নাজমুল হুদা : ভিক্ষাবৃত্তি সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে জ্যামিতিক হারে। সমাজের জন্য এটিকে একটি অভিশপ্ত পেশা মনে করে তা দূর করতে বাংলাদেশ সরকার এরই মধ্যে বিভিন্ন ধরণের উদ্যোগ নিয়েছে। তবে তার সফলতা নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন।
দেশকে ভিক্ষুকমুক্ত করার লক্ষ্য নিয়ে ২০১০ সালে ভিক্ষুক পুনর্বাসন প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। তবে গত ৯ বছরেও এই প্রকল্প থেকে কাঙ্ক্ষিত ফল আসেনি। এর মধ্যে একাধিকবার উদ্যোগ নিয়ে কিছু কিছু ভিক্ষুককে নিজ নিজ জেলায় বিকল্প কর্মসংস্থানের মাধ্যমে পুনর্বাসিত করা হয়েছে। তবে সেই পুনর্বাসনও স্থায়ী হয়নি। অনেক ভিক্ষুকই আবার ফিরে এসেছে আগের পেশায়।
সমাজসেবা অধিদফতর বলছে, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে ওঠার যোগ্যতা অর্জন করলেও হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর ভিক্ষাবৃত্তি দেশের এগিয়ে যাওয়ার পথে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা। এদিকে অধিদফতরের পরিসংখ্যানই বলছে, সারাদেশে প্রায় সাড়ে সাত লাখ ভিক্ষুক রয়েছে। এদের অর্ধেকেরই বসবাস রাজধানীতে। তবে বেসরকারি হিসাবে সারাদেশে ভিক্ষুকের সংখ্যা ১০ লাখেরও বেশি।
এই প্রকল্পে শুরুর দিকে ব্যাপক তাড়াহুড়ো করে ভিক্ষুক ও ভবঘুরেদের জরিপ করা হয়, ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে তাদের পুনর্বাসনের চেষ্টাও করা হয়। কিন্তু চার বছরের মাথায় স্তিমিত হয়ে পড়ে সে কার্যক্রম। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর প্রথম চার বছরে ২৪ কোটি ৮২ লাখ বরাদ্দ দেওয়া হলেও ভিক্ষুকদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ তেমন ফলপ্রসূ হয়নি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই প্রকল্পে সরকারের বরাদ্দ কমেছে।
পুনর্বাসন বরাদ্দের চিত্র
সমাজসেবা অধিদফতরের তথ্য বলছে, ভিক্ষুক পুনর্বাসন প্রকল্পের জরিপ পরিচালনা ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যয় হিসাবে ২০১০-১১ অর্থবছরে বরাদ্দ দেওয়া হয় ৩ কোটি ১৬ লাখ টাকা, এর পরের অর্থবছরে (২০১১-১২) ছয় কোটি ৭০ লাখ টাকা। ২০১২-১৩ অর্থবছরে এই প্রকল্পে ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হলেও পরের অর্থবছরে বরাদ্দ কমে দাঁড়ায় এক কোটি টাকায়। তবে এ বছর কোনো অর্থছাড় করা হয়নি প্রকল্পে। অর্থাৎ ২০১২-১৩ অর্থবছরে প্রকল্পের আওতায় নামমাত্র কিছু কাজ হলেও ২০১৩-১৪ অর্থবছরে এই প্রকল্পের কোনো কাজই হয়নি। এর পরের তিন অর্থবছরেই এই প্রকল্পে বরাদ্দ ছিল ৫০ লাখ টাকা করে।
অধিদফতরের তথ্য বলছে, পরের দুই অর্থবছর অর্থাৎ ২০১৭-১৮ ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল তিন কোটি টাকা করে। এর মধ্যে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এসে দেশে প্রথমবারের মতো ৫৮ জেলায় দুই হাজার ৭১০ জন ভিক্ষুকের পুনর্বাসনের জন্য অর্থ পাঠানো হয় । ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৫৮ জেলা থেকে জেলা প্রশাসক ও জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের যৌথ স্বাক্ষরিত চাহিদাপত্রে দুই লাখ তিন হাজার ৫২৮ জন ভিক্ষুককে পুনর্বাসনের জন্য ৪২২ কোটি ২২ লাখ টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়। এর বিপরীতে পরের অর্থবছরে বরাদ্দ পাওয়া যায় মাত্র তিন কোটি টাকা।
উদ্দেশ্য ভিক্ষুকমুক্ত রাজধানী
প্রথমে ভিক্ষুক পুনর্বাসন প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল রাজধানী ঢাকাকে ভিক্ষুকমুক্ত করা। এই প্রকল্পের পরিচালক জানান, ঢাকায় ভিক্ষাবৃত্তি ঠেকাতে প্রাথমিকভাবে সরকার কিছু এলাকাকে ভিক্ষুকমুক্ত ঘোষণা করে। এলাকাগুলোর মধ্যে রয়েছে বিমানবন্দরে প্রবেশ পথের পূর্ব দিকের চৌরাস্তা, বিমানবন্দর পুলিশ ফাঁড়ি ও এর আশপাশের এলাকা, হোটেল রেডিসান সংলগ্ন এলাকা, ভিআইপি রোড, বেইলি রোড, হোটেল সোনারগাঁও ও হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল সংলগ্ন এলাকা এবং কূটনৈতিক জোন। এসব স্থানে ভিক্ষুকমুক্ত প্লাগস্ট্যান্ড লাগানো হয়, শুরুর দিকে মাইকিং লিফলেটও বিতরণ করা হয় ।
কতটা ভিক্ষুকমুক্ত হয়েছে রাজধানী
ঘোষণার পরেও বিমানবন্দর, ভিআইপি রোড বা কূটনৈতিক জোনগুলো ভিক্ষুকমুক্ত হয়নি। বরং শুরুর দিকে ভিক্ষুকদের আনাগোনা এসব এলাকায় কম থাকলেও এখন সংখ্যা বেড়েছে।
বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা গেছে, গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোর সিগন্যাল, ফুটপাত, বাজার, রেল ও বাস স্টেশন, এমনকি ফুটওভার ব্রিজ থেকে শুরু করে আন্ডারপাসও চলে গেছে ভিক্ষুকদের দখলে। ভিক্ষুকদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় যত্রতত্র বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সমাজকল্যাণ অধিদফতরের উদ্যোগে যে স্বল্পসংখ্যক ভিক্ষুককে পুনর্বাসনের আওতায় গ্রামে কিংবা বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছিল, তা কোনো সুফল বয়ে আনেনি। পুনর্বাসিত ভিক্ষুকরা আশ্রয়কেন্দ্র থেকে পালিয়ে ফের ভিক্ষাবৃত্তিতে ফিরেছেন। ভিক্ষুকদের ধরতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রমও এখন আর দৃশ্যমান নয়।
আশ্রয়কেন্দ্র কতটা সচল
প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ শাহজাহান বলছেন ,ভবঘুরে, ভিক্ষুক ও আশ্রয়হীনদের জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানে মোট ৬টি আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে। এর মধ্যে মানিকেগঞ্জে পুণর্বাসনকেন্দ্রটি রয়েছে জরাজীর্ণ অবস্থায় । গাজীপুরের ২ টি, মিরপুর, নারায়নগঞ্জ, ময়মনসিংহে ১টি করে মোট ৬টি পুণর্বাসনকেন্দ্রে ১৭শো জনের থাকার মতো ব্যবস্থা রয়েছে। তবে এগুলোতে বর্তমান রয়েছে ৮৯৭ জন। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে গত ৯ বছরে ৬ হাজার ১৪৭ জন ভবঘুরে ও ভিক্ষুক সরকারি সুবিধা পেয়েছে বলে জানিয়েছে সমাজসেবা অধিদপ্তর । এসব আশ্রয়কেন্দ্রের পেছনে প্রায় আট কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। কিন্তু জনবল ও বাজেটের ঘাটতির কারণে আশ্রয়কেন্দ্রগুলো চালু রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে।
ভিক্ষুক পুণর্বাসন পুরোপুরি সফল না হওয়ার কারণ হিসেবে যথেষ্ঠ বরাদ্দ আর জনবলের অভাবকে দায়ী করছেন প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ শাহজাহান। তিনি বলেন, যে সামান্য বরাদ্দ ছিল, তা দিয়ে গত বছরে ২০টির মতো ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়। তবে বরাদ্দের অভাবে ব্যাপক পরিসরে এই কার্যক্রম চালানো সম্ভব হচ্ছে না বলে জানান তিনি। নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাও সম্ভব হচ্ছে না।
সার্বিকভাবে ভিক্ষুক পুনর্বাসন প্রকল্প নিয়ে জানতে চাইলে সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ দাবি করেন, ভিক্ষুক পুনর্বাসন প্রকল্পের কার্যক্রম অব্যাহত আছে। এই প্রকল্পকে আরও ব্যাপক পরিসরে নিয়ে আসতে চান তারা। সরকার হতদরিদ্রের সংখ্যা শূন্যে নামিয়ে আনতে চায়।
তবে মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন সান নিউজকে বলেন, যেভাবে ভিক্ষুকদেরকে পুণর্বাসনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তাতে খুব বেশি কাজ না হওয়ারই কথা। কারণ শুরু থেকে দেখা গেছে, তাদেরকে এমনভাবে নেয়া হয়েছে যেন তারা একটা অপরাধী গোষ্ঠির মানুষ। প্রায় আটক করার মতো তাদেরকে তুলে তুলে নেয়া হয়েছে। পুণর্বাসন কেন্দ্রের নামে তাদেরকে যেখানে তোলা হয়েছে সেখানে তাদেরকে সংশোধনের কোন ব্যবস্থা রাখা হয়নি। যারা এই কাজটির সঙ্গে জড়িত তাদের মধ্যে যে ধরণের আন্তরিকতা, দক্ষতা এবং নৈতিক দৃঢ়তা থাকার কথা, তার অনেক কিছুতেই ঘাটতি রয়েছে বলে মনে করেন তিনি।