকে আলিঙ্গন করে। তারপর একটা ঝটিকা মৈথুনের পর দম্পতিটি বুঝতে পারে তাদের আকাংখিত যু্িক্তটি মিলে গেছে।

কিন্তু মনোয়ার? সেও কি এরকম একটি যুক্তি খুঁজে নিতে পেরেছিল? মনে হয় না। ও শালা গিয়েছে লোভে পড়ে। এমন ধারণায় ইছাকের অন্তরে আবারো একটু শীতল শান্তি অনুভুত হয়।

২৫শে অক্টোবর বিকেলে রস্তমপুর যাবার কথা। পিতার মৃত্যুদিবসকে কেন্দ্র করে প্রতি বছরই এসময় ইছাককে গ্রামে আসতে হয়। গাড়ীতে তিন ঘণ্টার রাস্তা। এবারের আসাটা দু’দিন আগেই। গত মাসে ভীষণ চাপ গেছে কাজের। তিন চারজন বায়ারের আগমন তারপর বিশাল অর্ডার। ফ্যাক্টরীর বাতিগুলো সামান্য সময় জিরাবারও সময় পায়নি। তাই একটু অবসরের আকুতি।

গ্রামের রাস্তার মুখে গাড়ীর সামনের চাকাটি হঠাৎ হাওয়া ত্যাগ করে। ইছাক অগত্যা গাড়ি থেকে নেমে পড়ে। ড্রাইভার ব্যাচারা ঝটপট চাকা সারতে ব্যস্ত হয়ে যায়। ইছাক সিগারেট ঠোঁটে পায়চারী শুরু করে। শৈশবের স্মৃতিগুলো আলতোভাবে ছোয়া দিয়ে যায়। সাইকেলে স্কুলে যাওয়া, পুকুরপাড়ে মাঝধরা, এরকম হাজারো ঘটনা ছবি হয়ে ঘুরপাক খেতে থাকে চারপাশে।

- তুমি কি কিছু চিন্তা করতেছো?
নাজমার সরল প্রশ্ন গাড়ীর জানালা দিয়ে ছুটে আসে।
- আমারে বিরক্ত কইরোনা, তুমি ঘুমাইতে চাইলে ঘুমাও। আমার নতুন পাঞ্জাবিটা আনসো?
- কোনটা?
- ঐযে সাদার মধ্যে নীল কাজ করা।
- আনসি।
- আব্বু আমি হিসু র্কবো।
দুলাল এবার পাশে এসে দাঁড়ায়।
- করো।
এবার নাজমা বিরক্ত হয়।
- ওরে তুমি একটু হেল্প করোনা। কোনদিনইতো তুমি বাথরুমে নিয়ে যাওনা ওরে।
- আরে রাখো রাখো, পোলাপানদের সাবলম্বী হইতে দাও।

পুত্রের জলবিয়োগের পর ইছাকও বুঝতে পারে এই একই প্রয়োজন তার শরীরে প্রবেশ করছে। চাপটাও প্রচন্ড। অগত্যা রাস্তার পাশের ঢালু জায়গাটাকে লক্ষ্য করে এগিয়ে যায়। এরই মধ্যে গাড়ি ঠিকঠাক। ইছাক প্রশান্তি নিয়ে রাস্তায় উঠে আসে।

সামনে কয়েকজন যুবক দাঁড়িয়ে। গাড়ির কাছেই জটলা। ইছাক একবার চেনার চেষ্টা করে। কিন্তু সবইতো অপরিচিত মুখ। বিপদ নয়তো। সে যতটা গাড়ির দরজার দিকে যায়-ওরাও এগিয়ে আসে সামনে। সংখ্যায় পাঁচ-ছ’জন। একদম সামনে যে ছেলেটি, তার চোখদু'টো সুন্দর, কিন্তু চাহুনিটা বেহায়ার মতো। চোখের পাতা পড়তেই চায়না। একটু দুরে দু’টা মোটরসাইকেল দাঁড়িয়ে। যেন কোথাও যেতে যেতে থমকে দাঁড়িয়েছে। নাজমা বেগম আবারো চি চি করে ওঠে।

- কি চায় তারা, এ্যাই শুনতেসো, তুমি কিন্তু মাথা গরম কইরোনা, গেলবারতো বহুত চান্দা দিছো, এবার দিবানা। রিভালবারটা সাথে আনলেই পারতা।

ইছাক গাড়িতে না বসে আবারো একটি সিগারেট ধরায়। যতটুকু নয় তারচেয়েও বেশি ব্যক্তিত্ব শরীরে ভর করার চেষ্টায় রত হয়।

- স্লামালেকুম ভাইজান।
- ওয়ালেকুম।
- ভাইজান কেমন আছেন?
- ভালো, তোমরা - ঠিক, চিনতে পারলামনা।
- আমি বাবলু, (পরপর যে যার নাম বলে যায়) এই এরিয়ায় থাকি।
- পাশের একজন যোগ করে।

উদ্দেশ্য বুঝতে না পেরে ইছাক সহজভাবে প্রশ্ন করে।
- সব খবর ভালো তো?
- খবর ক্যামনে ভালো হয়, ভাইজান? আপনারা এলাকায় আসেন্না। আসলেও চইল্যা যান, আপন আপন কাম সাইরা।
- শুনছো - এ্যাই শুনছো ...
নাজমা বেগম ডাক দিয়ে উত্তর পায়না। তারপর গাড়ির ভেতর বসে আপন মনে কথা বলে - কি চায় জিগাইলেই পারে , খালি খালি আলগা কথা।

- আমি এলাকায় আসলে তোমাদের লাভ কি?
ইছাকের সরাসরি প্রশ্নে যুবকের দল কিছুটা থতমত খেলেও পেছন থেকে আরেকজন সামনে এগিয়ে আসে।

- আমাদের কি লাভ? - এলাকার লাভ। এই যে রাস্তায় চলতেছেন। এটাতো এলাকার লোকের চেষ্টাতেই হইছে। ঐযে ইলেকট্রিসিটি আসতেছে ঐটাওতো এলাকার লোকের ...

- ভুল বলছো, এগুলোতো সরকার দিচেছ।
- কিন্তু আদায় করে আনছেতো এলাকার লীডার। তাদের চেষ্টা না থাকলেতো কেউ মুখ ফিইরা তাকাইতো না। কিন্তু এখন ভাইজান, আমরা পড়সি মুছিবতে। সমস্যা বহুতদিনের। এই এরিয়ায় আমাগো পার্টিতে লীডার দুইজন। দুইজনই চায় এমপি হইতে, তারা পাশাপাশি বসেনা। বাৎচিৎ নাই দু’জনের মধ্যে। গতবার হাজারটা নকল ভোট দিয়াও স্বতন্ত্রর কাছে গু’হারা হারসে। পরশু ঢাকা গেছিলাম, পার্টি অফিসে অনেক কথা হইল, আপনার কথাও উঠছে- আমরা সাপোর্ট দিসি। কালই আবার ঢাকা যাইতাম আপনের সাথে দেখা করতে। সামনের ইলেকশনে-আপনি আসেন ভাইজান। কনফার্ম সীট পাইয়া যাবেন। আপনে হয়তো জানেননা-আমরা বিশেষভাবে আপনেরে শ্রদ্ধা করি।

দুলালের বাজানো হর্ণ শুনে চৈতন্য ফিরে আসে ইছাকের।
- বলছো কি তোমরা- আমি করবো রাজনীতি, পাগল নাকি?
- কেন আপনি গতবার এ্যাসোসিয়েশনের ইলেকশন করেন নাই?
- আরে ধুর ওটা কি রাজনীতি নাকি?
- ভাইজান রাজনীতি ছাড়া কি বাংলাদেশে ইলেকশন হয়?
- আচছা আচ্ছা ঠিক আছে ......
অজানা পুলকে ইছাক হাসতে হাসতে উত্তর দেয়। বলে-
- এসব কথাকি রাস্তায় হয়? আমিতো আছি দু’একদিন। পরে তোমাদের সাথে কথা বলছি এ বিষয়ে। দেখা হবে। এখন আসি ক্যামন।

- ঝটপট গাড়িটি চালু হয় এবং গ্রামের দিকে এগিয়ে চলে।
- ওরা কইলো কি? কত চাঁদা চাইছে?
- থামোতো তোমার মাথায় সবসময় এত ছ্যাঁচড়া চিন্তা আসে ক্যানো বলোতো? ওদের দেখে কি চাঁদাবাজ মনে হয়? আমার গ্রামের তরুণ সমাজের একটা ষ্ট্যাটাস আছে বুঝছো।
- গতবারতো উল্টা বলছিলা। এই গ্রামে আর আসুমনা, বাপের কবর প্রয়োজনে উঠাইয়া নিয়া যামু। খালি চাঁদা, খালি চাঁদা। হঠাৎ এত পিরিতের কারণডা কি?
- ইছাকের টগবগে পুলকে নাজমা এবার যেন গরম তেল ঢেলে দিল। প্রচন্ড রাগে নির্বাক ইছাকের মনে হয় মৌমাছিরা হুল ফুটিয়েছে তার মস্তিস্কের সমস্ত অস্তিত্বে। চমৎকার একটা অনুভুতি মুহুর্তে স্লান হয়ে যায়। দুলাল বাপের মোবাইল নিয়ে খেলছিল। সে আবদার করে
- জেমসের গানটা ছাড়তে বলোনা আব্বু ...

আর রাগটাকে বোধহয় আয়ত্তে রাখা গেলনা। সবটুকু কুন্ডলী পাকিয়ে ফনা তুলে দাঁড়ায়। কিন্তু ইছাক স্বভাব অনুযায়ী চুপ করে বসে থাকে। তারপর হঠাৎ কষে একখানা চড় মেরে দেয় পুত্রের গালে।

সন্ধ্যারাতে পিতার কবর জিয়ারত সম্পন্ন হয়। বাড়ীর উঠানে দাঁড়িয়ে একাকী আকাশের দিকে চেয়ে অনির্ধারিত একটা ঘুমের খায়েশ জাগে ইছাকের। যে যার কাজে ব্যস্ত। সে চুপিসারে ঘরে গিয়ে বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দেয়। কেমন একটা আনন্দে আত্মহারা ইছাক অজান্তেই হেসে ওঠে বারবার। আধাখোলা দরজা ভেদ করে নাজমা এগিয়ে আসে। বিছানায় বসে এবং চুলে আঙুলের কাঁরুকাজ এঁকে স্বামীকে আবেগে আপ্লুত করে।

- আচছা নাজমা মনেকরো আমরা ক্যানাডায় গ্যালামনা। ঠিক আছে? ধরো, আমি এইবার ইলেকশনে খাড়াইলাম-দাড়াইলাম ভোটে।
ইছাক প্রশ্ন করে।
- বুঝলাম না।
- ধরো, যদি আমি পলিটিক্সে যাই।
- বুঝি নাই।
- আরে বোকা মনেকরো আমি রাজনীতিতে নামলাম। ধরো হইলাম এমপি, তারপর মন্ত্রী। কেমুন হয়?
- কেন?
- এমনি।
- নামতে চাইলে নামবা .....
- ঠিকআছে, ধরো রাজনীতিতে নামলাম-কিন্তু যুক্তিডা কি?
- সত্যই কি তুমি রাজনীতিতে নামতে চাও?
- নামতেও তো পারি।
- কখন? ক্যানাডা থিইক্যা ফিইরা আইস্যা, নাকি যাওয়ার আগেই?
অতঃপর তারা দু’জনে অট্টহাসিতে অবতীর্ণ হয় এবং পরস্পরকে গভীরভাবে আলিঙ্গন করে।

লেখক: স্থপতি, গল্পকার, নাট্যকার ও চলচ্চিত্র পরিচালক

সান নিউজ/ আরএস

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

রাজধানীতে স্বস্তির বৃষ্টি

নিজস্ব প্রতিবেদক: টানা একমাস দাবদ...

মিল্টন সমাদ্দার রিমান্ডে

নিজস্ব প্রতিবেদক: মৃত্যুর জাল সনদ তৈরির অভিযোগে প্রতারণা ও জ...

আমিরাতে প্রবল বৃষ্টিপাত, সতর্কতা জারি

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: প্রবল বৃষ্টিপা...

লিওনার্দো দা ভিঞ্চি’র প্রয়াণ

সান নিউজ ডেস্ক: আজকের ঘটনা কাল অতীত। প্রত্যেকটি অতীত সময়ের স...

ভরিতে ১৮৭৮ টাকা কমলো স্বর্ণের দাম 

নিজস্ব প্রতিবেদক: টানা অষ্টমবারের...

পাহাড় ধসে যান চলাচল বন্ধ

জেলা প্রতিনিধি: রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি-দীঘিনালা সড়কের দুই কিলো...

পাকিস্তানে সড়ক দুর্ঘটনা, নিহত অন্তত ২০

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: পাকিস্তানে ভয়া...

গাজীপুরে ২ ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ, আহত বহু

জেলা প্রতিনিধি: গাজীপুর জেলার জ...

ময়মনসিংহে পুকুরে ডুবে নিহত ২

জেলা প্রতিনিধি: ময়মনসিংহ জেলার শি...

ফের গরম সবজির বাজার

নিজস্ব প্রতিবেদক: পেঁপের কেজি ৮০ টাকা শুনে অনেকটা হতভম্ব হয়ে...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা