জাতীয়

সাংবাদিক রোজিনাকে গ্রেফতারে বিশিষ্টজনদের উদ্বেগ

নিজস্ব প্রতিবেদক: অফিসিয়াল সিক্রেট অ্যাক্টে প্রথম আলোর সিনিয়র সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত সোমবার সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম সচিবালয়ে পেশাগত দায়িত্ব পালনে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে যান। সেখানে বেলা তিনটার দিকে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা তাকে একটি কক্ষে আটক করেন। পরে রাত সাড়ে আটটার দিকে রোজিনা ইসলামকে শাহবাগ থানার পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তাকে রাত নয়টার দিকে শাহবাগ থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। পরে রাত পৌনে ১২টার দিকে রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় মামলা করা হয়। গততকাল মঙ্গলবার রোজিনা ইসলামের রিমান্ড নাকচ করে তাকে কাশিমপুর মহিলা কারাগারে পাঠান ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালত। আগামীকাল বৃহস্পতিবার তার জামিনের শুনানি হতে পারে।

রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩৭৯ ও ৪১১ ধারায় এবং অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের ৩ ও ৫ ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে। গত সোমবার রাতে শাহবাগ থানায় দায়ের করা মামলাটির বাদী স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের উপসচিব শিব্বির আহমেদ ওসমানী। সেই মামলায় রোজিনা ইসলামকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

রোজিনা ইসলামকে হেনস্তা ও তার বিরুদ্ধে মামলার পরপরই দেশে-বিদেশে বিক্ষোভ হয়। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও মানবাধিকার সংগঠন বিবৃতি দিয়ে তার বিরুদ্ধে করা মামলা প্রত্যাহার ও তার মুক্তির দাবি জানিয়েছে।
দেশেও সাংবাদিক সমাজ ও সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠনের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা রোজিনা ইসলামের মুক্তির দাবি জানাচ্ছেন। চলমান রাখছেন বিক্ষোভ, প্রতিবাদ ও বিভিন্ন আন্দোলন কর্মসূচি।

ডিজিটাল সিকিউরিটি এ্যাক্ট প্রনয়ণের শুরু থেকেই এ আইনের বিপক্ষে সাংবাদিক সমাজ, সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন এমনকি সম্পাদক পরিষদও উদ্বেগ ও প্রতিবাদ জানিয়ে আসছিলেন। সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের হেনস্থা ও গ্রেফতারের পর আবারও আলোচনায় উঠে এসেছে এই কালো আইনের বিষয়টি। সাননিউজের পক্ষ থেকে কয়েকজন বিশিষ্ট সিনিয়র সাংবাদিক, শিক্ষক ও রাজনীতিকের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বললে তারা নিজেদের উদ্বেগের কথা প্রকাশ করেন।
সিনিয়র সাংবাদিক রিয়াজউদ্দিন আহমেদ বলেন, অবশেষে আমাদের আশঙ্কাই সত্য প্রমাণিত হলো। অফিসিয়াল সিক্রেট অ্যাক্টে রোজিনা ইসলামকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয়েছে। তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। ইংরেজ শাসনামলে যে আইন করা হয়েছিল সত্য গোপন করার জন্য, অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে ১৯৭৩ সালে এই আইনটি বাতিল করতে সাংবাদিকদের দাবির সঙ্গে সরকার একমত হয়। অবাধ তথ্য প্রবাহ আইন করার সময় এই অফিসিয়াল সিক্রেট অ্যাক্টের কার্যকারিতা স্থগিত করা হয় এবং সে সময় সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুতিও দেয়া হয় আপাত এই আইনের কার্যকারিতা থাকবে না। কিন্তু ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে এই সত্য গোপনের আইন জুড়ে দেয়া হয়।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় এ ধরনের আইন অনেকদিন প্রয়োগ হয়নি। আমরা যখন ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের সংশোধনীর জন্য আন্দোলন করি তখন সরকারের দায়িত্বশীল মহল থেকে এই আইনটির সংশোধনের আশ্বাস দিয়েও পালন করা হয়নি। এই আইন সাংবাদিকতার ইতিহাসে নতুন ধারা সংযোজিত করেছে। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, সম্প্রতি বার্মার সামরিক জান্তা এই আইনটি ব্যবহার করে রয়টার্সের দুজন সাংবাদিককে সাত বছর করে কারাদণ্ড দেয়। ফলে বার্মার সামরিক জান্তা সারা বিশ্বে নিন্দিত হয়। গণতন্ত্রের উচ্চকণ্ঠ বাংলাদেশও কি শেষ পর্যন্ত বার্মার কাতারে চলে গেল? এটা সত্যি দুঃখজনক। আমার মনে হয়, এই আইনটি অবিলম্বে বাতিল করা উচিত এবং এই আইনের সঙ্গে সঙ্গে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টও বাতিল হওয়া উচিত। কারণ এই আইন যতদিন থাকবে ততদিন সাংবাদিক নির্যাতন চলবে।

দৈনিক মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী বলেন, গত পঞ্চাশ বছরে এমন দেখিনি যে তথাকথিত গোপন নথি চুরি করার অভিযোগে একজন সাংবাদিককে গলাটিপে ধরার ঘটনা নজিরবিহীন। তাও তিনি যদি একজন নারী সাংবাদিক হন। রোজিনা ইসলামকে যেভাবে হেনস্তা করা হয়েছে তা দেখে দেশের মানুষ হতবাক, বিস্মিত।
তিনি বলেন, স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, এসব নথিপত্র প্রকাশ পেলে নাকি রাষ্ট্রের বড় ক্ষতি হয়ে যেত। কি আছে এসব চুক্তিতে, যেটা প্রকাশ করলে রাষ্ট্রের ক্ষতি হয়ে যাবে? এটা কি কোনো গোপন চুক্তি? অন্য কোনো দেশে হলে রাষ্ট্র নিজেই প্রকাশ করে দিত।

সিনিয়র সাংবাদিক মতিউর রহমান বলেন, দুনিয়া জেনে গেছে এই বর্বর আচরণের কথা। নিন্দা আর প্রতিবাদে ভারী হয়ে গেছে নেটমাধ্যম। প্রতিবাদ হয়েছে দেশ-বিদেশে। আন্তর্জাতিক এমন কোনো মাধ্যম নেই, যেখানে খবরটি ফলাও করে প্রচার হয়নি। জাতিসংঘেও পৌঁছে গেছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো সোচ্চার হয়েছে। বিভাজন ভুলে দেশের সাংবাদিকরাও ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। বুদ্ধিজীবীদের আলাদা আলাদা বিবৃতিও সেই বার্তাই দেয়। এমনকি শাসক দলের ভেতরেও ব্যাপক প্রতিক্রিয়া। সরকারের লাভ-ক্ষতিই বা কি? এক কথায় বলা যায়, সরকার কিছুই পায়নি, নিন্দা ছাড়া। এটা বারবার প্রমাণিত হয়েছে, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে গলাটিপে হত্যা করা যায় না। এমনিতেই বাংলাদেশে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ক্ষেত্র ছোট হয়ে আসছে।

দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্‌ফুজ আনাম আজ বুধবার লিখেছেন বলেন, অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের ৩ ধারাটিতে ‘গুপ্তচরবৃত্তির’ বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে। এই গুপ্তচরবৃত্তি তখনই সংঘটিত হয়, যখন কেউ তথ্য সংগ্রহ করেন এবং তা ‘শত্রু‘ দেশের হাতে তুলে দেন। কিন্তু রোজিনা ইসলামের ক্ষেত্রে এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। এই আইনের ধারা ৫-এ ‘সংরক্ষিত এলাকায় প্রবেশ’ এবং ‘কর্মকর্তাদের বেআইনি যোগাযোগের’ বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। আবারও বলতে হচ্ছে, একান্ত সচিবের কক্ষ ‘সংরক্ষিত’ এলাকা নয় এবং সেখানে বেআইনি কিছু করা হয়নি। এমনকি রোজিনা সেখানে এমন কিছুই করেননি, যার জন্য তাকে হেনস্তা করা যায়।
দেশের অন্যতম সিনিয়র এই সম্পাদক বলেন, আমরা জোর দিয়ে বলতে চাই, বাকস্বাধীনতাবিরোধী এবং বিতর্কিত আইনগুলোর মধ্যে অন্যতম অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট-১৯২৩, যা এখনো বিদ্যমান। এই আইন আমাদের সংবিধানের মূলনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। যুক্তিসংগত বিধি নিষেধের মাধ্যমে আমাদের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। এ ছাড়া এই আইন তথ্য অধিকার আইনের (আরটিআই) সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক। এই আইনে সরাসরি উল্লেখ করা হয়েছে, এর ধারার সঙ্গে সাংঘর্ষিক যেকোনো আইনের চেয়ে অগ্রাধিকার পাবে আরটিআই। এর অর্থ হলো, আরটিআই যত দিন আছে, তত দিন অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট কার্যকর হবে না বা আরটিআই দ্বারা এটি রহিত হবে।

নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক ও ডাকসুর সাবেক ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না সাননিউজকে বলেন, আজকে দেশে জনগণের প্রতিবাদ করার ক্ষমতা কেড়ে নেয়া হয়েছে। সব কিছু বলবে সরকার, আমরা কোন কিছু বলতে পারব না। কিন্তু এরা শুধু সত্যকে মিথ্যা বানানোর চেষ্টা করে যেটা সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের ক্ষেত্রে হলো। যদি এদের সমস্ত কিছুর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ গড়তে না পারি তাহলে আমাদের কোনো কাজ হবে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, আমাদের দেশে যখন ছাত্র অধিকার আন্দোলনের কর্মীদের
উপর হামলা চালানো হয় তখন তারা প্রতিরোধ করলে তাদের বিরুদ্ধেই মামলা করা হয়। আমরা আজকে সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের ক্ষেত্রেও দেখি যিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে রিপোর্ট করেছেন তার বিরুদ্ধেই মামলা করা হয়েছে। এটাই নিপীড়নকারীদের কৌশল। তারাই আক্রমণ করবে তারাই আবার মামলা করে হয়রানী করবে।

সাননিউজ/টিএস/

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

সাংবাদিকতায় সেরাদের অ্যাওয়ার্ড দিচ্ছে ডিএমএফ

নিজস্ব প্রতিবেদক: আগামী জুন মাসে...

এসএসসি পরীক্ষায় ফেল করায় আত্মহত্যা

নোয়াখালীর প্রতিনিধি: নোয়াখালীর সদ...

পুতিন প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে সরিয়ে দিচ্ছেন 

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্র...

বিশ্বকাপের দল ঘোষণা মঙ্গলবার

স্পোর্টস ডেস্ক: সব জল্পনা-কল্পনার...

ক্ষুব্ধ হয়ে মার্কিন সেনার পদত্যাগ

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: দীর্ঘ ৭ মাসেরও...

ঢাকায় মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী লু

নিজস্ব প্রতিবেদক: ২ দিনের সফরে ঢা...

দোহারে নদীতে নেমে শিক্ষার্থীর মৃত্যু

নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজধানীর দোহারে...

ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে আরও ৩৬ জন 

নিজস্ব প্রতিবেদক: গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে আরও ৩৬...

মুক্তি পেলেন বিএনপি নেতা সোহেল 

নোয়াখালীর প্রতিনিধি: বিএনপির যুগ্...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা