মতামত

অগ্রযাত্রা রুখতে পারে মহামারি!

সেলিম রেজা : বাংলাদেশসহ বিশ্বের অসংখ্য দেশের ওপর করোনার মহামারির ভয়াল আগ্রাসনের ১৫ মাসের অধিক সময় হতে চলল। বাংলাদেশের স্বাভাবিক অর্থনৈতিক, সামাজিক ও বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয়েছে এবং হচ্ছে। দেশের মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে একেবারে খেটে খাওয়া মানুষ আজ জীবন-জীবিকার চিন্তায় দিশেহারা এবং এর যে শেষ কোথায়, তা বলতে গেলে প্রায় অজানা।

এক দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে যে উন্নয়নের গতিধারা অব্যাহত ছিল, করোনা মহামারির কারণে তা আজ অনেকটা বাধাগ্রস্ত। সরকারের সব স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কেননা, ছোট-বড় উন্নয়ন প্রকল্প, এমনকি মেগা প্রকল্প থেকেও সরকারকে বেশি মনোযোগ দিতে হচ্ছে মানুষের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছানো, টিকাদান কর্মসূচি, প্রণোদনা ও ত্রাণসহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে। একদিকে সামাজিক খাতে সরকারকে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে, অন্যদিকে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা স্বাভাবিক রাখা, কৃষি ও শিল্পের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য সরকারকে দেশি-বিদেশি উৎস থেকে ঋণ করে হলেও অনেক বেশি অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। মানুষের ওপর করের বোঝা কমানোর জন্য আয়কর কমানোসহ নানামুখী কর অবকাশ-সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এতে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ঘাটতি দেখা যেতে পারে। আগামী অর্থবছরে সরকার যে ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে, তা কতটুকু অর্জিত হবে, সেটা নিয়ে কিছুটা হলেও অনিশ্চয়তা থেকে যায়।

বিধিনিষেধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গোটা অর্থনীতি। তবে বেশি প্রভাব পড়েছে ইনফরমাল জব সেক্টর বা অনানুষ্ঠানিক কাজের ক্ষেত্রে। যেমন বিধিনিষেধে রিকশা ও ভ্যানচালক, চা-বিক্রেতা, ফেরিওয়ালা, গৃহকর্মী, মুচি, কামারসহ অনেক পেশাজীবী মানুষের আয় বলতে গেলে শূন্যের কোটায় নেমে গেছে। খুচরা ব্যবসায়ী, ছোট-বড় দোকানদার, রেস্তোরাঁর কর্মচারী ও আবাসিক হোটেলের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কাজ হারিয়ে আজ পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। এত বিপুলসংখ্যক দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের ভরণপোষণের দায়িত্ব নেওয়া সরকারের পক্ষেও কঠিন হয়ে যাচ্ছে। সুতরাং করোনার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, টেকসই উন্নয়নের জন্য কাঠামোগতভাবে বা নীতিনির্ধারণে আমরা কতটা দুর্বল। যার কারণে করোনার এক ঝাঁকুনিতে মোট জনসংখ্যার ২১ দশমিক ২ শতাংশ মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে এসেছে (জুন ২০২০)। বর্তমানে তা কিছুটা কমে ১৪ দশমিক ৭ শতাংশে নেমে এসেছে (ঢাকা ট্রিবিউন, এপ্রিল ২০, ২০২১)।

সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হচ্ছে, এই কঠিন মহামারিতেও আমরা দেখেছি সরকারের বিভিন্ন বিভাগ ও দপ্তরের মধ্যে সমন্বয়হীনতা (যেমন সরকারি ধান, চাল, গম ক্রয় ও সংরক্ষণে ব্যর্থতা), স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি ও দূরদর্শিতার অভাব। স্বাস্থ্য খাত নিয়ে খোদ সরকারের মধ্যেই সমালোচনার ঝড় বইছে। এই মহামারির সময়ে স্বাস্থ্য খাতসহ যেকোনো জায়গায় যেকোনো ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতি সরকারের সহ্য করা উচিত নয়। এটা বুঝতে হবে, সরকারের যেকোনো উন্নয়নমূলক প্রকল্পে বিস্তার করা দুর্নীতি প্রতিহত না করলে সরকারের সফলতা ও অর্জন প্রশ্নের মুখে পড়বে। আশ্রয়ণ প্রকল্প নিয়ে যে দুর্নীতি প্রকাশ পেয়েছে, তা থেকে অনুধাবন করা যায়, দুর্নীতিবাজরা কতটা বেপরোয়া ও তাদের শিকড় কত গভীরে! করোনাকালে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য সবচেয়ে বড় বাধা এরা।

আবার করোনাকালে শিক্ষা খাতের স্থবিরতা নিয়েও নানা সংশয় দেখা দিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে ঘরবন্দী সব স্তরের শিক্ষার্থীরা। যদিও সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট এবং সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনে ক্লাস-পরীক্ষা নেওয়া শুরু করেছে। পৃথিবীব্যাপী উন্নত দেশসহ অনেক দেশ করোনাকালে অনলাইনে ক্লাস-পরীক্ষা চালু রেখেছে। ইউজিসি, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তাব্যক্তিদের আরও অনেক আগেই অনলাইনভিত্তিক ক্লাস-পরীক্ষা কীভাবে নেওয়া যায়, তার একটি রূপরেখা নির্ধারণ করা উচিত ছিল। সেটি করতে তাঁরা ব্যর্থ হয়েছেন। তবে এখনো সময় আছে, সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনভিত্তিক ক্লাস-পরীক্ষা নেওয়া যায় কি না, তা ভেবে দেখার। পাশাপাশি এসএসসি ও এইচএসসি পর্যায়েও অটো পাসের পরিবর্তে বিকল্প কোনো উপায় বের করা যেতে পারে।

বাংলাদেশের মতো একটি উদীয়মান অর্থনীতির দেশের জন্য করোনার নানামুখী প্রভাব কাটিয়ে ওঠা কঠিন হলেও অসম্ভব বলে আমি মনে করি না। তবে সে ক্ষেত্রে সরকারকে তার দুর্বল জায়গাগুলো খুঁজে বের করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। করোনা মোকাবিলায় স্বাস্থ্য খাতের উন্নতির পাশাপাশি দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে সরকারকে আরও কৌশলী ও দক্ষ হতে হবে। আমরা প্রায়ই দেখে থাকি, ত্রাণের বা সরকারি সাহায্যের টাকা প্রকৃত অভাবী বা সুবিধাভোগীর কাছে না গিয়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী ও প্রশাসনের কর্মকর্তার পকেটে চলে যাচ্ছে। এ সমস্যা সমাধানের জন্য দরিদ্র ও অভাবী মানুষের জন্য সরকারের একটি শক্তিশালী ডেটাবেইস গড়ে তোলা দরকার। যার মাধ্যমে সরকার সহজেই প্রকৃত সুবিধাভোগীর কাছে ত্রাণ ও আর্থিক সহায়তা পৌঁছে দিতে পারে।

বাংলাদেশের মতো একটি উদীয়মান অর্থনীতির দেশের জন্য করোনার নানামুখী প্রভাব কাটিয়ে ওঠা কঠিন হলেও অসম্ভব বলে আমি মনে করি না। সরকারকে তার দুর্বল জায়গাগুলো খুঁজে বের করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। স্বাস্থ্য খাতের উন্নতির পাশাপাশি দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে সরকারকে আরও কৌশলী ও দক্ষ হতে হবে।
উন্নত বিশ্বে যেমন একটি সোশ্যাল সিকিউরিটি নম্বরের মাধ্যমে প্রত্যেক নাগরিকের যাবতীয় তথ্য রাখা হয়, তেমনি আমাদের এনআইডি নম্বরে নাগরিকের সব তথ্য (যেমন: পেশা, আয়, ব্যয়, পরিবারের উপার্জনক্ষম সদস্যসংখ্যা, শিক্ষাগত যোগ্যতা, জমির পরিমাণ ইত্যাদি) সংরক্ষণ করতে হবে এবং পাশাপাশি রাজস্ব বোর্ডের সঙ্গে কলাবুরেশন থাকতে হবে। প্রত্যেক নাগরিককে নিজ দায়িত্বে যাবতীয় তথ্য হালনাগাদ করতে হবে ইউনিয়ন পরিষদ, ওয়ার্ড কাউন্সিল অথবা উপজেলা সমাজসেবা অফিস থেকে। তাহলে দরিদ্র মানুষ যথাযথভাবে সরকারি সহায়তার আওতায় আসবে ও উপকৃত হবে।

সরকারের লকডাউন কর্মসূচি সফল না হওয়ার পেছনে একটা বড় কারণ হচ্ছে অসংখ্য মানুষের ঘরে খাদ্যের সংস্থান নেই। একদিকে সাধারণ মানুষের আয়-রোজগার দিন দিন কমে যাচ্ছে, অন্যদিকে খাদ্যপণ্যের উচ্চ মূল্য, এই দুইয়ের ঘাত-প্রতিঘাতে সাধারণ মানুষ আজ দিশেহারা। করোনায় যেভাবে মানুষ মারা যাচ্ছে, তাতে যে কারও মনে হতে পারে, ‘বাঁচতেই যদি না পারি, তাহলে খাদ্যশস্য দিয়ে কী হবে।’ কিন্তু আমাদের এ কথা ভুলে গেলে চলবে না, করোনায় দেশে এ পর্যন্ত ১৯ হাজারের বেশি মানুষ মারা গেলও বাকি ১৬ কোটির অধিক মানুষের খাদ্য সংস্থানের কথা আমাদের ভাবতে হবে।

লকডাউনের কারণে যাদের অনেকের জীবন-জীবিকা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। ঘরে ঘরে পর্যাপ্ত খাদ্য থাকলে জীবনের মায়া উপেক্ষা করে মানুষ ঘরের বাইরে আসত না। সুতরাং অর্থনীতির চাকা সচল এবং উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে হলে অতি দ্রুত সবাইকে টিকাদান কর্মসূচির আওতায় এনে শিল্পকারখানা, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, স্কুল-কলেজ ও যান চলাচল চালু করতে হবে। করোনার নতুন কোনো ভেরিয়েন্ট যাতে দেশে ঢুকতে না পারে, সে ব্যাপারে স্বাস্থ্য বিভাগসহ সরকারের অন্যান্য বিভাগকে আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে।

সরকারের চলমান মেগা প্রকল্পগুলো (পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, ঢাকা মেট্রোরেল, পায়রা সমুদ্রবন্দর ইত্যাদি) হচ্ছে বাংলাদেশ অর্থনীতির প্রাণ। এগুলোকে কম গুরুত্ব দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। দীর্ঘমেয়াদি এই প্রকল্পগুলোর গতি একটু কম হলেও কোনো কারণে বন্ধ রাখা ঠিক হবে না। পাশাপাশি মানুষকে স্বাভাবিক কর্মজীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য পর্যাপ্ত টিকাদানের ব্যবস্থাসহ স্বাস্থ্য খাতকে ঢেলে সাজানো দরকার। করোনার অছিলায় বিভাগীয় হাসপাতালসহ জেলাপর্যায়ের হাসপাতালগুলোয় আইসিইউ ও অক্সিজেন ব্যবস্থাপনার উন্নতি করতে পারলে চিকিৎসাব্যবস্থার একটা আমূল পরিবর্তন আসতে পারে এবং করোনা-পরবর্তীকালে অনেক মুমূর্ষু রোগীর প্রাণ রক্ষায় কাজে আসবে। স্বাস্থ্য খাতে অধিক বিনিয়োগে দীর্ঘ মেয়াদে দেশ উপকৃত হবে এবং অনেক বৈদেশিক মুদ্রা রক্ষা হবে, যা মানুষ বিদেশে চিকিৎসার জন্য খরচ করে।

করোনাকালে সরকারের ওপর নানামুখী চাপ থাকা সত্ত্বেও একটা ভালো খবর হচ্ছে প্রবাসী আয়ের প্রবাহ ২০২০ সালের মার্চ-এপ্রিলে কমলেও বর্তমানে তা আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তবে প্রবাসী আয়ের প্রবাহ অব্যাহত রাখা এবং নতুন শ্রমশক্তি রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা জোরদার করার পাশাপাশি বিদেশগামী শ্রমিকদের দ্রুত টিকাদান, করোনা পরীক্ষার সুবিধা বৃদ্ধিসহ পর্যাপ্ত ফ্লাইটের ব্যবস্থা করা খুব জরুরি। করোনার আঘাতে সারা বিশ্বে প্রতি ৩ জনে ১ জন কাজ হারানোর আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ বিষয় মাথায় রেখে এবং নতুন যে বিশাল শ্রমশক্তি বাজারে ঢোকার অপেক্ষায় আছে, তাদের কথা বিবেচনায় রেখে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নতুন নতুন কর্মক্ষেত্র তৈরির পরিকল্পনা এখনই করতে হবে। যুদ্ধের সময়ের কথা বলি আর মহামারির কথা বলি, যার ঘরে খাবার থাকে, সে-ই প্রকৃত ধনী ও সংকট মোকাবিলায় সক্ষম হয়। সুতরাং খাদ্যশস্য উৎপাদন বৃদ্ধি ও মজুত বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে।

লেখক : সেলিম রেজা, সহযোগী অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

সান নিউজ/এনএম

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

উত্তরায় প্রাইভেটকারে অপহরণ; ভিডিও ভাইরালের পর গ্রেপ্তার ২

রাজধানীর উত্তরা এলাকায় চাঞ্চল্যকর অপহরণের ঘটনায় অপহরণে ব্যবহৃত একটি প্রাইভে...

আমাকে চেয়েছিলো যুদ্ধাপরাধী মামলার আসামী বানাতে: ডা. শফিকুর রহমান

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, গত সরকারের সময় তিনবার...

ভালুকায় সৌন্দর্য বাড়াতে ইউএনও’র ‘নিজ খরচে’ সবুজ বিপ্লব

ভালুকা উপজেলার পরিবেশ সংরক্ষণ ও নগর সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে এক ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নি...

কালীগঞ্জে ফিল্মিস্টাইলে যুবককে পিটিয়ে হত্যা

গাজীপুরের কালীগঞ্জে জমি সংক্রান্ত পূর্ব বিরোধের জে...

সড়কহীন ৩৪ কোটি টাকার সেতু

সেতু আছে কিন্তু সংযোগ সড়ক করা হয়নি এমন সেতু ফেনীতে...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা