গাইবান্ধা প্রতিনিধি: গাইবান্ধার একমাত্র কৃষিভিত্তিক শিল্প কারখানা গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার মহিমাগঞ্জের রংপুর চিনিকল।
আরও পড়ুন: ধান কুড়াচ্ছি, পিঠা বানামু
লোকসান কমাতে আধুনিকায়নের মাধ্যমে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে উন্নীত করার কথা বলে গত ২০২০ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প কর্পোরেশনের নিয়ন্ত্রণাধীন ১৫ টির মধ্যে যে ৬ টি চিনিকলে মাড়াই কার্যক্রম বন্ধ করা হয়, তার মধ্যে অন্যতম রাষ্ট্রায়ত্ত এ চিনিকলটি।
সে সময় ২০২০-২১ বার্ষিক আখ মাড়াই মৌসুম শুরুর সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেও সর্বোচ্চ মাড়াই ক্ষমতা ও বিপুল পরিমাণ জমিতে দণ্ডায়মান আখ জমিতে রেখে একেবারে শেষ মুহূর্তে বন্ধ করার সিদ্ধান্তে বিক্ষুব্ধ আখচাষী ও শ্রমিক-কর্মচারীরা ব্যাপক আন্দোলন করে।
শ্রমিক আন্দোলন বা চাষীদের করুণ আকুতিকে বৃদ্ধাগুলি দেখিয়ে মাড়াই কার্যক্রম বন্ধ করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে শ্রমিক-কর্মচারী ও আখচাষীদের।
আরও পড়ুন: হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামীণ পিঠাপুলির উৎসব
তখন আন্দোলনরত শ্রমিক-কর্মচারী ও চাষীদের উদ্দেশে দেশের প্রায় সব জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানানো হয়েছিল, আধুনিকায়নের মাধ্যমে খুব দ্রুতই চালু করা হবে এ চিনিকলসহ সব কয়টি চিনিকল।
প্রায় ১ হাজার শ্রমিক-কর্মচারী ও কর্মকর্তা এবং ৫০ হাজার চাষী ছাড়াও বিভিন্নভাবে সম্পৃক্ত লক্ষাধিক মানুষের জীবিকা অর্জনের মাধ্যম রংপুর চিনিকলটি চালু হয়নি ৩ বছরেও। বরং এ চিনিকলের স্থায়ী চাকরিজীবীদের একাংশ, গাড়ি, যন্ত্রাংশ ও নানা প্রয়োজনীয় মালামাল সরিয়ে নেওয়া হয়েছে অন্য চিনিকলে।
কাজ হারানো মজুরি চুক্তিভিত্তিক অর্ধ সহস্রাধিক শ্রমিকরা এখন পেটের দায়ে ভ্যান-রিক্সা চালনাসহ বিভিন্ন কাজ করে মানবেতর জীবনযাপন করছে।
আরও পড়ুন: জ্বালানি খরচ বৃদ্ধি, হুমকিতে কৃষিক্ষেত্র
গত ৩ বছর বন্ধ থাকায় ৩৫ একর আয়তনের কারখানার চত্ত্বর ভরে গেছে জঙ্গলে। এ দৃশ্য দেখলে মানুষের সরব উপস্থিতির অভাব নিশ্চিত হওয়া যায় খুব সহজে। খোলা আকাশের নিচে অযত্ন-অবহেলায় পড়ে থাকা আখ পরিবহনের যানবাহনগুলোও ধ্বংসের পথে। কারখানার ভেতরের দৃশ্যটাও একই রকম।
কোটি কোটি টাকা মূল্যের যন্ত্রপাতিতে এখন মরিচার রাজত্ব। থমকে আছে জীবিকার চাকাগুলো। আখচাষী আর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিত্যদিনের সমাবেশের চিরচেনা দৃশ্য আর নেই।
হাজারো মানুষের এক সময়ের জীবন-জীবিকার কেন্দ্রস্থলের প্রবেশপথ ও মিলে আখ সরবরাহের জন্য শত শত সারিবদ্ধ গাড়ির বিশাল প্রাঙ্গণটি এখন গো-চারণ ভূমি।
আরও পড়ুন: আগাম শিম চাষে লাভবান শার্শার কৃষক
স্থানীয়রা বলেন, ১৯৫৪ সালে তৎকালীন রংপুর জেলার গাইবান্ধা মহুকুমার গোবিন্দগঞ্জ থানার মহিমাগঞ্জে শুরু হয় রংপুর চিনিকলের নির্মাণকাজ। ২৬১ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩ বছর পর শেষ হয় মিলটির নির্মাণকাজ। ১৯৫৭-৫৮ মৌসুম থেকেই আখ মাড়াইয়ের মাধ্যমে চিনি উৎপাদন শুরু হয় মিলটিতে।
পশ্চিম জার্মানির বাকাউ-উলফ নামের একটি কোম্পানি থেকে আনা মেশিনে ৩৫ একর জায়গা জুড়ে গড়ে ওঠে মিলের কারখানা ও কার্যালয়। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রংপুর চিনিকলসহ সব চিনিকলকে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঘোষণা করেন।
এ চিনিকলের কর্মকর্তাদের জন্য আবাসিক স্থাপনা গড়ে তোলা হয়। পুকুরসহ রেলওয়ে সাইডিংয়ের জায়গা ৮ একর, সাড়ে ১৪ একর জায়গায় গড়ে ওঠে ৫০ টি ইক্ষু ক্রয় কেন্দ্র এবং ৮ টি সাবজোন। এছাড়া মিলের নিজস্ব খামারের জমির পরিমাণ ১৮৩২ একর।
আরও পড়ুন: সুন্দরবনে রেঞ্জ অফিস চত্বরে বাঘ
১৯৫৭-২০২০ সাল পর্যন্ত ৬৩ বছরে ২২ হাজার ৯৮৫ দিনের মধ্যে ৫৭৩৯ দিন ঘোরে মিলের চাকা। এ সময়কালে ৫৬ লক্ষ ৩৫ হাজার টন আখ মাড়াই করে উৎপাদন করা হয় ৪ লক্ষ ২৭ হাজার টন চিনি।
রংপুর চিনিকলের ছিল নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা। এখানকার পাওয়ার হাউসে উৎপাদিত বিদ্যুৎ রেলস্টেশনসহ বিভিন্ন জায়গায় সরবরাহ করা হতো।
চিনিকলের আখ পরিবহনের জন্য ছিল নিজস্ব রেলপথ। সেই রেলপথে নিজস্ব রেলের ইঞ্জিন ও মালবাহী বগি দিয়ে পরিবহন করা হতো আখ, চিনি, চিটাগুড় ও জ্বালানিসহ নানা দ্রব্য।
আরও পড়ুন: ফকিরহাটে লতিরাজ কচু চাষে কৃষকের সাফল্য!
রংপুর চিনিকলকে কেন্দ্র করে জাঁকজমকপূর্ণ ছিল মহিমাগঞ্জ রেল স্টেশন। তখন বিখ্যাত বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে মহিমাগঞ্জ। শিক্ষার প্রসারেও অন্যতম ভূমিকা রাখে রংপুর চিনিকল উচ্চ বিদ্যালয়।
সবকিছু মিলিয়ে চিনিকলের শ্রমিক-কর্মচারী, আখচাষীসহ অসংখ্য মানুষের আয়-রোজগারের পথ সৃষ্টি করেছিল রংপুর চিনিকল।
বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, ৯০-এর দশকে তৎকালীন এরশাদ সরকারের শাসনামলে আধুনিকায়নের নামে কর্মকর্তাদের জন্য দামি গাড়ি-বাড়ি, এ্যাম্বুলেন্স ও কারখানার কিছু সংস্কারের জন্য বিশ্ব ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ দেওয়া হয় বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প কর্পোরেশনের আওতাধীন চিনিকলগুলোকে।
আরও পড়ুন: রংপুর বিভাগে বাল্যবিবাহের হার ৬৮.৮
এসব ঋণ এখন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে চিনিকলগুলোর। রংপুর চিনিকলের বর্তমানে ৫০০ কোটি টাকা পুঞ্জীভূত লোকসানের প্রধান কারণ বিশ্ব ব্যাংকের এ ঋণ বলে অভিযোগ করেছেন তারা।
রংপুর চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ইনচার্জ) মাসুমা আকতার জাহান বলেন, চালু অবস্থায় এ চিনিকলের শ্রমিক-কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের জন্য বেতনভাতা বাবদ মাসে প্রায় ১ কোটি টাকা প্রয়োজন হতো।
সরকারি সিদ্ধান্তে মাড়াই বন্ধ হওয়া এ চিনিকলের বিপুল পরিমাণ সম্পদ রক্ষায় বর্তমানে ৭ জন স্থায়ী কর্মকর্তা ও ৭৫ জন অস্থায়ী শ্রমিক-কর্মচারীর বেতনভাতা ১৮ লক্ষ টাকা।
আরও পড়ুন: ফুলের চারায় ইমরানের বাজিমাৎ!
রংপুর চিনিকল শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক ফারুক হোসেন ফটু বলেন, দেশের কৃষক- শ্রমিকদের স্বার্থের বিপরীতে গিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত চিনি শিল্প বন্ধ করে দেওয়ার গভীর চক্রান্ত চলছে।
চিনিকলটি বন্ধ হয়ে থাকায় এ জনপদের সব স্তরে অন্ধকার নেমে এসেছে। কৃষক ও শ্রমিকবান্ধব বর্তমান সরকার অসাধু সিন্ডিকেটের ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে পুনরায় চিনিকলটি আধুনিকায়নের মাধ্যমে চালুর পদক্ষেপ গ্রহণ করার দাবি করেন তিনি।
আখচাষী ফেরদৌস আলম অভিযোগ করেন, রংপুর চিনিকলের চেয়ে অনেক কম মাড়াই ক্ষমতাসম্পন্ন জয়পুরহাট চিনিকলের আখজোন এলাকায় আখও উৎপাদন হয় কয়েকগুণ কম।
আরও পড়ুন: কৃষিতে উদ্যোক্তা তৈরি করে যাচ্ছেন সাইদুল ইসলাম
তারপরও মিলটি চালু রেখে ৫০-১০০ কি.মি. দূরের রংপুর চিনিকলের আখ এবং ১৫০-২০০ কিলোমিটার দূরের শ্যামপুর চিনিকলের আখ জয়পুরহাটে পরিবহন করতে অতিরিক্ত ব্যয় হচ্ছে। জয়পুরহাট ও শ্যামপুরের মধ্যবর্তী স্থানের রংপুর চিনিকলটি চালু রাখলে সরকারকে এই অতিরিক্ত টাকা ব্যয় করতে হতো না।
চিনিশিল্প রক্ষার পাশাপাশি বন্যা-ভাঙনসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যন্ত জনপদ গাইবান্ধার মানুষের কর্ম সংস্থানের জন্য দ্রুত রংপুর চিনিকলসহ বন্ধ সব চিনিকল চালু করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন এলাকার কৃষক ও শ্রমিক-কর্মচারীসহ সব স্তরের মানুষ।
সান নিউজ/এনজে
