শিল্প ও সাহিত্য
জাপানের গল্প - ২৪

বাবা মায়ের জাপান ভ্রমণ 

পি আর প্ল্যাসিড

মিতুল নানা কারণে দেশে তার পরিবারের উপর কিছুটা ক্ষুব্ধ ছিল। অনেক কারণের মধ্যে সে একজনের সাথে ভালোবাসার সম্পর্কে জড়িয়ে ছিলো। তার সেই ভালোবাসার স্বীকৃতি সে পায়নি, একারণেই । অনেকটা বাধ্য হয়ে মিতুল জাপানে বিয়ে করে। বাধ্য বলতে তাকে কেউ বাধ্য করেনি, নিজেই বাধ্য হয়েছে।

জাপানে স্থায়ীভাবে থাকার জন্য এটা না করলে তার অন্য আর কোন উপায় ছিল না। বিয়ে করার পরেই দেশে বাবা মা ভাই বোন যেন পাগলের হাসি হাসতে শুরু করে। তাদের কথা, ভালো হয়েছে একজন বিদেশিনিকে বিয়ে করেছে। কিন্তু মিতুলের প্রশ্ন একটাই, এখানে তো তারা কেউ এসে বিয়ের ব্যপারে বাড়াবাড়ি করতে পারেনি। দেশের বেলায় কেনো তাহলে এমনটি করেছিল। বিদেশিনিকে বিয়ে করার বিষয়টি মিতুল মনে মনে মেনে নিলেও বাস্তবে মন থেকে সে মেনে নিতে পারেনি।

প্রথম দিকে তার মনে ছিল, অন্য দশজন বাংলাদেশি বিদেশে স্থায়ী ভাবে থাকার জন্য যেমনটা করে সেও না হয় সেই একই পথে হাঁটবে। কিন্তু বিয়ে করার পর মিতুল তার বিয়ে করা স্ত্রীর ব্যাপারে মনে করে, তার জন্য এটা এক লটারী। যে অর্থেই মূল্যায়ন করে মিতুল, তার বাইরে অন্য কিছু আর ভাবতে পারে না। তাই বাধ্য হয়ে এক বিয়ে, এক স্ত্রীতেই মনকে বোঝায় সে।

এক সময স্ত্রীকে নিয়ে মিতুল বাংলাদেশে বেড়াতে যায়। বেড়াতে গেলে তাকে বাংলাদেশি কায়দায় গ্রামের বাড়িতে বরণ করা হয়। বরণ করলে কি হবে, পরিবারের কারো উপর থেকে সে তার মনোভাব বদলাতে পারেনি। পরিবারে কেউ কেউ এমন ভাব দেখায় যে, তারা যেন মন থেকে মিতুলের এই বিদেশিনি স্ত্রীকে গ্রহণ করতে পারেনি। এটা বুঝতে পেরে মিতুল মন থেকে ভেঙে পড়ে। যখন সে বুঝতে পারে তার বিদেশিনি বধু তাদের বাড়ির পুরো বিষয়টি বুঝতে পেরেছে তখন সে নিজেকে অনেকটা অপরাধীর মতো মনে করে।

নিজের কাছে অনেকটা হেরে যাবার মতো স্ত্রীর সামনে ফ্রি হতে পারে না। কখন তার স্ত্রী পরিবার সম্পর্কে বা তার বাবা মা সম্পর্কে কথা বলে ফেলে, এই ভয়ে সতর্ক থাকে। কিন্তু দুই একদিন যেতে না যেতেই স্ত্রী মিতুলকে নতুন করে তার উদারতা বুঝিয়ে দিতে একদিন বলল, - পৃথিবীর সব দেশে, সব পরিবারেই এমন সমস্যা কিছু না কিছু থাকে।

আমি সবই বুঝতে পেরেছি তোমার বিষয়টি। এজন্য আমি কিন্তু কিছু মনে করিনি। বলেই আবার বলল, সম্ভব হলে আমি তোমার আগের বান্ধবীর সাথে দেখা করতে চাই। দেখা করে ক্ষমা চাইবো, আমি তার ভালোবাসার মানুষকে বিয়ে করে ফেলেছি এই জন্য।

স্ত্রীর মুখে এমন কথা শুনে মিতুল বলল, - আমার দ্বারা তোমার এই আবদারের বিষয়টি পূরণ করা সম্ভব হবে না। কারণ আমি যতোটা জানি মেয়েটি জানে আমি তার সাথে বেঈমানী করেছি। তাছাড়া সে এখন কোথায় আছে সেটা আমি জানি না। আগে যারা আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল তারা কেউই আমাকে তার বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে বলবে না। বলে মিতুল তার স্ত্রীকে বোঝায়।

একদিন মিতুলের মা আদর করে তার ছেলের বৌকে গ্রামের মেঠো পথে হাঁটতে হাঁটতে গ্রাম ঘুরিয়ে দেখায়। এ সময় দেখায় তাদের কোথায় কোন জমি আছে, সেটাও। মিতুলের স্ত্রী দেশে যাবার আগে যতটুকু বাংলা শিখেছে সেটা দিয়েই তার ভাব প্রকাশ করার চেষ্টা করে শ্বাশুড়ির সাথে।

জমি দেখিয়ে বলছে, এটা মিতুলের জমি। এটা সবার জমি। এই জমি মিতুল জাপান গিয়ে কিনেছে। মিতুলের স্ত্রী সব কথা বুঝলেও চর্চার অভাবে সে শুধু হা হু বলে উত্তর দিয়ে যায় শ্বাশুড়ির কথার পিছনে।

এরপর অন্য একদিন মিতুলের বাবা, মিতুলের স্ত্রীকে গ্রামের রাস্তায় রিক্সা করে বাজারে নিয়ে যান, তাদের গ্রাম অঞ্চলের বাজার দেখাতে। সেখানে তার পরিচিত জনদের ছেলের বিদেশিনি বধূ দেখিয়ে মনে জমিয়ে রাখা অহংকার প্রকাশ করেন। এসবই মিতুলকে তার স্ত্রী সব বলে বলল যে, - বাবা আর মা আমাকে অনেক ভালোবাসে। কিন্তু তোমার বড় ভাই বোন মনে হয় আমাকে পছন্দ করছে না। আমার কাছে তাদের ব্যবহার খুব একটা ভালো লাগে না।

মিতুল যেহেতু আগে থেকেই বিষয়টি আঁচ করতে পেরেছিল তাই তাদের বিষয়টি আর কিছু বলেনা। মিতুল তার স্ত্রীর সাথে এড়িয়ে গেলে সে নিজে থেকেই বলল, - আমি বাবা মাকে জাপান নিয়ে যাবো। জাপান গিয়ে আমাদের বাসায় কিছুদিন বেড়িয়ে আসবে। এতে তাদের ভালো লাগবে।

ঠিকই জাপান ফিরে এসে মিতুলের স্ত্রী মিতুলের বাবা মায়ের জাপান আসার যাবতীয় ব্যবস্থা করে। একদিন তাদের দাওয়াত পত্র লিখে মিতুলকে দেয় পোস্ট করার জন্য। তখন মিতুল অবাক হয়ে জানতে চাইলো তাদের জন্য যে এতো খরচ সেটা জোগাড় করবে কিভাবে? তখন মিতুলের স্ত্রী বলল, তার বোনাসের টাকা সব জমিয়ে রেখেছে। আর তার বাবা মাকে বিষয়টি বলার পর তারা বলল তাদের আসা যাওয়ার যে ভাড়া সেটা তারা বহন করবে।

তাছাড়া জাপান আসলে পর তাদের নিয়ে ঘোরার খরচও দিবে তার বড় ভাইয়েরা। একথা শুনে মিতুল অবাক হয়ে তার স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আনন্দে এক সময় চোখ টই টুম্বর হয়ে যায়। মিতুলের স্ত্রী মিতুলের মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে সে যে আবেগাপ্লুত। যে কোনো মূহুর্তে গাল বেয়ে অশ্রু ধারা বইতে পারে। তাই বিছানার পাশে রাখা টিস্যু বক্স টেনে মিতুলের দিকে এগিয়ে ধরে।

মিতুল টিস্যুর বক্স হাতে নিলে এর মধ্যে মিতুলের স্ত্রী বাংলাদেশে টেলিফোন করে সবার সাথে ভুল আর শুদ্ধ বাংলায় কথা বলে খোঁজ খবর নিতে থাকে। যতোটা পারে বড় ভাইয়ের বাসায় ফোন করে ভাবের আদান প্রদান করে। আগেই বলেছিল এসময় যেন গ্রাম থেকে মিতুলের বাবা মা ঢাকা এসে বড় ভাইয়ের বাসায় অবস্থান করেন। তাই মিতুলের স্ত্রী ফোন করে।

কিছুদিন পর তাদের পাঠানো দাওয়াত পত্র ডাক যোগে পাবার পর মিতুলের বাবা মা দূতাবাসে ভিসার জন্য দাঁড়ান। ভিসার জন্য পেপার্স সব জমা দেবার একসপ্তাহ পরেই তারা তাদের ভিসা পেয়ে টেলিফোন করে জানায় মিতুলকে। ভিসা পাবার পর তাদের যেন আর দেরি সয় না।

টাকা পাঠানোর আগেই ব্যাংক থেকে মিতুলের আগে পাঠানো টাকা তুলে সেটা দিয়ে এয়ার টিকেট কিনে নেন। এরপর সত্যি সত্যি তারা একদিন চলে আসেন জাপান। আসার দিন তারিখ এবং সময় বিস্তারিত জেনে নারিতা এয়ারপোর্ট মিতুল আর তার স্ত্রী দু'জনেই যায় তাদের রিসিভ করতে।

জাপানে মিতুলের বাবা মাকে পেয়ে তার স্ত্রী যার পর নাই ধরনের খুশি হয়। এতোটাই খুশি যে কোনো কথাই বলতে পারছিল না আনন্দ আর আবেগে। এয়ারপোর্ট থেকে বাসায় নিয়ে আসে তাদের। বাসায় আসার পর থেকেই শুরু হয় তাদের সেবা করা। যে কয়দিন জাপানে ছিলেন তারা, মিতুলের চেয়ে তার স্ত্রীই দেখভাল করেছে বেশি। যখন যা খেতে চান, যখন বাইরে কোথাও ঘুরতে যেতে চান কোন কিছুতেই অতৃপ্তি রাখতে চায়নি সে।

দুই সপ্তাহ সময় জাপান থাকার পর যখন ফিরে যাচ্ছিলেন তখন মিতুলের স্ত্রী তাদের জড়িয়ে ধরে অনেকটাই হাউ মাউ করে কেঁদে ফেলে। এমন ভাবে ছেলে মানুষের মতো করে কাঁদছিল যে, মিতুল দেখে অবাকই হয়। তার ধারণা ছিল জাপানিরা কাঁদতে জানে না। কিন্তু বাস্তবে বাঙালিদের মতোই যে আচরণ করলো নিজের বাবা মায়ের সাথে, নিজের বাবা মায়ের মতো করে আবেগ ভালোবাসায় জড়িয়ে রেখেছিল এ কয়দিন তাদের।

মিতুল তার স্ত্রীর এই আচরণ দেখে নতুন করে আবিষ্কার করে তার বিদেশিনি বধূকে। মনে মনে সে ভাবে, আজ সে বাঙালি কোন মেয়েকে বিয়ে করলেও হয়তো এতোটা ভালােবাসা তার বাবা মায়ের জন্য দেখাতে পারতো না। যতোটা দেখিয়েছে তার জাপানি বধূ।

এরপর থেকেই মিতুলের স্ত্রীর প্রতি তার ভালোবাসা আর বিশ্বাসের পরিমান অনেক বেড়ে যায়। এটা থেকেই তার মনে জন্ম নেয় নতুন ভাবনার। সে ভাবে, মানুষের জীবন একটাই।

ছোট বেলা ধর্মীয় ক্লাসে শেখা ন্যায় নীতি, আচার, আচরণ আর ভালোবাসা, সংসার, পরিবারে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার দায়িত্ব আর কর্তব্য, সব যেন প্রয়োগ করে তার স্ত্রীর প্রতি। সে থেকেই শুরু হয় তাদের সুখী দাম্পত্যের। মিতুল সবাইকে বলতে পারে, তার স্ত্রী সম্পর্কে অনেকটা অহংকার করে। এ থেকেই সে নিজেকে জাপানে একজন সুখী মানুষ হিসেবে দাবী করে, যা পরিচিত অনেককেই বলতে শোনে না এই জাপানে।

(চলবে)

লেখক, জাপান প্রবাসী সাংবাদিক।

সান নিউজ/এমএম

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

ভোলায় ছাত্রলীগের বৃক্ষরোপন কর্মসূচি পালিত 

ভোলা প্রতিনিধি: তীব্র তাপদাহ থেকে...

উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থীর গণসংযোগ

মো. নাজির হোসেন, মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি:

বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবস আজ

সান নিউজ ডেস্ক: আজ বিশ্ব ম্যালেরি...

টঙ্গীবাড়ি ভাতিজারা পিটিয়ে মারলো চাচাকে

মো. নাজির হোসেন, মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি:

গরমে ত্বক ব্রণমুক্ত রাখতে যা খাবেন

লাইফস্টাইল ডেস্ক: গরমকাল এলেই ব্র...

মাকে গলা কেটে হত্যা করল ছেলে

জেলা প্রতিনিধি: বিয়ে না দেওয়ায় চা...

পঞ্চগড়ে দুই শিশুর মৃত্যু

জেলা প্রতিনিধি: পঞ্চগড়ে চাওয়াই নদীতে গোসল করতে নেমে আলমি আক্...

চারতলা থেকে পড়ে শ্রমিকের মৃত্যু

খায়রুল খন্দকার টাঙ্গাইল : টাঙ্গাই...

শনিবার ১২ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না 

নিজস্ব প্রতিবেদক: পাইপলাইনের কাজে...

ভারতীয় ৩ কোম্পানির ওপর নিষেধাজ্ঞা

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: যুক্তরাষ্ট্র স...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা