ফিচার

বিলুপ্তির পথে মৃৎশিল্প

নিজস্ব প্রতিবেদক : ‘আমি মাটির জিনিসপত্র তৈরি শিখেছি আমার বাবার কাছে, সে শিখেছে তার বাবার কাছে। এভাবেই বংশ পরম্পরায় একজনের পর একজন হাল ধরে কুমার পল্লী সজীব রেখেছে পাল বংশের লোকজন। কিন্তু এখন আর সেই অবস্থা নেই। আমি মারা যাবার পর হাল ধরার মতো আর কেউ নেই। আশেপাশের সবাই এ ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছে। আমার ছেলেপুলেরাও কেউ আর এ কাজ করতে আগ্রহী না। এরকম করে একসময় হয়তো কালের স্রোতে মাটির এই শিল্পই হারিয়ে যাবে।’ — খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে উদাস নয়নে একরাশ আক্ষেপ আর দুঃখ ভরাট কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন মৃৎশিল্পী কার্তিক পাল।

আধুনিক ধারার প্রবাহে হারিয়ে যেতে বসা আবহমান বাংলার ঐতিহ্যের ধারক মৃৎশিল্পের সঙ্গে নিজের জীবনের পুরোটা সময় কাটিয়ে জীবন সায়াহ্নে এসেও মাটির মায়া ত্যাগ করতে পারেননি ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধ এই মৃৎশিল্পী।

গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজেলা সদর থেকে ৬ কিলোমিটার উত্তরে শীতলক্ষ্যা নদীর বানার অংশের পাড়ের শতবর্ষী হাট বরমী বাজার। প্রাচীন এই বাজারে ছোট্ট একটি টিনের ঘরে মাটির তৈরি বিভিন্ন জিনিসপত্র নিয়ে চৌদ্দপুরুষের পেশাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন তিনি। একসময় কাঁচামাল সংগ্রহ করে নিজেই তৈরি করতেন সবকিছু। কিন্তু বর্তমানে কাঁচামালের অতিরিক্ত দাম আর বয়োবৃদ্ধ শরীর নিয়ে আগের মতো সবকিছু তৈরি করতে পারেন না। বিভিন্ন এলাকা সংগৃহীত জিনিসপত্রই এখন দোকানের সম্বল।

জানালেন, এ বাজারেই একসময় কুমারের সরব আনাগোনা ছিল। মাটির তৈরি বাহারি সব পণ্যের অসংখ্য দোকান ছিল। প্রতি বুধবার হাটের দিন নদীর পাড়ে ঘেঁষত বড় বড় নৌকা। সেসব নৌকা বোঝাই হয়ে স্থানীয় কুমারদের তৈরি মাটির পণ্য ছড়িয়ে পড়তো দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। কিন্তু সেসব এখন কেবলই স্মৃতি। অধিকাংশ কুমার ছেড়ে দিয়েছেন চৌদ্দপুরুষের পেশা। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরের এ মাটির সঙ্গে মিতালী সবাই ছেড়ে দিলেও ছাড়তে পারেননি কার্তিক পাল।

গল্পে গল্পে জানালেন কেমন করে মাটির সঙ্গে তৈরি হয়েছে হৃদয়ের বন্ধন। বললেন— ‘ছোট্ট বেলায় বাবা মায়ের কাছেই হাতেখড়ি হয়েছে আমার। সত্তরের দশকের সেসময় মাটির তৈজসপত্রের ছিল ব্যাপক চাহিদা। গ্রামে-গঞ্জে মানুষের নিত্য প্রয়োজনীয় গৃহস্থালি সামগ্রীর অধিকাংশই ছিল মাটির তৈরি।

যার ফলে মানুষের কাছে মাটির জিনিসপত্রের চাহিদাও ছিল প্রচুর। আর সারাবছরই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পর্যায়ক্রমে মেলা লেগেই থাকতো। সে-সব মেলাতে মানুষের মূল আগ্রহই থাকতো মাটির হাড়ি, কলসি, পুতুল, ঢাকনা, পিঠার খোলাসহ নানান জিনিসপত্রের দিকে। সবচেয়ে বেশি ব্যস্ত সময় পার করতে হতো পহেলা বৈশাখের আগে। চৈত্রের শুরুতেই পুরো কুমারপাড়া জুড়ে শুরু হতো ব্যস্ততা। কাজের চাপে দম ফেলার ফুরসত ছিল না। চারপাশে উৎসব উৎসব আমেজ থাকতো।

তবে বর্তমান সময়ে হিসেবটা ঢের ভিন্ন। এসব শুধুই স্মৃতি। বাজারে এখন আর আগের মতো মাটির জিনিস পত্রের চাহিদা নেই। মাটির জায়গা দখল করে নিয়েছে দস্তা, অ্যালুমিনিয়াম ও প্লাস্টিক। যার ফলে ক্রেতারা মাটির জিনিসপত্র আগের মতো আগ্রহের সঙ্গে আর নেয় না। শহরাঞ্চল দূরে থাক অজোপাড়াগাঁয়েও এখন আর মাটির হাড়ি-পাতিল চোখে পড়ে না। আর আগে যেমন নিজে সব তৈরি করতাম এখন আর তা সম্ভব হয়ে উঠে না।

একটা সময় ছিল যখন আমরা মাটির জিনিসপত্র তৈরির কাঁচামাল প্রকৃতি থেকে বিনামূল্যে সংগ্রহ করতাম। কিন্তু সেই বাস্তবতা এখন নেই। এখন শিল্পকর্মের জন্য কিনতে হয় মাটি। এরপর তা তৈরি করে আগুনে পোড়ানোর জন্য লাকড়ির প্রয়োজন হয়। বাজারে লাকড়ির দামও খুব বেশি। এসব বিবেচনায় এখন আর অল্প পরিমাণে ওসব তৈরিতে আগ্রহ নেই।’

তবে অবস্থা যেমনই হোক, দিনের পর দিন মাটির সঙ্গে কার্তিক পালের বন্ধন সুদৃঢ় হয়েছে। অনেকেই যখন অভাবের তাড়নায় আয় রোজগার কমে যাওয়ায় চৌদ্দপুরুষের এ পেশা ছেড়েছেন, তখনও মাটির প্রতি গভীর ভালোবাসা আর মমত্ববোধের টানে ছেড়ে যাননি বাপ-দাদার হাতে শেখা এই শিল্পকর্ম।

অবশ্য মৃৎশিল্পীদের পেশা পরিবর্তনের চিত্র সারাদেশেই একই রকম। যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মাটির জিনিসপত্র তার পুরোনো ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলছে। যার ফলে এ পেশার সঙ্গে যারা জড়িত এবং যাদের জীবিকার একমাত্র অবলম্বন মৃৎশিল্প বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের জীবন যাপন একেবারেই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। দুঃখ কষ্টের মধ্যে দিন কাটছে তাদের।

এত হতাশার মধ্যেও বৃদ্ধ মৃৎশিল্পী কার্তিক পাল স্বপ্ন দেখেন কোনো একদিন হয়তো আবারও কদর বাড়বে মাটির পণ্যের। সারাদেশে আবারও ফিরে আসবে মৃৎশিল্পের সুদিন। সেই সুদিন ফিরিয়ে আনতে এবং মৃৎশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে এর বাজার সৃষ্টি এবং প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতার কথাও বললেন তিনি। সবশেষ বললেন, ‘যতদিন বাঁচবো এ মাটিকে আঁকড়ে ধরেই বাঁচতে চাই।’

সান নিউজ/এসএম

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

কোরআন-সুন্নাহর শাসনই চূড়ান্ত লক্ষ্য: জামায়াত আমির

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বল...

সচিবালয়ের পথে শিক্ষকরা, কর্মবিরতি গড়াল দ্বিতীয় দিনে

২০ শতাংশ বাড়িভাড়া ভাতা বৃদ্ধির দাবিতে বেসরকারি এ...

মিডিয়ার হাতে গোপনীয়তা খুন!

জনপ্রিয় কনটেন্ট ক্রিয়েটর রিপন মিয়া অভিযোগ করেছেন,...

স্বাধীনতার কোনো মূল্য হয় না; এটা অমূল্য

ইসরায়েলের কারাগারে বন্দিজীবন থেকে মুক্তি পাওয়া ফ...

বিচার ব্যবস্থায় নতুন যুগ, শুরু অনলাইন জামিননামা কার্যক্রম

হয়রানির অবসানে জামিন কার্যক্রমে যুক্ত হচ্ছে প্রযুক...

এবার পরিবার নিয়ে প্রকাশ্যে এলেন রিপন মিয়া

আলোচনার কেন্দ্রে থাকা কনটেন্ট ক্রিয়েটর রিপন মিয়া এবার মা, স্ত্রী ও সন্তানদের...

শিপ ব্রেকার্স নির্বাচনের ফল ঘোষণার আগেই কমিশনের পদত্যাগ

বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যান্ড রিসাইক্লার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসবিআরএ) বহুল আ...

ঢাকা কলেজের ঐতিহ্য রক্ষায় প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের ১০ দাবি

ঢাকা কলেজের ঐতিহ্য রক্ষা এবং ঢাকা সেন্ট্রাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিতর্কিত খসড়া অধ্...

ওয়ানডে র‌্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষ বোলার এখন রশিদ খান 

বাংলাদেশকে হোয়াইটওয়াশের পর ওয়ানডের বোলারদের র‌্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষস্থান দখল...

চলমান চাকসু নির্বাচনে কর্মকর্তার সই ছাড়াই ৪০০ ব্যালট বাক্সে

চাকসু নির্বাচনে বিনির্মাণ শিক্ষার্থী ঐক্য প্যানেলের নির্বাচন পর্যবেক্ষক তৌহিদ...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা