অন্তরা আফরোজ: আনন্দ, মুক্তি, ইতিহাস, প্রাপ্তি! দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর আমরা পেয়েছি আনন্দের উপলক্ষ। পেয়েছি মুক্তির স্বাদ, ইতিহাসের পাতায় অমরত্বের প্রাপ্তি। ভাষার জন্য কোন মাটি আর এতটা রক্তাক্ত হয়েছিল? উত্তর সবার জানা, হয়নি কোথাও। ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর সকালের প্রথম সূর্যের আলো যত প্রখর ছিল, পৌষের নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া যত আপন ছিল, মায়ের শাড়ির মতো বিছানো মাটির ঘ্রাণ যতটা সুবাসিত ছিল; এসব তো একদিনে পাওয়া হয়নি।
আরও পড়ুন: বিজয় দিবস বাঙালির শৌর্য-বীর্যের প্রতীক
বর্তমান প্রজন্ম ইতিহাসকে জানতে চায় না, শুনতে চায় না। আমাদের দায়ও কম নয় তাতে। ইতিহাসের চর্চা করি না আমরা। অথচ প্রসব বেদনায় কাতর বাংলা মায়ের প্রতিটি মুহূর্ত নিয়ে লেখা যাবে হাজার কাব্য। ১৬ই ডিসেম্বর, কেবল একটি দিন নয়। বিজয় দিবস নয়। দীর্ঘ ইতিহাসের আখ্যান। পেছনের ইতিহাস জানি কজন?
১৯৪০ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের অধিবেশনে ভারতবর্ষের মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসভূমি গঠনের প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। যে প্রস্তাবটি উত্থাপন করেছিলেন শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হক। বলা হয়, একাধিক সার্বভৌম মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের দাবি জানানো হয়েছিল সেই প্রস্তাবে। তারপর ছয় বছর পেরিয়েছে। নানা আলোচনা-সমালোচনা, ঝড়-ঝঞ্ঝার পর ১৯৪৬ সালের দিল্লি অধিবেশনে এ প্রস্তাবটি সংশোধন করা হয়। এরপর উড়িয়ে আনা হয় ইংরেজ বিচারক স্যার সেরিল রেডক্লিফকে। ভারতবর্ষের সীমানা ভাগ করার দায়িত্ব পড়ে তার ওপর। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, সেরিল রেডক্লিফ সেবারের আগে কখনও ভারতবর্ষেই আসেননি। এমনকি তার ছিল না ভালো করে ম্যাপ পড়ার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যা কিংবা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। এমন একজনের হাতে তৈরি হলে সীমানা। জন্ম নিল দুটি দেশ। ভারত-পাকিস্তান। আদতে তিনটি। পূর্ব পাকিস্তান সেই শুরু থেকে আলাদা। পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের মাঝে প্রায় ১৩৭০ মাইলের দুরত্ব। মিল নেই মানুষের জীবন সংস্কৃতি, ভাষা ও আনন্দ-বেদনার অনুভূতিতে।
আরও পড়ুন: দেশনায়ক থেকে বিশ্বনায়ক
সেই থেকে শুরু। পশ্চিমের শোষণ, পূর্বের প্রতিবাদ। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে উত্তাল গোটা লাল-সবুজের ভূখণ্ড। দিশেহারা পশ্চিম পাকিস্তান চালাল নারকীয় গণহত্যা। ২৫ মার্চের সেই কালরাত্রির আগে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চেই ভাষণ বাঙালিকে দেয় এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা। তাই, অপারেশন সার্চলাইট পারেনি বাংলাকে দমাতে। বরং, জাগিয়েছে ঘুমন্ত বাঙালিকে। বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে মেজর জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণায় টগবগ করে ফুটতে থাকে গোটা বাংলা।
ত্রিশ লাখ শহীদ, দুই লাখ বীরাঙ্গনার ত্যাগ তো কেবল কাগজের পাতায় উল্লেখিত। বাংলার আনাচে কানাচে আরও কতজন বেনামে নিজেকে বিলিয়েছেন ভাষার জন্য, মায়ের মুখের বুলি আওড়ানোর সুখের জন্য, তার হিসেব নেই। বেলা শেষের আগে পরাজয় নিশ্চিত জেনে ১৪ ডিসেম্বর রাতে বাংলাকে পঙ্গু করতে চেয়েছিল পাক হানাদাররা। বুদ্ধিজীবীদের শেষ করে দিয়েছে। বাংলাদেশ তাতে পিছিয়েছে বটে, হার মানেনি।
ইতিহাসকে ধারণ করতে গেলে জানতে হয়। দেশকে ভালোবাসতে গেলে অতীতকে কাছে টেনে নিতে হয়। ১৬ ডিসেম্বর একদিন নয়, এই বিজয় আমাদের সবার জীবনে সবসময় নিয়ে আসুক এগিয়ে চলার শক্তি।
লেখক : গণমাধ্যম কর্মী।