নিজস্ব প্রতিবেদক:
বাংলা ট্রিবিউনের কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি সাংবাদিক আরিফুল ইসলামকে তার বাসা থেকে মধ্যরাতে আটক এবং নির্যাতনের ঘটনায় বিব্রত সরকারের বিভিন্ন মহল। ক্ষুব্ধ সাংবাদিক সমাজসহ বিভিন্ন শ্রেনী পেশার মানুষ।
১৩ মার্চ শুক্রবার রাতে ডিসি অফিসের দুই-তিন জন ম্যাজিস্ট্রেটসহ ১৫-১৬ জন আনসার সদস্যের একটি দল তাকে ধরে নিয়ে ভ্রাম্যামান আদালতে কারাদণ্ড দিয়েই ক্ষ্যান্ত হয়নি, পরে তাকে উলঙ্গ করে দুই চোখ বেঁধে নির্যাতনও করে তারা। সেসময় পুরো দৃশ্যও ভিডিও করা হয়েছে। আর এসব ঘটনার নেতৃত্ব দিয়েছেন কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের আরডিসি (সিনিয়র সহকারী কমিশনার-রাজস্ব) নাজিম উদ্দিন। এমনটাই অভিযোগ আরিফের স্ত্রী মোস্তারিমা সরদার নিতুর।
এদিকে আরিফুল ইসলাম রিগানের বিরুদ্ধে কী অভিযোগ ছিল বা মধ্যরাতে টাস্কফোর্স অভিযানের নামে কাউকে তুলে নিয়ে ভ্রাম্যমান আদালতে শাস্তি দেয়া যায় কি না, তার কোনও আইনি ব্যাখ্যা দিতে পারেননি কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন।
তার দাবি, এটা টাস্কফোর্সের অভিযান ছিল। এ অভিযান ম্যাজিস্ট্রেট পরিচালনা করেছে রেগুলার শিডিউলের অধীনে। সঙ্গে মাদকদ্রব্য অধিদফতরের লোক, পুলিশ, আনসার ছিল। আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে গ্যাপ থাকলে দেখা হবে। তারা সংক্ষুব্ধ হয়ে থাকলে আপিল করবে, আমরা বিস্তারিত খতিয়ে দেখবো।
এদিকে প্রশাসনের এমনবিতর্কিত কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সারাদেশে সৃষ্টি হয়েছে তুমুল সমালোচনার। সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ও বিষয়টি নিয়ে বিব্রত।
এ নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক অতিরিক্ত সচিব ও একজন যুগ্ম সচিব জানান, কুড়িগ্রামের বিষয়টি আমাদের জন্য বিব্রতকর। কোনোভাবেই মধ্যরাতে টাস্কফোর্সের অভিযান আইনসম্মত নয়। অবশ্যই টাস্কফোর্সকে সকাল না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে, এটাই বিধান। মধ্যরাতে অভিযান ও সাজা দেওয়ার বিষয়টি প্রশাসনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে কলে মনে করেন তিনি। এ ধরনের কর্মকাণ্ড মাঠপর্যায়ে সরকার ও প্রশাসনের ওপর জনগণের আস্থা কমায় এবং পরিস্থিতি বিরূপ করে তোলে বলে মন্তব্য তাঁর।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (জেলা ও মাঠপ্রশাসন অনুবিভাগ) আ. গাফ্ফার খান এ বিষয়ে বলেন, বিষয়টি আমরা শুনেছি। সংশ্লিষ্ট (রংপুরের) বিভাগীয় কমিশনার প্রাথমিক তদন্ত করে আগামীকাল ১৫ মার্চ রোববারের মধ্যে জানাতে বলা হয়েছে। এরপর আমরা পরবর্তী পদক্ষেপ নেব। প্রয়োজনে বিস্তারিত খতিয়ে দেখতে তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে।
রংপুরের বিভাগীয় কমিশনার কে এম তারিকুল ইসলাম বলেন, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে এ বিষয়ে তদন্তের জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আমরা ইতোমধ্যে কার্যক্রম শুরুও করে দিয়েছি। অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (রাজস্ব) আবু তাহের মো. মাসুদ রানা কুড়িগ্রামে কাজ শুরু করেছেন। আশা করছি আজকের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠিয়ে দিতে পারব।
জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন সাংবাদিকদের বলেছেন, আরিফুল ইসলামের ওপর যদি অন্যায় হয়ে থাকে, তবে অবশ্যই জেলা প্রশাসককে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে। কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়।
এদিকে এ ঘটনায় কুড়িগ্রামের সাংবাদিকদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। কুড়িগ্রাম প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান বিপ্লব জানান, আমি গভীর রাতে বিষয়টি শুনেছি। এটি খুবই দুঃখজনক। বিষয়টি নিয়ে জরুরি সভা করে সিদ্ধান্ত নেব আমরা।
সাংবাদিক আরিফুলের পরিবারের দাবি, শুক্রবার দিবাগত মধ্যরাতে কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের দুই-তিন জন ম্যাজিস্ট্রেট ১৫-১৬ জন আনসার সদস্যকে নিয়ে দরজা ভেঙে তার বাসায় ঢোকেন। তবে তারা কোনো তল্লাশি চালাননি বাসায়। পরে ডিসি অফিসে নেয়ার পর তারা দাবি করেন, আরিফুলের বাসায় আধা বোতল মদ ও দেড়শ গ্রাম গাঁজা পাওয়া গেছে। এরপর ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে তাকে কারাদণ্ড দিয়ে জেলে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
আজ দুপুরে কুড়িগ্রাম কারাগারে আরিফুলের স্ত্রী তার সঙ্গে দেখা করতে যান। আরিফুল ইসলাম স্ত্রীকে জানান, মধ্যরাতে তাকে বাসা থেকে জোর করে তুলে আনার পথে জেলা প্রশাসক কার্যালয় পর্যন্ত লাথি-থাপ্পড়, ঘুষি মারতে মারতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে একটি কক্ষে নিয়ে গিয়ে প্রথমে তার দুই চোখ কাপড় দিয়ে বেঁধে ফেলা হয়। এরপর প্যান্ট ও গেঞ্জি খুলে তাকে উলঙ্গ করে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। এসব দৃশ্য ভিডিও করা হয় বলে জানিয়েছেন আরিফুল। তিনি আরও জানান, যারা তাকে নির্যাতন করেছে, তারা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের কর্মকর্তা। তাদের দেখতে না পারলেও তাদের সবার গলার স্বর তার মনে আছে।
মোস্তারিমা সরদার নিতু আরও জানান, আমার স্বামী খুবই অসুস্থ। সে ঠিকমতো দাঁড়াতে পারছে না। আমাদের সঙ্গে বিস্তারিত কথা বলার মতো শক্তি ছিল না তার।
আরিফের পরিবারের দাবি, জেলা প্রশাসক মোছা. সুলতানা পারভীন একটি পুকুর সংস্কার করে নিজের নামে নামকরণ করতে চেয়েছিলেন। আরিফুল এ বিষয়ে নিউজ করার পর থেকেই তার ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন জেলা প্রশাসক পারভীন।
এছাড়া, সম্প্রতি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে নিয়োগ ও সুলতানা পারভীনের অনিয়ম নিয়েও প্রতিবেদন তৈরি করেন আরিফ। এরপরই একাধিকবার তাকে ডিসি অফিসে ডেকে নিয়ে হুমকিও দেয়া হয়। তবে এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীনের কোনও মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংস্থাটির দাবি, আইনের এমন যথেচ্ছ অপপ্রয়োগ আইনের শাসনের সাংবিধানিক অঙ্গীকারের পরিপন্থি ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর নামান্তর। এমন ন্যাক্কারজনক ঘটনায় দ্রুত তদন্ত ও জড়িতদের বিচার এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা না গেলে প্রশাসন তথা সরকারের ওপরই জনগণ আস্থা হারিয়ে ফেলবে।
সান নিউজ/সালি
Newsletter
Subscribe to our newsletter and stay updated.