মতামত

বানিয়াচং থেকে বিশ্ব জয়ী এক মহারথীর প্রস্থান

রিপন দে :
১৯৭১ সালে ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ ও সব মানুষের অবর্ণনীয় দুঃখ ধারণ করে জাতি মুক্তিযুদ্ধের বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল। মুক্তিযুদ্ধের পরপর ইংল্যান্ড থেকে দেশে ফিরেন স্যার ফজলে হাসান আবেদl। লন্ডনের ফ্ল্যাট বিক্রি করে সে টাকা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে বিধ্বস্ত সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলায় শরণার্থীদের পুণর্বাসনের কাজে নেমে পড়েন তিনি। এই কার্যক্রমের ধারাবাহিকতায়ই তিনি গড়ে তোলেন ব্র্যাক।

ব্র্যাক বর্তমানে বিশ্বের সর্ববৃহৎ বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা। সারাবিশ্বে ব্র্যাকের লক্ষাধিক কর্মী প্রায় তেরো কোটি মানুষের জীবনে উন্নয়নে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। ফজলে হাসান আবেদের সুযোগ্য নেতৃত্বই ব্র্যাক অসাধ্য সাধন করেছে। এর আগে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন স্বাধীনতাযুদ্ধের পক্ষে সমর্থন আদায়, তহবিল সংগ্রহ ও জনমত গঠনের জন্য ইংল্যান্ডে কাজ করেন ফজলে হাসান আবেদ।

স্যার ফজলে হাসান আবেদ মানুষের দুঃখের সঙ্গী হয়ে নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে কর্মদক্ষতা ও দূরদর্শিতায় তিনি অনেক ত্যাগী ও বিবেকবান কর্মী নিয়ে ব্র্যাককে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে পেরেছেন। শুধু শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন অথবা ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি নয়, ব্র্যাক সমাজ গঠনের জন্য প্রতিটি খাতে কাজ করে যাচ্ছে। পৃথিবী দেখছে, বাংলাদেশের মতো ছোট দেশও আজ পৃথিবীর ১১টি দেশের দুঃখী মানুষের জীবনের উন্নতির কাজ করে।

পৃথিবীর বহু সম্মাননা ও নানা পদক আর পদবি পেয়ে, বহু ভালোবাসা পেয়েও স্যার ফজলে হাসান আবেদ ছিলেন মাটির মানুষ। নিজ ভালোবাসা দিয়ে দুঃখী মানুষের কাছাকাছি থাকার জন্য দীর্ঘ ৪৭ বছর অক্লান্ত কর্মতৎপরতার পর ব্র্যাক থেকে ২০১৯ সালে অবসরে যান তিনি।

অসহায় মানুষের সেবায় তিনি ছুটে গেছেন দেশের সীমানা পেরিয়ে বিদেশের দুর্গম জায়গাতেও। ২০০৬ সাল জাতিসংঘের ডেভেলপমেন্টের প্রধান তাঁকে সর্বোচ্চ সম্মানজনক পদক দেওয়ার সময় বলেছিলেন, ‘ফজলে হাসান আবেদের মতো মাত্র ছয়জন রাষ্ট্রপ্রধান যদি পেতাম, তাহলে পৃথিবীতে আমি খাদ্যের অভাব চিরতরে দূর করে দিতে পারতাম।’

তিনি উদাহরণ দিয়ে সে দিন বলেছিলেন, যখন আফগানিস্তানের ভয়াবহ যুদ্ধের মধ্যে তাদের কমিউনিটি স্বাস্থ্য ক্লিনিকগুলোর দায়িত্ব নেওয়ার জন্য পৃথিবীর সব দেশের প্রতিনিধিদের অনুরোধ জানালাম, তখন সবাই চুপ করে থাকলেন, কিন্তু শুধু একজন মানুষ তাঁর ছোট্ট একটা হাত তুললেন এবং বিরাট হৃদয় নিয়ে স্যার ফজলে হাসান আবেদ এই দুর্দিনে এগিয়ে আসেন। সেই থেকে ব্র্যাক আফগানিস্তানের স্বাস্থ্যসেবার গুরুদায়িত্ব ভয়ানক বিপদের মধ্যেও বহন করে চলেছে।

স্যার ফজলে হাসান আবেদ ১৯৩৬ সালের ২৭ এপ্রিল বাংলাদেশের হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণী থেকে ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। পরবর্তীতে দেশভাগের ঠিক আগে তার বাবা পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে হবিগঞ্জ থেকে গ্রামের বাড়ি বানিয়াচংয়ে চলে আসেন। পরবর্তীতে তিনি চাচার চাকুরীস্থলে ভর্তি হন কুমিল্লা জেলা স্কুলে। সপ্তম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সেখানেই লেখাপড়া করেন। এরপর চাচা জেলা জজ হিসেবে পাবনায় বদলি হওয়ায় তিনিও চাচার সাথে পাবনায় চলে যান এবং পাবনা জেলা স্কুলে ভর্তি হোন। সেখান থেকেই ১৯৫২ সালে ম্যাট্রিক পাশ করেন। ১৯৫৪ সালে এইচএসসি পাস করেন নটরডেম কলেজ থেকে। সেবছরই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিজিক্স বিভাগে অনার্সে ভর্তি হন। ১৯৫৬ সালের অক্টোবর মাসে তিনি স্কটল্যান্ডে গিয়ে গ্লাসগো ইউনিভার্সিটিতে নেভাল আর্কিটেকচারে ভর্তি হন। নেভাল আর্কিটেকচারের কোর্স ছিল চার বছরের। দুবছর লেখাপড়া করে কোর্স অসমাপ্ত রেখে ১৯৫৬ সালে গ্লাসগো ইউনিভার্সিটি ছেড়ে লন্ডন চলে যান এবং সেখানে ভর্তি হন অ্যাকাউন্টিংয়ে। এখানে কষ্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্টিংয়ের উপর চার বছরের প্রফেশনাল কোর্স পাশ করেন ১৯৬২ সালে। পরবর্তীতে তিনি শেল অয়েল কোম্পানীতে অর্থনৈতিক কর্মকর্তা হিসাবে যোগ দেন। এ ছাড়া তিনি ১৯৯৪ সালে কানাডার কুইনস ইউনিভার্সিটি থেকে ‘ডক্টর অব ল’ এবং ২০০৩ সালে যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটি থেকে ‘ডক্টর অব এডুকেশন’ ডিগ্রি লাভ করেন।

একাত্তর সালের ডিসেম্বর মাসে ফজলে হাসান আবেদ সদ্য স্বাধীন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে ফিরে আসেন। এ সময় তিনি তাঁর লন্ডনের ফ্ল্যাট বিক্রি করে সেই অর্থ দিয়ে ত্রাণকাজ শুরু করেন। মুক্তিযুদ্ধকালে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া সুনামগঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চল শাল্লা এলাকায় কাজ শুরু করেন।

ফজলে হাসান আবেদ সামাজিক ক্ষেত্রে তাঁর অনন্য সাধারণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ডেভিড রকফেলার ব্রিজিং লিডারশীপ অ্যাওয়ার্ড (২০০৮), ক্লিনটন গ্লোবাল সিটিজেনশিপ অ্যাওয়ার্ড (২০০৭), হেনরি আর ক্রাভিস প্রাইজ ইন লিডারশীপ (২০০৭), দারিদ্র্য দূরীকরণ ও সামাজিক উন্নয়নে অবদানের জন্য পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) প্রদত্ত আজীবন সম্মাননা (২০০৭), গেটস্ অ্যাওয়ার্ড ফর গ্লোবাল হেলথ (২০০৪), মানব উন্নয়নে বিশেষ অবদানের জন্য ইউএনডিপি মাহবুবুল হক অ্যাওয়ার্ড (২০০৪), গ্লেইটসম্যান ফাউন্ডেশন পুরস্কার (২০০৩), দ্য শোয়াব ফাউন্ডেশন সোশ্যাল এন্টারপ্রেনারশিপ অ্যাওয়ার্ড (২০০২), ওলফ পামে অ্যাওয়ার্ড (২০০১), ইউনিসেফ মরিস পেট অ্যাওয়ার্ড (১৯৯২), অ্যালানশন ফেইনস্টেইন ওয়ার্ল্ড হাঙ্গার পুরস্কার (১৯৯০), ইউনেসকো নোমা পুরস্কার (১৯৮৫) এবং র্যামন ম্যাগসাইসাই অ্যাওয়ার্ড ফর কমিউনিটি লিডারশীপ (১৯৮০) লাভ করেন।

এ ছাড়া মানবিক ক্ষেত্রে অবদান রাখার জন্য ব্র্যাক বিশ্বের সর্ববৃহৎ পুরস্কার কনরাড এন হিলটন হিউম্যানিট্যারিয়ান অ্যাওয়ার্ড (২০০৮) এবং বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ (২০০৭) অর্জন করে।

বিশ্ব জনস্বাস্থ্য ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান এবং বিশ্বব্যাপী দরিদ্র মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য ফজলে হাসান আবেদ ২০১৬ সালে ‘টমাস ফ্রান্সিস জুনিয়র মেডেল অব গ্লোবাল পাবলিক হেলথ’ পদক লাভ করেন। খাদ্য ও কৃষিক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৫ সালে ‘ওয়ার্ল্ড ফুড প্রাইজ’ লাভ করেন। ২০১৩ সালে তিনি হাঙ্গেরির ‘সেন্ট্রাল ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি’ (সিইইউ) থেকে ‘ওপেন সোসাইটি প্রাইজ’ লাভ করেন। ২০১১ সালে তিনি কাতার ফাউন্ডেশন প্রবর্তিত শিক্ষাক্ষেত্রে বিশ্বের সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘ওয়াইজ প্রাইজ’ লাভ করেন। ২০১০ সালে দারিদ্র্য-বিমোচনে অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি যুক্তরাজ্যের অন্যতম সর্বোচ্চ সম্মানজনক উপাধি ‘নাইটহুড’ লাভ করেন।

পেয়েছেন বিরল কিছু স্বীকৃতি। অশোকা ফজলে হাসান আবেদকে অন্যতম ‘গ্লোবাল গ্রেট’ স্বীকৃতিতে ভূষিত করে। তিনি এই প্রতিষ্ঠানের ‘গ্লোবাল অ্যাকাডেমি ফর সোশ্যাল এন্টারপ্রেনাওরশিপ’-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। ২০১০ সালে জাতিসংঘের মহাপরিচালক বান কি মুন ফজলে হাসান আবেদকে বিশ্বের স্বল্পোন্নত দেশসমূহের ‘স্বনামধন্য ব্যক্তিবর্গে’র একজন হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেন।

ফজলে হাসান আবেদ বিশ্বের নানা প্রতিষ্ঠান থেকে সম্মানসূচক ডিগ্রি লাভ করেন। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি থেকে সম্মানসূচক ডিগ্রি (২০১৪), যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটি থেকে সম্মানসূচক ডিগ্রি (২০১২), যুক্তরাজ্যের বাথ ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টর অব লজ (২০১০), যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টর অব লেটার্স (২০০৯), যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টর অব লজ (২০০৮), যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টরেট অব হিউম্যান লেটার্স (২০০৭), যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টর ইন এডুকেশন (২০০৩), কানাডার কুইন্স ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টর অব লজ (১৯৯৪) উল্লেখযোগ্য।

স্যার ফজলে হাসান আবেদ জন্মেছিলেন ১৯৩৬ সালের ২৭ এপ্রিল। চলে গেলেন ২০১৯ সালের ২০ ডিসেম্বর। রেখে গেলেন ব্র্যাক। তার স্বপ্ন, তার প্রতিষ্ঠান।

জন্মস্থানের সঙ্গে তার কর্মক্ষেত্রের একটা দারুণ মিল পরিলক্ষিত হয়। বানিয়াচং বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় গ্রাম। ফজলে হাসান আবেদের গড়া প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।

সান নিউজ/সালি

Copyright © Sunnews24x7

Newsletter

Subscribe to our newsletter and stay updated.

সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

ভোলায় অনুষ্ঠিত হলো প্রাণী প্রদর্শনী মেলা

ভোলা প্রতিনিধি: ‘প্রাণিসম্পদে ভরবো দেশ, গড়বো স্মার্ট ব...

সম্মিলনী বিদ্যালয়ের সভাপতি ফিরোজ আহমেদ

কামরুল সিকদার, বোয়ালমারী (ফরিদপুর) : ফরিদপুর জেলার সদর ইউনিয়...

হিট স্ট্রোক প্রতিরোধে করণীয়

লাইফস্টাইল ডেস্ক : দেশে তাপপ্রবাহ বাড়ছে। আর এই গরমে সবচেয়ে ব...

বাংলাদেশ স্কাউট দিবস ২০২৪ পালিত

নিজস্ব প্রতিবেদক : আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউটে অনুষ্...

ভাসানচরে এক রোহিঙ্গাকে গলা কেটে হত্যা

নোয়াখালী প্রতিনিধি : নোয়াখালীর হাতিয়ার ভাসানচর রোহিঙ্গা ক্যা...

কৃষক লীগকে গ্রামে নিয়ে যাওয়া ভালো

নিজস্ব প্রতিবেদক : কৃষক লীগকে শহরের মধ্যে আটকে না রেখে গ্রাম...

শেখ হাসিনার মতো নেতৃত্ব বিশ্বে বিরল

নিজস্ব প্রতিবেদক : মৃত্যুঞ্জয়ী শেখ হাসিনা সব প্রতিবন্ধকতা উপ...

দেশে ৩ দিনের হিট অ্যালার্ট জারি

নিজস্ব প্রতিবেদক : দেশে গত কদিন ধরেই চলছে তীব্র দাবদাহ। এ অব...

ছুটির দিনে মুখর সোহরাওয়ার্দী

নুসরাত জাহান ঐশী: আজ সপ্তাহিক ছুটির দিনে রাজধানীর প্রাণকেন্দ...

ভারত ছাড়লেন সালমান খান

বিনোদন ডেস্ক : বলিউডের ভাইজান খ্যাত সুপারস্টার সালমান খান। স...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা