মতামত

নিপীড়িত বাঙালির মুক্তির সনদ ঘোষণার দিন আজ

ইসমত শিল্পী: ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

ঐতিহাসিক এই ঘোষণাই বস্তুত বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা। মুক্তিযুদ্ধেও শেষ দিনটি পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ বাঙালিকে অনুপ্রাণিত করেছে। স্বাধীনতার পবিত্র সংগ্রামে, বঙ্গবন্ধু ঘোষিত স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে মাতৃভূমির শৃঙ্খল মোচনে প্রাণ দিয়েছে অগণিত মুক্তিসংগ্রামী।

৭ মার্চ, রমনা রেসকোর্স ময়দানের জনসমুদ্র। লক্ষ লক্ষ কণ্ঠে একই আওয়াজ- স্বাধীনতার বজ্র শপথ। বাতাসে উড়ছে অসংখ্য পতাকা। সোনার বাংলার মানচিত্র আঁকা লাল সূর্যের পতাকা। শ্লোগানের সাথে সাথে উত্থিত হচ্ছে আকাশের দিকে বাঙালির সংগ্রামের প্রতীক বাঁশের লাঠি। অসংখ্য লাঠি। শ্লোগানে শ্লোগানে উদ্দীপ্ত জনসমুদ্র- ‘জয় বাংলা।’, ‘আমার দেশ তোমার দেশ-বাংলাদেশ বাংলাদেশ।’

১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ এসেছিল এক ধারাবাহিক রাজনৈতিক আন্দোলনের পটভূমিতে। স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার প্রশ্নে বা আন্দোলনের ব্যাপারে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত কবে দেবেন, সেজন্যই ছিল মানুষের অধীর অপেক্ষা।

বঙ্গবন্ধু তাঁর ৭ মার্চের ভাষণে বাঙালি জাতীয়তাবাদ যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন, তা আজ পর্যন্ত বিশ্বের আর কোনো নেতা পারেননি।

ভাষণে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন:

‘...আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়। ... নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষ

সম্পূর্ণভাবে আমাকে আওয়ামী লীগকে ভোট দেন। আমাদের ন্যাশনাল এসেম্বলি বসবে, আমরা সেখানে শাসনতন্ত্র তৈয়ার করবো

এবং এই দেশকে আমরা গড়ে তুলবো, এদেশের মানুষ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে। কিš‘ দুঃখের বিষয়, আজ

দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, তেইশ বৎসরের করুণ ইতিহাস বাংলার অত্যাচারের, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস। তেইশ বৎসরের

ইতিহাস মুমূর্ষু নরনারীর আর্তনাদের ইতিহাস; বাঙলার ইতিহাস এদেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস।...’

জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা বাংলাদেশের সংবিধানের এই চার মূলনীতি বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। ভাষণে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা বলেছেন। তিনি বাংলার মানুষের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক মুক্তির কথা বলেছেন। তাঁর বক্তৃতায় বাঙালি জাতির উপর তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের নির্যাতনের করুণ বর্ণনা দিয়েছেন।

একইসঙ্গে বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বাঙালি জাতির গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবি তুলেছেন। বঙ্গবন্ধুর ভাষণে শোষণমুক্ত সমাজতন্ত্রের প্রতিফলনও আমরা দেখতে পাই। তিনি তাঁর বক্তব্যে একদিকে যেমন বাঙালি জাতির অর্থনৈতিক মুক্তির দাবি জানিয়েছেন, তেমনি অসহযোগ আন্দোলনে শ্রমজীবী গরিব মানুষের কথা উল্লেখ করেছেন।

সবশেষে, বঙ্গবন্ধু তাঁর ৭ মার্চের ভাষণে ধর্মনিরপেক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন। তিনি তাঁর বাঙালি জাতীয়তাবাদ চেতনার প্রতিষ্ঠায় হিন্দু, মুসলমান, বাঙালি, অবাঙালি সবার কথাই বলেছেন।

সেদিনের ভাষণে বঙ্গবন্ধু সমাজতন্ত্রকে ধারণ করেছেন। কিন্তু তাঁর সেই সমাজতন্ত্র ভাবনা শাস্ত্রীয় সমাজতন্ত্র ছিল না। আমরা পরবর্তীতে তাঁর অনেক বক্তৃতায় সে ব্যাখ্যা পেয়েছি। তিনি সমাজতন্ত্রকে তত্ত্বের বেড়াজাল থেকে মুক্ত করে শোষণহীন, ন্যায়ানুগ ও সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা অর্জনের লক্ষ্যে ব্যবহার করতে চেয়েছেন।

এ ভাষণে অর্থনৈতিক মুক্তির দাবি জানানো হয়েছে, শোষণমুক্ত সমাজের দাবি জানানো হয়েছে। ৭ মার্চের ভাষণে যে অসহযোগ আন্দোলনের

ডাক তিনি দিয়েছিলেন, সেখানে শ্রমজীবী মানুষের উপর তাঁর বিশেষ দৃষ্টি ছিল। তিনি তাঁর ভাষণে অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করার সময় বলেছিলেন:

‘গরিবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে, সে জন্য সমস্ত অন্যান্য জিনিসগুলো আছে সেগুলির হরতাল কাল থেকে

চলবে না। রিকশা, গরুর গাড়ি চলবে, রেল চলবে, লঞ্চ চলবে;...২৮ তারিখে কর্মচারীরা বেতন নিয়ে আসবেন।...আর এই সাতদিন হরতালে যে সমস্ত শ্রমিক ভাইরা যোগদান করেছেন, প্রত্যেকটা শিল্পের মালিক তাদের বেতন পৌঁছায়ে দেবেন।’

পাহাড়সম প্রতিকূলতার মধ্যে দাঁড়িয়েও বঙ্গবন্ধু গরিব দুখী ও শ্রমজীবী মানুষের কথা চিন্তা করেছেন।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের অন্যতম মূলনীতিই হচ্ছে গণতন্ত্র। পুরো বক্তৃতায় তিনি বাঙালির গণতান্ত্রিক অধিকারের ন্যায্য দাবি জানিয়েছেন। অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয়ার মূল উদ্দেশ্যই ছিল বাঙালির গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা।

৭ মার্চের ভাষণ ছিল একটি অগ্নিশলাকা যা প্রজ্জ্বলিত করেছিল মুক্তিযুদ্ধের ওই দাবানলকে, এই ভাষণ ছিল সে সময়ের দিশেহারা জাতির জন্য একটি আলোকবর্তিকা। আর আজকে এই ভাষণ শুধু বাঙালি জাতির একান্ত ঐশ্বর্য নয়, বরং বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ আজ বিশ্বমানবতার ঐশ্বর্য। ভাষণটিকে

ইউনেস্কো ‘বিশ্ব প্রামাণ্য দলিলের’ অন্তর্গত করার মাধ্যমে বিশ্বমানবতার বিজয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

এভাবেই এগিয়ে যাক বিশ্বসভ্যতা, বিশ্ব মানবতা। এই ভাষণ একদিকে যেমন উপনিবেশ উত্তর রাষ্ট্রসমূহের সার্বজনীন গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার ব্যর্থতার এক অকাট্য প্রামাণিক দলিল, অন্যদিকে এটি আজ সারা বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের মুক্তির জন্য এক অনন্য দৃষ্টান্ত।

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে লঞ্চের পর ফেরি চলাচলও বন্ধ

বৈরী আবহাওয়ার কারণে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে বৃহস্পতিবার (২৯ মে) সকাল থেকে শু...

নীলফামারীতে আবির নামে ভুয়া সেনাসদস্য গ্রেফতার

নীলফামারীতে লাবিব ইসলাম আবির (২৭) নামে ভুয়া এক সেনা সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছ...

ভালুকায় জিয়াউর রহমানের শাহাদাত দিবস পালনে অনুদান নয়: মোর্শেদ আলম

মহান স্বাধীনতার ঘোষক, বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বি...

লাউয়াছড়ায় গাছের সঙ্গে ট্রেনের ধাক্কা; অল্পের জন্য রক্ষা

মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া ঢাকা-...

কোভিট-১৯ রেসপন্স এন্ড রিকভারি প্রজেক্ট

কোভিট-১৯ রেসপন্স এন্ড রিকভারি প্রজেক্টের আওতায় ফেনী পৌরসভার ১৮টি ওয়ার্ডের উন্...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা