মোঃ নূর ইসলাম খান অসি : বাংলাদেশ তথাকালীন পূর্ব বাংলা ছিলো একটি নদীবিধৌত নীঁচু সমতলভূমি এবং অগভীর উপকূল বিশিষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ একটি জনবহুল দেশ। প্রায় ৭১০ কিঃ মিঃ উপকূল রেখা বিশিষ্ট বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল ক্রান্তীয় নিম্নচাপ ও ঘূর্ণিঝড় এর লীলাভূমি। প্রতি বছর এপ্রিল-মে মাসে এবং অক্টোবর-নভেম্বর মাসে এই অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় এবং কোনো কোনো বছর বৃহদাকারে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস সংঘটিত হয়ে থাকে। নিয়মিত এই প্রাকৃতিক দুর্যোগেটি শুধুমাত্র উপকূলীয় অধিবাসীদের জান-মালের ক্ষয়ক্ষতি সংঘটিত করে না, সেই সাথে সমগ্র দেশের অর্থনীতির উপরেও এক বিরাট নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে থাকে।
আরও পড়ুন : গ্লাসগো জলবায়ু চুক্তি অনুসরণ করার এখনই সময়
১৯৭০ সালের ১২ই নভেম্বর সবোর্চ্চ ২২৪ কিলোমিটার বেগে তৎকালীন বৃহত্তর বরিশালে আঘাত হানা এই প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে ১০-৩৩ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হয়েছিল। এ দেশে সবচেয়ে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছিল ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর, যা ‘ভোলা সাইক্লোন’ নামে পরিচিত। যে হিসেব পাওয়া যায়, তাতে ১৯৭০ এর প্রবলতম ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় ১০ লাখ লোকের প্রাণহানি ঘটে এবং বিপুল সম্পদ বিনষ্ট হয় এবং অসংখ্য গবাদি পশু এবং ঘরবাড়ি জলোচ্ছ্বাসে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। । প্রায় ৯০% সামুদ্রিক জেলে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ঘূর্ণিঝড় প্রভাবিত অঞ্চলে কাজ করা প্রায় ৪৬,০০০ জেলে তাদের জীবন হারিয়েছে। প্রায় ৯,০০০ মাছ ধরার নৌকা ধ্বংস হয়েছে; সম্পত্তি এবং ফসলের ক্ষতি ছিল বিশাল। ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ের সর্বাধিক বাতাসের গতি রেকর্ড করা হয়েছিল প্রায় ২২৩ কিমি/ঘন্টা, এবং জলোচ্ছ্বাসের সর্বাধিক উচ্চতা ছিল প্রায় ১০ মিটার। তখন এ দেশ পূর্ব পাকিস্তান নামে পরিচিত ছিলো। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা বর্তমান বাংলাদেশের বরিশালের ভোলা দ্বীপ অঞ্চল তজুমদ্দিনে আঘাত হানার সময়ে ঘূর্ণিঝড়ের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় প্রায় ১৪৪ কিলোমিটার। সমুদ্রে থাকাকালীন এর সর্বোচ্চ গতিবেগ উঠেছিল ১৮৫ কিলোমিটারে। এই ঝড়ের ব্যাপারে আগাম কোনো সতর্কতাই দেয়নি তৎকালীন স্বৈরাচারী পাকিস্তান সরকার। আর এই ঝড় চলে যাওয়ার পর ত্রাণ ও উদ্ধার কাজেও সেভাবে কোন উদ্যোগ নেয়নি পাকিস্তান সরকার। সে সময়ে জাতির মুক্তির জন্য অত্যন্ত জরুরি ছিল যেই নির্বাচন। বাঙালিদের জীবন ও সম্পদহানিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান খুবই বেদনাহত হয়েছিলেন। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে একটি একতলা লঞ্চে ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ান এবং বিশ্ববাসীর কাছে সাহায্যের জন্য আকুল আবেদন জানান । উপকূলের মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়ান। সে সময়ে তিনি প্রস্তুতিমূলক একটি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন।
ঐ দুর্যোগে একটি আগাম সতর্কবার্তা ব্যবস্থাসহ কার্যকর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। সমীক্ষায় একটি কমিউনিটিভিত্তিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সিস্টেম তৈরির প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়। এই কার্যক্রমে তরুণ ও যুব সমাজ হবে প্রধান চালিকা শক্তি। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৭২ সালে লীগ অব রেড ক্রসের সহযোগিতায় এবং বাংলাদেশ রেড ক্রসের উদ্যোগ হিসেবে ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি (সিপিপি)/ জন্ম হয়। ‘সিপিপি’ কার্যক্রম শুরু করার সাথে সাথে একটি কার্যকর ও টেকসই কর্মসূচি গ্রহণে সাংগঠনিক কাঠামো তৈরির উপায় বের করতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের একটি সমীক্ষা চালানোর নির্দেশনা প্রদান করেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে ১৯৭৩ সালে এটি বাংলাদেশ সরকার এবং বাংলাদেশ রেড ক্রস সোসাইটির যৌথ কর্মসূচি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন থেকে বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে সিপিপি বাংলাদেশকে ঘূর্ণিঝড় সহনীয়তা অর্জনের দীর্ঘ পথে এগিয়ে নেয়। এরই সাথে বাংলাদেশও আজ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার রোল মডেল হয়ে উঠেছে।
আরও পড়ুন : দিনভর বৃষ্টি, বিপাকে নিম্ন আয়ের মানুষ
দুর্যোগ মোকাবেলা ও ত্রাণ সরবরাহের বিষয়ে পাকিস্তান সরকারের পূর্ব বাংলার প্রতি অনীহা ও নিষ্ক্রিয়তার কারণে সৃষ্টি হয় ব্যাপক গণ অসন্তোষ। ঐ গণ অসন্তোষ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্রের আন্দোলনকে আরো জোরদার করে। পাকিস্তানের পক্ষ থেকে বাংলার প্রতি এই বঞ্চনাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আরও ইন্ধন জুগিয়েছিল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর দেখানো পথ ধরে তারই সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদৃঢ় নেতৃত্বে বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আজ সারা বিশ্বে ‘রোল মডেল’। বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া সেই প্রতিষ্ঠানটিকে জননেত্রী শেখ হাসিনা অনন্য উচ্চতায় সমাসীন করেছেন। সিপিপির ৭৬ হাজারের অধিক নিবেদিতপ্রাণ স্বেচ্ছাসেবকগণ বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার মানবতার পতাকা যথাযোগ্য মর্যাদায় বহন করে আসছে।
ঐ ঘূর্ণিঝড় ছিল স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে বিধ্বংসী প্রাকৃতিক বিপর্যয়। জাতি সংঘের মতে বিশ্বের সব থেকে ধ্বংসাত্মক ঘূর্ণিঝড় হিসেবে প্রথম স্থানে রয়েছে এই ‘ভোলা ঘূর্ণিঝড়’। আজ ভোলা ঘূর্ণিঝড়ে নাম না জানা সেই সকল মৃত্যুবরণকারি মানুষদের জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা। তাঁদের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।
আরও পড়ুন : রাজধানী দিল্লির সব প্রাথমিক স্কুল বন্ধ
ভৌগলিক অবস্থান, জনসংখ্যার আধিখ্য,অসচেনতা,অসাবধানতা প্রভৃতি কারণে বাংলাদেশ একটি দুর্যোগপ্রবণ দেশ। এই দুর্যোগের কারণে প্রতি বৎসর বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক জীবন,সম্পদ ও প্রাকৃতিক পরিবেশের ক্ষতি সাধিত হয়েছে। মানুষের পক্ষে প্রাকৃতিক দুর্যোগ সম্পূর্ণরুপে প্রতিরোধ বা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস শুধুমাত্র উপকূলীয় অধিবাসীদের জান-মালের ক্ষয়ক্ষতি সংঘটিত করে না, সেই সাথে সমগ্র দেশের অর্থনীতির উপরেও এক বিরাট নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে থাকে। তাই, দুর্যোগের পূর্বে বাংলাদেশ বেতার, টেলিভিশন ও সিপিপি স্বেচ্ছাসেবকদের প্রচারিত আবহাওয়ার সতর্ক সংকেত শুনতে হবে এবং মানতে হবে। দুর্যোগের পূর্বে ব্যাপক প্রস্তুতি, জনসচেতনতা সৃষ্টি, দুর্যোগ চলাকালীন এবং দুর্যোগ পরবর্তী সময়ে তদনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করলে দুর্যোগে জীবন ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। যার ফলে ১৯৭০ সালে ১০ লক্ষ, ১৯৯১ সালে ১লক্ষ ৩৮ হাজার মানুষের সলিল সমাধি হলেও বর্তমানে সে মৃত্যু সংখ্যা নেমে এসেছে এক ডিজিটে। শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করে দুর্যোগে প্রাক-প্রস্তুতি গ্রহণ করি।
আরও পড়ুন : জমিতে হচ্ছে না ফল-ফসল, নেপথ্যে ইট ভাটা
লেখক : পরিচালক (অপারেশন)- ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি (সিপিপি),
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়,
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।
মোবাঃ ০১৮১১-৪৫৮৫৪৫ ও ০১৭১১-৫৮৫৮৭৫ ।
সান নিউজ/এইচএন
 
                                     
                                 
                                         
                     
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                        
                         
                                 
                                 
                                 
                                 
                                 
                                 
                                 
                                 
                     
                             
                             
                     
                         
                                 
                                 
                                 
                                 
             
                     
                             
                             
                     
                            